বয়ঃসন্ধির অভিজ্ঞতা

                   

                 

        ১৯৬৩ সালের জানুয়ারী মাসে আমি আর ছোট ভাই বাচ্চু ভর্তি হলাম হিন্দু স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে। আগের বছর ক্রাইস্টচার্চে ক্লাস থ্রি তেই পড়েছি—ফলে একটা শিক্ষাবর্ষ পেছিয়ে গেলাম। মহা মহীমান্বিত শিক্ষা্নিকেতনটিতে ভর্তি হয়ে কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবে খুব একটা পর্বান্তর হয়নি তখনো।  যাতায়াতটা কেবল শহরের বাইরের দিক ছেড়ে ঘটতে থাকল শহরের ভেতর দিকে।  সকালবেলা যেতাম বাড়ির গাড়ি করে। নিত্য নতুন রাস্তা চেনা,কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট না বিধান সরণি, হ্যারিসেন রোড না মহাত্মা গান্ধী রোড;  জায়গার নাম হেদো না আজাদ হিন্দ বাগ, গোলদিঘি না কলেজ স্কোয়ার; বাস-ট্রাম রুট,বাসের দু নম্বর, টু-এ, টু-বি——না—টু-সি,  দোকানের নাম টসের চা, ডি রতনের ছবির দোকান ইত্যাদি নিবিড় বিচার বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠতে থাকল।

       আজ পিছন ফিরে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যবর্তী পর্যায়টার সম্বন্ধে মনে হচ্ছে যে কি ভেতর কি বাইরের জগতে ঐ সময়টা খুব একটা স্বস্তি দায়ক/ সম্মনজনক ভাবে কাটে নি/ খানিকটা হীনমন্যতার কাল ছিল। ক্লাস এইটের দ্রুত পঠনের বইটায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পটি পড়েছিলাম। তখনই নিজের অবস্থার সঙ্গে কবির অর্ন্তদৃষ্টির এতোটাই সাযুজ্য পেয়েছিলাম যে একটু বিস্তৃত উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। “——- বিশেষত,তের-চৌদ্দ বৎসরের বালকের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথা মাত্রই প্রগলভতা। হঠাৎ কাপড় চোপড়ের পরিমান রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধারূপে জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কন্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সেজন্যে তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোন স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।

     সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্যে কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময় যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না,কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।

—–চারি দিকের স্নেহশূণ্য বিরাগ তাহাকে পদে পদে কাঁটার মতো বিঁধে। এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধরণা হইতে  আরম্ভ হয়, অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয়।”——এই  না হলে প্রজাপতি, কবি যিনি আমারই মতো ওই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে আমারই কথা আমাকেই শুনিয়ে দিতে পারেন। জীবনের ওপর সুখ দুঃখের মেঘ রৌদ্র যে ছায়া ফেলে যায় তারই সামান্য কিছু অংশ নিচে  ধরে দিতে গিয়ে বার বার মনে হচ্ছে, “এ জীবনে কান্না যত, হয় কি হাসি কভু তত ?’’ কিম্বা “কাঁদার সময় অল্প ওরে ভোলার সময় বড়।”

