তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি…।

তিন যুগের ব্যবধানে বাংলার দূর্গাপূজার কিছু দৃশ্য নিয়ে লিখেছেন দীপঙ্কর সেন।

এক।

kolkata_dance

স্থান কলকাতা । সময় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে । ইংরেজ সরকারের উপাধি প্রাপ্ত রাজ বাড়ি। মহিষমর্দিনী-র আরাধনা । বাইরে ভেতরে উচ্ছ্বাস আনন্দ ব্যস্ততা । বাড়ির গিন্নিদের রাজকীয় পরিধান—লাল গরদের শাড়ি, লেশ দেওয়া ব্লাউজ, উপচে পড়া গয়নার জেল্লা  সে এক এলাহী ব্যাপার। ওদিকে ঠাকুরদালানে পুরোহিতদের ব্যস্ততা । বিশাল বিশাল ঠাকুরের বাসন, পেতলের পেল্লাই একশ আট প্রদীপ-দানি। পুরোহিত একজন নয় –  পুজারী, তন্ত্রধারক, চন্ডী পাঠে্র ব্রাহ্মণ, ভোগ রান্নার আলাদা ব্রাহ্মন আরও কতজন। বাড়ির প্রধান এবং প্রবীন গিন্নি সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন।

বাড়ির বৈঠকখানায় প্রচুর লোকজন। বাজার সরকার, প্রধান রাঁধুনি সবাই দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততায় ভরিয়ে তুলেছেন। পুজো ক’দিন দিনে রাত্রে প্রচুর লোকের খাওয়া দাওয়া চলবে। একদিকে ভিয়েন বসেছে। মায়ের ভোগ নৈবেদ্যর জায়গা আলাদা রাখা আছে।

মজলিশ ঘরের চেহারাটা আরও জমজমাট। এখানে ইংরেজ সাহেবদের জন্য বিশাল আয়োজন। সুরা, নর্তকী সব আয়োজন থাকছে। থাকছে একটা প্রতিযোগিতা কারা কতো খুশী করতে পারে ইংরেজ সাহেবদের।

একটা জিনিষ লক্ষ করার সাহেবদের নিয়ে এমন বেলাল্লাপনা ঘটলেও অন্দরমহলে তার এতটুকু আঁচ পৌঁছত না। মাতৃ আরাধনায় শাস্ত্রীয় বিধানের এতটুকু অন্যরকম হত না। মায়ের পুজো তিথি-নক্ষত্র-ক্ষণ মেনে,পুজোর তৈজসাদি কোথাও কোন ছন্দপতন মেলা ভার। বাড়ির পুরুষেরাও অন্দরমহলের এই পরিবেশে পুজোর সময়টুকু স্ত্রী-বিধানে পরিচালিত হতেন। মায়ের পুজোয় নিষ্ঠা ভক্তির কোন খামতি ছিল না।

দুই ।

durga-pujo-17b

স্থান পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার একটি গ্রাম । সময় বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে।   গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় মাটির দূর্গা মন্দির। ওপরে খড়ের চালা। গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবার এ পুজোর পৃষ্ঠপোষক। মন্দিরে মায়ের একচালা মূর্তি। সাজসজ্জার তেমন আড়ম্বর নেই। ভিতরে দুজন পুরোহিত। শাস্ত্রীয় বিধান কোথাও বিঘ্নিত হলেও ভক্তি সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। চাষি, জেলে, সবার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ বিরাজ করছে। এখানে অন্যদিন হয় না তবে অষ্টমী আর নবমী সবার পাত পেড়ে অনাড়ম্বর খাওয়া দাওয়া।মন্দিরে মায়ের সন্ধ্যা আরতি চলছে জেনারেটরের আলোতে। সারা গ্রাম জড়ো হয়েছে। ধুনুচি নাচ ঢাকের বোল শেষ হলে বসবে যাত্রা গানের আসর।

বছরের এ ক’টা দিন সারা গ্রাম জুড়ে উচ্ছ্বাস আনন্দ। নতুন না হোক গত বছরের তুলে রাখা শাড়িতে মায়ের কাছে আসা। মা নিজেও যেন ওদের মাঝে এসে দাঁড়াতেন পালা গান শুনতে। ছিল শ্রদ্ধা ভক্তির অনাড়ম্বর নিবেদন।

তিন।

themepujo

স্থান কোলকাতার কোন একটি অঞ্চল। বর্তমান সময়ের দূর্গা পুজো।

নতুন শব্দ – থিম পুজো। বাহারি প্যান্ডেল, শৈল্পিক এবং সু্ক্ষ্ম কারুকার্য্য, মননশীল  উপস্থাপনা, প্রতিমার রূপ মাধুর্য্য, আবহ সঙ্গীত  এককথায় বিস্ময়মাখানো স্বপ্নের দেশে পৌঁছে যাওয়া। জাগতিক নানা টানা পোড়েনের মাঝে একরাশ মুক্ত বাতাস। অন্য প্যান্ডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। পৃষ্ঠপোষক কোন রাজবাড়ি নয় বিভিন্ন কর্পোরেট হাঊস। তারাই ঠিক করে পুজোর বাতাবরন। ভেতর থেকে আনন্দ আসে না তারাই ঠিক করে, শিখিয়ে দেয় বলতে হ্যাপি সপ্তমী, হ্যাপি অষ্টমী……পুজো জুড়ে সেরা পুজোর প্রতিযোগিতা। সেরা মুর্তি, সেরা প্যান্ডেল, সেরা শ্রীময়ী, আরও কত কি।

মায়ের পুজো হয় । সৃষ্ট কৃষ্টির আনন্দে হাজির হয় সকলে। প্রতিযোগিতার