      পথে বার হতে থাকার এই সুবাদেই হয়ত আমাদের ওপরে অভিভাবকদের কিছুটা আস্থা গড়ে উঠে ছিল। ওদের বোধহয় মনে হয়েছিল যে  অপগন্ডগুলোর তখন আর ছেলেধরার হাতে ধরা পরা বা গাড়ির ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা নেই বা কমে গেছে। বাড়ির বাইরে বের হবার ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হয়ে এল। পরিবারের পর্যায়ে বয়সের স্তরে বিন্যস্ত সম্পর্কগুলোর নিজের জায়গায় রইল নিজের মতন, পাড়াতে নানা বয়সের ছেলেপিলের জটলা, জুটলো অনেক বন্ধু।  বাড়ির মধ্যে ঘরের কোণের খেলা কমে গিয়ে সামনের মাঠে ব্যাটবল পেটানো বা কাদা মেখে ফুটবল খেলায় আকর্ষণ বেড়ে চললো। নজরদারীর ঐ শৈথিল্যের সুযোগে ক্লাস থ্রি’র ছাত্র, আমার পরের ভাইটি নেমে পড়ে কোলকাতা আবিষ্কারে। বাড়ির সকলের অলক্ষ্যে সে কাছাকাছি ট্রাম বা বাস টার্মিনাস থেকে যাত্রা করতে শুরু করে পৌছে যেতে থাকে ঐ রুটের শেষ অব্দি। আবার একই ভাবে ফেরা চলতে থাকে বেশ কিছু দিন ধরে। বাস ভাড়া নির্বাহিত হতে থাকে মায়ের পয়সার কৌটো থেকে। সে আমলে পকেট মনি তো দূরের কথা ছোটদের হাতে পয়সা দেওয়ার রেওয়াজও ছিল না। কারণ মনে করা হত যে পয়সা হাতে পেলেই তারা আজেবাজে জিনিষ খেয়ে শরীর খারাপ করবে অথবা অপ্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে পয়সা নষ্ট করবে। তাই প্রয়োজন কিছু থাকলে বড়দের তা জানাতে হবে, আর সেই প্রয়োজন যথার্থ মনে হলে তবেই তা পুরণ করা হবে। ফলে শখ মেটাতে চুরি ভিন্ন পথ ছিল না, যে পাপে আমাদের অনেকেই পাপী ছিল। আর আমার ভাইটি তার পথ চেনার ঐ শখ  মেটতে গিয়ে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে বিকেলে অফিস টাইমের ভিড়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বাসে উঠতে গিয়ে ব্যার্থ হয়। নিরুপায় হয়ে কাছাকাছি একটা লোহার দোকানে গিয়ে বাড়িতে ফোন করতে চায়।  ইতিমধ্যে সন্ধ্যে নাগাদ ও না ফেরায় বাড়িতেও খোঁজ খোঁজ শুরু হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে দোকানের মালিক বাবার পরিচিত হওয়ায় দয়া পরবশ হয়ে তিনি ফোনে বাড়িতে খবর দেন। বাড়ির গাড়িতে করে ওকে নিয়ে আসা হয়।এটা ১৯৬৪ সালের ঘটনা। ভাইটির কর্মকান্ডের এই যে সুত্রপাত হল তা ক্রমেই পরিব্যাপ্ত হয়েই চলল পরের পরের ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে। সে বছর বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে বিশাল প্রান্তরে বসেছিল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফেয়ার বা পশ্চিমবঙ্গ শিল্পমেলা। রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দাদুর আর শিল্প কারিগরি দপ্তরের কর্মচারী হিসেবে কাকুর একটা করে কম্‌প্লিমেন্টারি এন্ট্রি কার্ড এসেছিল। ছুটির দিন বা রবিবার ছাড়া ওগুলোর বিশেষ খোঁজ পড়তনা। উনি ওগুলো দেখিয়ে মেলায় বেড়াতে লাগলেন। ব্যাপারটা আমার কিছুটা জানা ছিল। ঐ মেলাতে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু ছ’তলার একটা লোহার টাওয়ার বানানো হয়েছিল, যাতে লোক উঠত লাইন দিয়ে টিকিট কেটে।একদিন পাড়াতে খুব হৈ হৈ, কি না ওপর থেকে পড়ে একটি ছেলে  মারা গেছে। আমার চোরের মায়ের দশা, না পারি বলে দিতে (তাহলে কৈফিয়ৎ চাওয়া হবে আগে জানাইনি কেন ?), না পারি ভুলতে (কারণ ও যে আমার ঘনিষ্টতম)। যাইহোক আমার অস্বস্তির অবসান ঘটিয়ে  সন্ধ্যের আগেই সে ফিরে এলে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। বাড়িতে যেহেতু ছোটদের একবারের বেশি চা খাওয়া নিয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা ছিল তাই উনি পরিচিত বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চায়ের তৃষ্ণা নিবারণ করতে থাকেন, ফল জন্ডিস্‌। রোগ নিশ্চিত করতে ইউরিন টেস্টের জন্যে সকালবেলার হিসিটি ওকে ধরে রাখতে শিশি দেওয়া হয়। যেহেতু শিশি ভর্তি হয়নি তাই উনি বুদ্ধি করে জল দিয়ে শিশিটি ভর্তি করে দেন, ফল সহজেই অনুমেয়। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ওর প্রগাঢ় কৃষ্ণ ভক্তি জন্ম নেয়, এতোই ভক্তি যে ও কৃষ্ণের সন্ধানে বৃন্দাবন যাত্রা করে একট চটের থলিতে একটা প্যান্ট, এক শিশি মাথার তেল একটা ডাইরি,একটা গামছা আর পাঁচটা  মতো টাকা সম্বল করে। পিতৃপুরুষের বহু পূণ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ওর মায়ের কথা মনে হওয়ায় ওখান থেকে ফোন করে বাড়িতে,দাদু জি আর পি’তে যোগাযোগ করে ওকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। দ্বিতীয় বার জন্ডিস্‌ হবার কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায় যে ও তার আগে বেশ কিছু দিন ধরে পাড়ার যে দোকানটি থেকে বাকিতে জিনিষপত্র আনা হতো সেখান থেকে শিশুদের অখাদ্য বলে বিবেচিত হজমি, চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে খেয়েছে। কি নামে ধার দেওয়া হবে জিজ্ঞাসা করলে বলে এসেছে, “লিখুন, বড় বৌদি (মা পারিবারিক ভাবে এই নামে পরিচিত ছিল)’র ছেলে ঝাঁটা (কখন বা বঁটি ইত্যাদি) নিয়েছে।’’ এছাড়া মাঠে নেমে খেলাধুলো করতে ও বিশেষ উৎসাহী ছিলনা। ওই বয়েসের অনেক ছেলেরই যা থাকে সেই গল্পের বইও সে খুব একটা পড়ত না। অনেক সময় পিসতোতো বোন লালীর সঙ্গে, অনেক সময় আবার একা একাই  রান্নাবাটি কি পুতুল খেলা ইত্যাদি সাংসারিক কাজকর্মের বালক সুলভ পুনরাভিনয় করে অবসর কাটাতো । ওর চলাফেরাও ছিল অনেক সময় মহিলা মহলে। ‘মেয়ে কুটনি’ অর্থাৎ মেয়ে মহলের কুট কচালী নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্যে ওকে কম তিরষ্কৃত হতে হতো না।

     আর সেই সময়ে আমি সামনের মাঠে ময়দানে ফুটবল,ক্রিকেট,ব্যাডমিন্টন খেলে নিজের ‘পুরুষজনচিত’বৃত্তির চর্চায় নিয়োজিত ছিলাম। ‘পুরুষোচিত’ বলেছি কারণ ভাইটির ওই সব ‘নিন্দনীয়’ (‘মেয়েলি’) আচরণ থেকে নিজেকে শত হস্ত দূরে রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছিল সে সময়ে। খেয়াল রাখতে হবে যে আমাদের বাল্যকালে ছেলেদের ‘ব্যাটাছেলে’ হয়ে উঠতে প্ররোচনা দিতেন মা, মাসি পিসিরাই। দুটো জগতের পরষ্পরের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম এই পর্যায় থেকেই। পরে ভেবে দেখেছি যে সব সময় ‘মেয়েলি’ খেলা খেলতে খারাপ লাগতো তা বলে নয়; বড়রা বলে দিয়েছে তাই করতে নেই মেনে নেওয়া।  সেই যুগটা ফ্রি মিক্সিং এর কাল ছিলনা। সেই পারিপার্শিকতায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে মহিলাদের ওই জাতীয় খেলাধুলো করার ব্যাপারটা ছিল অচিন্তনীয়।  ছেলে আর মেয়েদের জগৎ (অন্তত আমাদের পাড়ায়) বয়ে যেত সমান্তরাল ভাবে। কোনোও প্রকার ঘনিষ্টতা, কাছাকাছি আসার সামান্য সম্ভাবনাকেও সন্দেহের চোখে দেখা হত। বাড়িতে নবাগত কিশোর বা নব্য যুবকের ঘন ঘন আগমন ঘটতে থাকলে, উঠতি বয়েসের মেয়েদের মায়েরা নিজেদের কন্যাদের  প্রণীত করতেন ছেলেটিকে ‘দাদা’ ‘দাদাভাই’ ইত্যাদি বলে ডাকতে; ভাইফোঁটা দেওয়া করিয়ে মায়েরা চেষ্টা করতেন দু তরফকে তফাৎ করে রাখতে । (মায়েদের ঐ প্রানান্তকর চেষ্টা সত্ত্বেও ভাইফোঁটা নেওয়া সেই ‘দাদা’ স্বামীতে রূপান্তরিত হওয়া আটকানো যায়নি।)—তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হাতের কাছেই আছে।] 

             জীবনের প্রথম ক’বছর মামার বাড়ির সংসারে বড় হয়ে ওঠার দরুণ আমার মনের মধ্যে দেওয়াল না উঠলেও চৌকাঠের ব্যাপার একটা ছিল।এই চৌকাঠগুলো বেড়িয়ে পড়ত নিত্যদিনের এমন বহু ছোটখাট ঘঘটনায়।পাকেচক্রে সেগুলি  কিন্তু আজকের মতো এতো গুরুত্বপর্ণ হয়ে চোখে পড়েনি। নিজেদের সংসারে নিজের গ্রহনযোগ্যতা প্রমান করার জন্যে নিজের কাছে সহজ মনে হয়েছিল বড়দের নির্দেশিত পথ বেয়ে চলা। তাই ‘ভালো ছেলে’ সুনাম বজায় রাখার জন্যে সেটাকে আমি অন্তত নিরাপদ বলে মেনে চলেছিলাম। ‘ভালো ছেলে’ হবার (বা সাজার) এই অভ্যেসটা বোধহয় উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া। এই বক্তব্যের সমর্থনে দাদুর ‘আমার কালের কথা’ বইটি থেকে একটা উদ্ধৃতি দিতে পারা যায়। “এমনি করেই একটি ধারাবাহিক অধঃপতনে যাচ্ছি বা গিয়েছি বা যাব এই দুর্নাম রটনাই আমাকে বোধ হয় সুনামে দিকে আকৃষ্ট করছিল।যত অপবাদ রটে ততোই আমি চেষ্টা করেছি সুবাদ সুখ্যাতি অর্জন করতে।” (তারাশঙ্করের স্মৃতিকথা,প্রথম খন্ড, নিউ বেঙ্গল প্রেঃ (প্রা) লিঃ ১৩৮৭, তারাশঙ্করের স্মৃতিকথা,প্রথম খন্ড, নিউ বেঙ্গল প্রেঃ (প্রা) লিঃ ১৩৮৭, প্রৃঃ ১৪১) আমার বা দাদুর জীবনের পরিবেশ পরিস্থিতি ও কালের তারতম্য ছিল। একটু আগে ছোট ভাইটির যে সব কর্মের বর্ণনা করা গেল সেগুলো অনেকগুলোই ব্যতিক্রমি—তাই অসমসাহসিক—তাই অসমর্থনযোগ্য। অতএব সেই পথ পরিত্যজ্য। তা হলে গ্রহণ বা অনুসরণযোগ্য কি ? “হাসতে মানা—কাশতে মানা—এই নিয়ে মোদের ভদ্রপনা”—অনন্ত এক নেতির বেড়াজাল, যা জেনে বুঝে পা ফেলতে হয়, নইলেই ‘ডিস্কোলি’(ডিস্কোয়ালিফায়েড)। ফলে ঐ সময় পর্যন্ত আমার ঘোরফেরা সবই ছিল সাধারণ ভাবে একটা ‘অল জেন্টস্‌ ওয়ার্ল্ড’এ। আর নিজের কোন দিদি বা বোন না থাকায় বড় হয়ে উঠার সেই পর্যায়ে এই ব্যাপারটায় হয়তো আমি সকলের চেয়ে একটু দূরে ছিটকে পড়েছিলাম।নিজের পারিপার্শিকতায় বেশ কয়েক জন বালিকা, কিশোরী, সদ্য যুবতীর উপস্থিতি সত্ত্বেও তাদের জগৎ ছিল স্বতন্ত্র, আমার স্বাতন্ত্রবোধ থেকে তাদের আমি এড়িয়েই চলতে চাইতাম। বয়ঃসন্ধির সেই আদি পর্বে বাইরের জগতেও আমার সমবয়সি কোনো মেয়েকে পাইনি, যার সঙ্গে স্বাভাবিক আদান প্রদান চালানো যায়,যা দিয়ে আপনা আপনিই কাউন্সেলিং হয়ে যায়। আর অনেকটা সময় কাটত গল্পের বই পড়ে। সেই জন্যেই হয়তো মেয়েদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অবচেতন ভাবেই, নিজের অস্বস্তি নিয়ে নিজেই বিড়ম্বিত থাকতাম, সচ্ছন্দ হতে পারতাম না। এরই মধ্যে ইতিউতি প্রেমের ঘটনা ঘটতে দেখে, শুনেও বড়রা ক্যামন একটা যেন দেখেও না দেখা, শুনেও না শোনার ভাব ফুটিয়ে রাখতেন; শব্দটাও কেমন যেন ছোটোদের মুখে অবাঞ্ছনীয়। বড়দের মহলের আশে পাশে ঘুরে ছোটো ভাইটি  ঐ সব সম্পর্কে অনেকানেক গুহ্য সংবাদ এনে বড় বড় চোখ করে অনুচ্চ গলায় পরিবেশন করতেন। আমার কেমন যেন মনে হতো ওগুলো অনধিকার চর্চা করা হয়ে যাচ্ছে। কারণ প্রেম তখন পড়াশুনোর মতো নিত্যকর্মের পরে নিজের অবসর সময়ের কল্পনা বিলাসও নয়। আর আমাদের বাড়ির পরিবেশে পড়াশুনোটাই নিত্যকর্ম, অবশ্য কর্তব্য, পারলে একমাত্র কর্তব্য; খেলাধুলো—সে অবসর পেলে করা যেতেও পারে, না করলেও কিছু ক্ষতি নেই। সেখানে প্রেম ?! এই পরিবেশে কি আর কি হয়—না পড়াশুনো না খেলাধুলো না প্রেম;  সব কিছুই একটা  ট্যারাব্যাঁকা অদ্ভূত উদ্ভট কিছু।সেই প্রেমে সুখ বোধের  প্রতাশা বোধটুকু বাদে বাকি সব কিছুই ছিল অস্পষ্ট আর নিষেধাকীর্ণ।  সেই সময়কার মনোভাব একটা কবিতায় ধরা পড়েছ,

“ কল্পনার তুরঙ্গে সওয়ার             কল্পনায় মেঘের পাহাড়ে—

যাত্রী এক জন্ম রোমান্টিক;

আর রোমান্টিকতা, সে কি ?          সে তো শুধু প্রচ্ছন্ন বিষন্নতা—

ভাদরের বৃষ্টিক্লান্ত সন্ধ্যায়,

বাতায়নের ওপারের জগতে        রচনা করতে চেয়েছে যাকে

কল্পনার তুলির টানে

বুকের কাছে ধরতে গিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে

দূরত্বের বিপুল ব্যাবধানে।”

        আজ পিছন ফিরে অন্তরের প্রান্ত সীমা পর্যন্ত যাচাই করে বলছি যে সেই কাল্পনিক প্রেমিকার শুধু মাত্র গায়ের রঙ নিয়ে কিছুটা স্পর্শকাতরতা ছিল। সংখ্যায় অধিক কালো মানুষদের দেশে এটা অস্বাভাবিক নয়, আর এই নিয়ে তাদের কিছু তির্যক মন্তব্য সে সময় খুব শোনা যেত, “কটা চামড়া দেখেই ভুলে গেলি ?  কি আছে ঐ টিন চাপা বিবর্ণ ঘাসের মতো রঙে?” মজার কথা এই যে ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁন্দ ক্যানে’- এর লেখকেরই বিপুল কমপ্লেক্স ছিল নিজের কালো রঙ নিয়ে। আমার আরোও প্রতাশিত ছিল যে প্রেমিকাটি দেখতে ভাল হবেন। কিন্তু সেই ভালোর কোনোও আলাদা আলাদা স্পেসিফিকেয়াশন যৌবনের অন্তকাল পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারিনি। ওগুলো বাদ দিয়ে বাকি শরীর কি শরীরী ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ঐ জাতীয় আগ্রহ বোধ করিনি। তাছাড়া ‘যখনকার যা তখনকার তা’—এই মহাবাক্যের ভবিষ্যৎ নির্দেশের দিকে চোখ মেলে রেখেছিলাম (তাই ও সব নিয়ে তখন মাথা ঘামানোর দরকার নেই বলে ভাবতাম) কিন্তু তখন যে সব নিয়ে ভাবা দরকার তা নিয়েও মাথা ঘামাতে পারিনি। তাই বলে কিন্তু কল্পনার বিলাস ছাড়িনি।  আবার কেন জানিনা ধরেই নিয়েছিলাম মেয়েরা যেন কোনো সুদূর জগতের অতি ‘নাজুক’ অপাপবিদ্ধ, দুস্প্রাপ্য প্রাণী, যাদের দেখা মেলে কিন্তু ছোঁয়া যায়না। এতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে রবীন্দ্র সঙ্গীত, যেখানে প্রেম আর পূজা একাকার। এতে মনের জটিলতায়  পড়েছিল আরেক পাক। যতোই স্বাভাবিক হতে চাইতাম ততোই বাধা হয়ে দাঁড়াত তাদের “ কুটিল কটাক্ষ শর,নিষ্ঠুরসুন্দর রঙ্গ, ইঙ্গিত ছন্দময় নীরব ভঙ্গি।” প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়টাকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আর হয়নি।ওই ‘যতই হাসি দিয়ে দহন করে ততই বাড়ে তৃষা প্রেমের তরে’-জাতীয় ব্যাপার আর কি ?   ‘চিত্রাঙ্গদা’র  মর্ম বুঝেছি চোখে দেখার অনেকপরে। শুধু মেয়েদের বলে নয়,  সব মানুষের বাইরেটা দেখে বিচার করতাম। রোমান্টিকতার ক্ষীণ পদপাতের পাশে পাশে বয়ঃসন্ধি শরীরকে ভেঙ্গে গড়ছিল। সাইকো-সোম্যাটিক এই ব্যাপারটাকে স্বয়ং শঙ্করাচার্য বলে গেছেন, “বালস্তাবৎ ক্রিড়াসক্ত, তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্ত”, আমি তো কোন ছাড়। এই দুই মেরুর টানে ধীরে ধীরে হয়ে যেতে থাকলাম দরকচা, আধাখ্যাচড়া। সে তুলনায় ছোটো ভাইটি ছিল অনেক স্বাভাবিক।

                                     ওদিকে অবনীন্দ্রনাথের ‘রাজকাহিনী’, বিভুতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’, দেব সাহিত্য কুটিরের অনুবাদ সিরিজের দৌলতে জোনাথন সুইফটের ‘গ্যালিভারস্‌ ট্রাভেলস’, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’, ওয়াল্টার স্কটের ‘আইভানহো’, ডানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’, জুল ভার্ণের ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড, টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ্‌স আন্ডার দ্যা সি’ ইত্যাদি আরো অনেক বই শুধু পড়তাম না, জলদস্যু, সমুদ্র অভিযান, গুপ্তধন উধারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম। বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু বানিয়ে নিতে বিশেষ চেষ্টা করতে হতোনা। একটুকুও বাড়িয়ে বলছিনা একবার শিলিগুড়ি বেড়াতে গিয়ে মামারবাড়ির বাগানে আবিষ্কার করলাম ফুট চারেক লম্বা একটা রেল লাইনের টুকরো। তাকে ঘিরে  পুরো রেল পরিবহনের মঞ্চ গড়ে নিতে একটুকুও অসুবিধা হয়নি। লিলিপুটদের মধ্য গ্যালিভার হয়ে পৌছে যেতাম অনায়াসে।পলায়নি এই মনোবৃত্তি নিয়ে পৌছে যাওয়া যেত সেই সব জগতে যেখানে আঘাতও নেই অবহেলাও নেই। বিরুদ্ধতা বিরূপতা তিক্ততাহীন সেই জগতের সুখ স্বপ্ন আমাকে উজিয়ে নিয়ে যেত সেখানে যেখানে কেউ কাউকে দাঁত খিঁচিয়ে নখ উঁচিয়ে তাড়া করেনা, কারণেও না অকারণে তো কথাই নেই। জগৎ আর জীবন সম্পর্কে এই রকম মধুরীময়, প্রশান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ঘুরে প্রত্যাঘাত হানতে শেখায় না। কিন্তু ঘুর ঘুর পথে আরোও আঘাত আরোও অবহেলার পাবার পথ প্রশস্ত করে। এখান ওখান থেকে টুকে আনা সদুক্তি কর্ণামৃত দিয়ে গড়ে উঠছিল এক জোড়াতালি দেওয়া বহু বর্ণিল এক জীবনবোধ—যাতে উচ্চালোকিত ছিল অনেক কিছুর সঙ্গে ‘জীবনের উদ্দেশ্যকে নেতি মূলক না’ করার  উপদেশ।আঘাত আর আক্রমণ যেখানে ঘন ঘন, ক্ষোভ বিরক্তি আবার ভালোলাগাও সেখানে আলো ছায়ার মত যেত আসত; আর বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে বিরূপতা বা তিক্ত মনোভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখা যেহেতু চলেনা, তাই রাখতাম না। সব কাজের, সব মানুষের মধ্যে ভাল খোঁজার চেষ্টা করা উচিত তাই করে গেছি দীর্ঘকাল। প্রেরণা যুগিয়েছিল এক ইজ্ঞিন ড্রাইভারের গল্প, যে সব কিছুর মধ্যে ভালো খুঁজে পেত। এ্যাক্‌সিডেন্টে তার একটি পা কাটা গেলে বন্ধুরা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলে ওর মধ্যে কি ভালো দেখতে পাচ্ছে ? সে বলেছিল,’কেন, এখন থেকে একটা জুতো কিনতে আর পালিশ করতে হবে একটাই।’

          ছোট ভাইটি ঐ বৃন্দাবন যাত্রার সুবাদে হাওড়ার স্টেশনে হারিয়ে আসে একটা ডাইরি। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে  দাদুর কাছে সরস্বতী প্রেস থেকে আসা ঐ ডাইরিটা সে সজ্ঞোপনে আত্মসাৎ করেছিল দাদুর মতো ডাইরি লেখার বাসনায়। আমাদের দু জনের কোন এক দৈরথের সুবাদে এই গোপন তথ্য কিন্তু অল্প কালের মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বামাল  সমেত তস্করকে দাদুর এজলাসে পেশ করা হয়। দাদু ওর সুন্দর হস্তাক্ষর দেখে ডাইরিটা ওকেই দিয়ে দেয়, কিছু প্রশংসা বাক্য লিখে, যার মধ্যে  লেখা  ছিল যে সে যেন বড় হয়ে দাদুর চেয়ে ভাল বই লিখে দাদুকে উপহার দেয়। এই সার্টিফিকেট জোটার পর তার অনুলিখনের ওপর ভরসা করে প্রকাশিত হয় আমাদের হাতে লেখা পত্রিকা ‘কচি ও কাচা।’ নামটা দিয়েছিল ছোড়দি, কাঞ্চনকুন্তলা। খাতার পাতা ছিঁড়ে ভাঁজ করে পকেট ডাইরি আকৃতির দশ বারো পাতার পত্রিকা,যার সম্পাদক আমি; ছোড়দি, আমি,বাচ্চু আর রঞ্জনকে নিয়ে লেখক চার জন। ইতিপূর্বে আমাদের জন্মের পরে, ১৯৫৫-৫৬ সাল নাগাদ বড় পিসতোতো দিদি, শকুন্তলার মূল উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ঘরোয়া’ বলে একটা পত্রিকার কয়েক সংখ্যা; যার মধ্যে দাদু আর ছোট পিসেমশাইয়েরও অবদান ছিল। কারণ অনুলেখকদের মধ্যে শিল্পকর্ম নিপুন কয়েক জন থাকায় আর অভিভাবকদের আনুকুল্যে ঐটি একটু মোটা আর্ট পেপার ও সেলোফিন পেপারে অলঙ্কৃত ও বাঁধানো ছিল। ওর কোন গ্রাহক ছিলনা, কারণ ওটা একেবারেই বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার কিন্তু দু জনকে আমাদের পত্রিকার গ্রাহক করেছিল বাচ্চু নিজে। প্রথম জন দাদুর মামাতো বোন পারুল পিসি, আর দ্বিতীয় জন আমাদের পাশের বাড়ির আরতিদি। গ্রাহকদের ডাক যোগে পত্রিকা পাঠানো হতো। সেটা ছিল ওর আরেক দফা আগ্রহের কারণ। এইবারে জুল ভার্ণের মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ডের ছায়ায় রঞ্জন লিখতে শুরু করে ‘অজানা দ্বীপ।’ ‘হলদে ডানা পাখির ছানা’ বলে একটা সুন্দর কবিতাও লিখেছিল সে, যার কয়েকটা লাইন ছিল, “হলদে ডানা পখির ছানা ডালিম গাছের ডালে, মিষ্টি শীতের দুপুর বেলা নাচছে তালে তালে; পায়ে দিয়েছে আলতা আবার রঙ মেখেছে গালে,ল্যাজটি তুলে নাচছে পাখী এই ডালে ওই ডালে’’। ছোড়দি লিখেছিল উপদেশাত্মক একটা ছড়া, যার শেষ দুটো লাইন ছিল, “এইখানেতেই বলে রাখি কচি ওগো কাঁচা; জীবনটাকে বিলিয়ে দেওয়াই আসল হলো বাঁচা।” বীরত্বব্যাঞ্জক রচনাদি পাঠে আমি তখন এতোই উদ্বুদ্ধ, সব গল্পগুলোকেই এতো ভালো লাগে যে আলাদা করে কোনও একটা বিষয়কে, কোনো একটা বিশেষ দিক ধরে চলতে ইচ্ছাই করেনা , সব রচনাই মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে দশ দিকে মন ছুটে যায়। আমাদের ঐ পত্রিকায় ফেঁদে বসতে গেলাম এ্যাডভেঞ্চয়ার কাম্‌ অভিযান কাম্‌  রহস্য উপন্যাস, যার শুরুটা হচ্ছে দারুণ নাটকীয় ভঙ্গিতে।ঐ নাটকীয়তা ছাড়া সে দিন আমার মাথায় স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা উপজীব্যই ছিলনা। ফলে লেখা আর এগোচ্ছে না দেখে, বার বার তাগাদা দিয়েও পরের পরের সংখ্যার কিস্তি না পেয়ে অনুলেখকটির কলম কয়েকটি মৃত্যু আর হত্যা কান্ড ঘটিয়ে উপন্যাসের যবনিকা পাত করে দিলেন। ‘কচি ও কাঁচা’ও আর বেশী দিন প্রকাশিত হয়ে কাচিকাঁচাদের মনঃস্তাপের কারণ ঘটায় নি।

     ১৯৬৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত হলো ভারত-পাকিস্থানের যুদ্ধ। এর কিছু দিন আগে থাকতেই আকাশবাণী থেকে ভেসে আসছিল কচ্ছের রাণ আর পাঞ্জাব-কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্থানী ‘অনুপ্রবেশকারী’দের কীর্তিকলাপ, খবরের কাগজে দেখেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত প্যাটন ট্যাঙ্কের চাকার দাগের ছবি। দেখতে দেখতে যুদ্ধ লেগে গেল। হিন্দু স্কুলের এক তলার বারান্দা ঘিরে উঠল ব্যাফেল ওয়াল, বাড়ির জানলার কাঁচে লাগানো হল কাপড়ের ফেট্টি আর আলোগুলোতে পড়ানো হলো ঠুলি।ঐ সময়ে কয়েক রাত্রে কারোও নাকি সাইরেনের বিপদ সঙ্কে্ত কানে এসেছিল, তাই বোমা পড়ার আশঙ্কায় এক তলায় অন্ধকারের মধ্যে কিছুক্ষণ করে কাটাতে হয়েছিল। দিনের বেলায় অবস্থা কিন্তু অন্য রকম, আমরা (ভারতীয় সেনা বাহিনী) ক্রমাগতই জিতছি, এগিয়ে যাচ্ছি, বেশ একটা টানটান উত্তেজনা চারি দিকে; এক সময় ইছাগিল খাল পার হয়ে লাহোরের কাছাকাছি পৌছে গেল ভারতীয় ফৌজ। চীনা আক্রমনের শোচনীয় অভিজ্ঞতার ক্ষতে এ যেন বহু আকাংখিত আত্মপ্রত্যয়ের বিলেপন। হাবিলদার আব্দুল হামিদ একা ছ’টা প্যাটন ট্যাঙ্ক ধংস করে নিহত হলে ‘পরমবীর চক্র’ দেওয়া হয়। মেজর ভাস্কর রায়চৌধুরীও অনুরূপ বীরত্ব দেখিয়ে ‘মহাবীর চক্র’ পেলেন। আমাদের নিজেদের দেশে বানানো ন্যাট বিমান দিয়ে ওদের ভিক্ষায় পাওয়া স্যাবার জেট  সাবাড় করলেন এক বাঙালী ফ্লাইট লেফ্‌টেন্যান্ট। আর সেনা প্রধান তো বাঙালী, জয়ন্ত চৌধুরী—চারি দিকে আমাদেরই তো জয়জয়াকার। পূজোর আগেই যুদ্ধ থেমে গেল। হবে না হবে না করে শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক ঢঙে হয়ে, সে বারের পূজো যেন বেশী আনন্দঘন হয়ে উঠেছিল।

      ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি ‘কাকলী’গানের স্কুলের পাশের মাঠে আমরা রবীন্দ্র জয়ন্তী আয়োজন করেছিলাম পাড়ায় পড়ায় চাঁদা তুলে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলার ব্যাপারে যেহেতু   বাড়ির নিষেধাজ্ঞা ছিল তাই সে সব সারতে হত সঙ্গোপনে। সেই অনুষ্টানে সভাপতি দাদু আর প্রধান অতিথি  শৈলদাদু নিজেদের ভাষন দিয়ে প্রস্থান করলে, বাচ্চু রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি লেখা পাঠ করে, যা  শৈলদাদুর দ্বারা বিপুল ভাবে সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়েছিল। এছাড়া যথারীতি নানা বয়সের বালক বালিকা আবৃত্তি করে ও গান শোনায়।  পাড়ার ‘স্যান্ডো’ চোখের চাপে লোহার রড ব্যাকানোর কসরৎ দেখালেন, ‘হাস্য কৌতুক’ থেকে ‘হাঁস চুরি’ নাটকটি অভিনীত হলো অভিনেতাদের স্ব-কপোল কল্পিত প্রচুর সংলাপ সংযোজন সহ। আর অনুষ্ঠান শুরু হবার কিছু আগে শৈলদাদুই আবিষ্কার করলেন যে আনুষ্ঠানের জন্যে বাচ্চুর হাতে লেখা আমন্ত্রণ পত্রগুলির তলায় লেখা হয়েছে ‘অনুপ্রবেশ পত্র।’ 

        ইতিমধ্যে হিন্দুস্কুলের মর্ণিং শেষ হয়ে গেল।আজকে পিছন ফিরে ভাবি যে ঐ মহামহিমন্বিত শিক্ষা নিকেতন সাদা চুনকাম করা চারটে দেওয়ালের সীমায় পাঠ্য বই গতানুগতিক ভাবে গিলিয়ে রুটিন মাফিক কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা নিয়ে গাদা গাদা ফেল করিয়ে করিয়ে প্রমোশন দিয়ে দিয়ে দিন গড়িয়ে  মাস পেরিয়ে বছর পর বছর পার করে দিনগত পাপক্ষয় করতে শিখিয়েছিল মাত্র। নিজের মতো করে ভাবতে, নতুন কিছু করতে, পথ ভাঙ্গতে সাহস যোগায়নি। কল্পনা যেখানে স্থানু, চিন্তা যেখানে  বিলাস, ত্রাস যেখানে সঙ্গি—সেখানে আর  যাই হোক মানুষ হওয়া হয়না। সত্যি করে যদি কিছু শেখা হয়ে থাকে তবে তা সহপাঠিদের সাহচর্যে। মর্ণিং সেকসনে ভয় পাবার মতো একজনই ছিলেন, টিচার-ইনচার্য, শৈলবাবু। পড়াতেন  ইংরেজি; পড়াতেন আর কি, পাঠ্যবই, ‘পিকক রিডার’টা পিটিয়ে পিটিয়ে দুরস্ত করাতেন। ডে-সেকসনে এসে দেখি সবাই প্রায় ঐ রকম। মারের কি বহর তাঁদের, কেউ একজনকে পেটান আধ্‌খানা পিরিয়ড ধরে, কেই আবার সারা পিরিয়ড ধরে পেটান অনেককে। অনিল রায় বলে এঁদের একজন ক্লাস সিক্সে আমাকে পাকড়ালেন সম্পত্তি ভাগের অঙ্ক নিয়ে। এতোদিন অঙ্কটা জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।বাড়িতেও তেমন গৃহ শিক্ষক  জোটেনি যিনি অঙ্কতে আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারেন। অনিলবাবু সে দিন যতোই প্রশ্ন করেন, আমি যত ঘাবড়ে যাই, আর ভুল বলতে থাকি, তিনি ততোই অবিশ্রান্ত ভাবে চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, নির্দয় ভাবে দুটো কান টানতে টানতে পিঠের ওপর কিল বর্ষণে ক্ষান্তি না দিয়ে  গর্জন করে চলেন। আমার একটার পর একটা ভুল ঠিক, ভুল ঠিক উত্তরের মধ্যে দিয়ে মারতে মারতে তিনি কিন্তু  আমার মুখ দিয়ে উগলিয়ে অঙ্কটা বোর্ডে কষে গেলেন। সেদিন রাত্রে মাথার যন্ত্রনায় বাড়িতে কিন্তু একটা পেন কিলার চাওয়ার ক্ষমতা হয়নি, আরোও তিরষ্কৃত হবার সম্ভাবনায়। আর ছোটো ভাইটা কিন্তু সব ঝগড়া ভুলে সেদিন অসহায় ভাবে শুশ্রষা করে চলেছিল। অঙ্ক না পারার দুঃখ বা শারীরিক যন্ত্রনার চেয়েও সেদিন বেশী হয়েছিল অপমান বোধ, যা আজও থেকে থেকে হানা দেয়। সে বছরে ওঁর হাতেই নিগৃহীত আরো কয়েক জনের কথা মনে করতে পারি, যারা এগুলো গায়েই মাখতনা। কিন্তু আমি যে আজোও ভুলতে পারিনি। মর্ষকামী মানসিকতা থেকে নির্যাতন করতে করতে উঁনি প্রায়ই বলতেন, “এগুলোর মাথায় আছে ষাঁড়ের গোবর,শ্রাদ্ধেই কেবল কাজে লাগে।” সত্যিই সারা বছরটা ধরে উঁনি আমাদের মাথার শ্রাদ্ধ করেছিলেন।  আজ প্রশ্ন জাগে যে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ কি প্রাণে একটি ক্লাস সিক্সে পড়া হাড়জিড়জিড়ে শরীরকে ঐ রকম ভাবে আঘাত করতে পারে ?  এদের ভিতরে কি নিদারুণ কোনোও যন্ত্রনা ছিল—যার থেকে ওরা ঐ রকম নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারতেন। ক্লাস সেভেনে পেলাম অনিল রায়ের প্রতিমূর্তি সুশীলবাবুকে, এঁনার নির্যাতনের তারিকা ছিল অন্য রকম। অপরাধী ছাত্রটিকে খাড়া দাঁড় করিয়ে মুন্ডুটা প্লাটফর্মের ওপর টিচারের টেবিলের তলায়  ঢুকিয়ে বেঁকানো পিঠে ক্রমাগত ডাস্টারের বাড়ি মারতেন। টাল সামলাতে না পেরে সে বেচারা যদি ভুলক্রমেও টেবিলটা ধরতো তাহলে ডাস্টারের বাড়ি পরত তার আঙুলের ওপর। সারা বছরটা ধরে দাদুর লাইব্রেরী থেকে বই হাতিয়ে ওঁকে পড়তে দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা জারি ছিল। ক্লাস এইটে পেলাম মৃণালবাবুকে। ক্লাস নাইনে স্ট্রীম্‌ ভাগ হবে তাই অঙ্কের ওপর জোর পড়ল অত্যাধিক; একেক দিন একটা বা দুটো প্রশ্নমালা হোমটাস্ক দেওয়া হতে থাকলো। অতো অঙ্ক একেক দিনে করার উপায় বা ক্ষমতা কোনোটাই আমাদের ছিল না। তাই স্কুলে পৌছে ইস্তক ওঁর পিরিয়ডের আগেই এক সহপঠীর খাতা থেকে টুকে ওঁকে দেখিয়ে পিঠ বাঁচাতাম। ক্লাসে এসে উনি কোনো একটা ধরনের অঙ্ক বুঝিয়ে, ক্লাস ওয়ার্ক দিয়ে পড়তেন হোমটাস্ক দেখতে। মৃণালবাবু হোমটাস্ক নিতেন সংখ্যা গুনে। ফলে খাতাটা হাতে ধরিয়ে দিতে যেটুকু দেরী, উনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফেরৎ দিতেন সই করেই। সেদিন আমি বাঁচলে কি হবে আরোও দু চারটে অভাগা মজুত থাকতো সব সময়েই, যারা পুরো হোমটাস্ক করেনি বা পারেনি, তাদের ওপর বর্ষিত হত সগর্জন কিল চড় থাপ্পড়; পিরিয়ডটা কাটত ভয়ে কাঁটা হয়ে। অঙ্কের সঙ্গে এই প্রবঞ্চনার ফল ভাল যে হয়নি তা বুঝেছি পরে।

        আর ছাত্র শাসনে এদের শিরোমণি ছিলেন কিংবদন্তি প্রমান রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত হেডমাস্টার, কানাইলাল মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর কীর্তি কানে শুনেছি, চাক্ষুস দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কারণ ১৯৬৬ সালে আমরা ডে-সেকসনে ওঠার মাস খানেক পরেই উঁনি অবসর গ্রহন করেন। ওঁনার জায়গায় যিনি এলেন তাঁর পদবী ‘প্রামানিক’ বলে হিন্দু স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, পাটুদাদু মজা করে জিজ্ঞাসা করতেন,“ তোমাদের ইস্কুলে তাহলে এখন চুল কাটা দাড়ি কামান –এই সব শেখান হচ্ছে বুঝি ?” ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ইস্কুলের ফল ভালো হয় নি। এর জন্যে উঁচু ক্লাসের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের দেখেছিলাম সত্যানন্দবাবুর ঘরের সামনে পোস্টার লাগাতে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে দাদু জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পেল, স্কুল কামাই হয় আমাদের ক’য়েক দিন। হেডস্যারের ঘর (প্রায় যমের দক্ষিণ দুয়োরে যাত্রা) এ ডাক পড়লে  ওঁর স্বাভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনুচ্চ শীতল গলায় একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তারাশঙ্করবাবু তো এক লক্ষ টাকা পেলেন, তোমরা সেই টাকার ভাগ পেতে পার, কিন্তু ওঁর জ্ঞানের ভাগ পাবে কি ?” এরপর ১৯৭০ সালে অবসর গ্রহন করার আগে অব্দি যতো বার ওঁর মুখোমুখি হতে হয়েছে ততো বারই দেখেছি নিয়মানুবর্তীতার শীতল কাঠিন্য।  শিক্ষণের নৈপুন্য, শেখার আনন্দ আর বিদ্যায় বিমুক্তির স্পর্শ মিলতে শুরু হলো আরোও কিছু দিন পর থেকে, বলতে গেলে ১৯৬৯ সাল থেকে।                                                                                                                                                                          

      তবে তার আগের চার পাঁচটা বছর যে শুধুই খারাপ কেটেছে তা ই বা বলি কি করে ? ইস্কুলের পরীক্ষায় বছর বছর পাসটা করে যেতাম ঠিকই। ব্যাস ঐ পর্যন্তই; আর ছাত্র হিসেবে অধ্যাবসায়হীন, পাঠ্য বিষয় বিশেষ করে অঙ্ক আর ইংরেজীতে আগ্রহহীন, পাঠ্য বর্হিভূত প্রায় সব বিষয়েই মনোযোগিদের সম্বন্ধে আলাদা করে কি বলার কিছু থাকে ? এই পর্যায়ের জীবনটা কেটে যাচ্ছিল আপনার গতিতে ভাল মন্দ মিশিয়ে।  

     এরই মধ্যে এল ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচন। এর আগে প্রায় প্রতি বছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী  মাসে দেখতাম রাজনৈতিক গন্ডগোলে স্কুল বন্ধ থাকত কিছু দিন করে। খাদ্যদ্রব্যের অভাব ঐ সময় আমাদেরও ছুঁয়ে যায়। এই সময় থেকেই সেই যে রাত্রে রুটি খাওয়া আরম্ভ হল আজোও তাই চলছে। রেশন ব্যাবস্থা, অতিথি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠতে থাকল। আর বাবা রেশন অফিসার হওয়ায় ঐগুলো নিয়ে সরকারী পর্যায়ে কত কড়াকড়ি চলছে তার প্রাথমিক খবর জুটতে লাগল রোজ। খাদ্যাভাব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন আর তখনকার কংগ্রেস দল যেমন কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হতে থাকল, বিরোধী দলগুলির শক্তি ও সমর্ন বেড়ে চলল ততোই। এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একদিনে চোদ্দটা ট্রাম পুড়ে ছাই হলো।  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতো ঘন ঘন। শ্রীনগরের হজরৎ বাল মসজিদ থেকে হজরৎ মহম্মদের পবিত্র চুল চুরি যাওয়াকে উপলক্ষ্য করে একবার দাঙ্গা হয়ে গেল। কিছুদিন পরেই একটি এন্‌সাইক্লোপিডিয়ায় হজরৎ মহম্মদের ছবি ছাপাকে কেন্দ্র করে আবার দাঙ্গায় উন্মত্ত হয়ে উঠল কোলকাতা। ভোটের আগে থেকে বিভিন্ন দলের প্রচার চলল বেশ কিছু দিন ধরে। সে সময় প্রচার বলতে বোঝাতো দেওয়ালে দেওয়ালে আলকাতরা অথবা খবরের কাগজের ওপর আলতা দিয়ে লেখা পোস্টার সাঁটা অথবা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে ‘ভোট দিন ভোট দিন’ বলতে বলতে যাওয়া। পোস্টারগুলোতে এখনকার মতো তখনও মজার মজার ছড়া লেখা হতো। যেমনঃ- “হাঃ, হাঃ, হাঃ –শুনলেও হাসি পায়,  কংগ্রেস আবার ভোট চায়” ; কিম্বা “চীনের চিহ্ন কাস্তে হাতুড়ি—পাকিস্থানের তারা, এর পরেও কি বলতে হবে দেশের শত্রু কারা।”  এখনকার মতো ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ভিডিয়ো কন্‌ফারেন্স দূরের কথা, ই-ভি-এম বা এপিক  ছিল স্বপ্নের অতীত। বাবা কাকাদের দেখলাম প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে ভোটের ডিউটি করতে যেতে। বারুদের স্তুপে আগুন লাগালো প্রফুল্ল সেনের কাচকলা খাওয়া কি সপ্তাহে একদিন উপোস করে থাকার উপদেশগুলি। ভোটে হারল কংগ্রেস,বিচ্ছিন্ন বিরোধীরা এক হয়ে তৈরি করল যুক্তফ্রন্ট। সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও আমরা ছিলাম সর্ব অর্থেই দর্শক, বাস্তবে নেবার মতো কোনোও ভূমিকাই ছিল না সে সময়ে। কিন্তু কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ যে কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তার প্রমান স্বরূপ হাজির করছি সেই সময় ইস্কুল থেকে সংগৃহীত আট থেকে দশ পাতার দীর্ঘ একটা কবিতার কয়েক পংতিঃ- 

“আরামবাগের হারামখানায় কাঁদছে বসে প্রফুল্ল,

অজয় নদের বেজায় স্রোতে ভাসে কানা অতুল্য।

“ভেবেছিল গেলই জিতে       হারল আটশো একাশিতে—–

আভাদিদি কেঁদে কয়   ঠেকিলাম একি দায়,

কোথা গেলে ও প্রফুল্ল   ছিলাম অতি উৎফুল্ল,

কাঁচাকলা দিয়েছিলে     তাও সাথে নিয়ে গেলে,

এখন কি হবে বল মোর উপায়।”

     –এই কটা লাইনের মধ্যে কিছু মানুষের সম্বন্ধে এমন কিছু উল্লেখ রয়েছে যা হয়তো শালীন নয়। তবে প্রামানিকতার স্বার্থে স্মৃতিতে যেমন পেলাম তেমনি উদ্ধৃত করা গেল। মনে পড়ছে ভোটের ফলাফলে মানুষের উল্লাস, দু-নম্বর বাসে করে স্কুল যাবার পথে পাইকপাড়ার মোড়ে এক দল লোককে বাসের ভিউ ফাইন্ডারে বেগুন আর কাঁচকলা বেঁধে দিতে দেখলাম। পরিবর্তন আসতে লাগল একের পর এক। সরকারী ভরতুকিতে মাসিক তিন টাকায় ইস্কুল থেকে বেশ ভালো টিফিন দিত। সেই খাতে টাকা হ্রাস হওয়ায় দিনের পর দিন টিফিনের মান নামতে নামতে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল।ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট এর ‘পরিষেবা’ (সে দিন এই শব্দটাই চালু হয়নি) দিনে দিনে ক্ষীয়মান হতে হতে এতোটাই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল যে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে ধীরেসুস্থে গিয়ে বাসের দো-তলায় নিশিন্ত সিট পাওয়াটা প্রথমে সম্ভাবনা থেকে ক্রমে ক্রমে সুদূরপরাহত হয়ে উঠতে লাগল। কোলকাতায় বেসরকারী বাস আবার ফিরে এল। তবে ভাড়া তখনও ছয় বা আট পয়সা, তাও আবার এবেলা ওবেলা বাড়ে না, আর বাড়লেও বাড়ে পাঁচ বা দশ পয়সা করে। স্বাধীনতা পূর্ব যুগ থেকে প্রচলিত আনেক পরিষেবা সঙ্কুচিত হতে থাকল; সকালে জল দিয়ে রাস্তা ধোয়া বন্ধ হয়ে যেতে লাগল, রাস্তা মেরামত করতে গিয়ে আগাগোড়া সারানোর বদলে শুরু হল তালি তাপ্পি মারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বানচাল হয়ে যেতে থাকল, সমাজ বিরোধীরা প্রকাশ্য ভাবে আত্মপ্রকাশ করার মতো অনুকূল পরিস্থিতি পেতে থাকল। অশ্রুতপূর্ব, অভাবনীয় অনেক কিছুই ঘটতে থাকল একের পর এক অথবা এক সঙ্গেই। এরপর থেকে প্রায় দশ বছর ব্যাপী এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পর্যায়ে পৌছে গেল পশ্চিমবঙ্গ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *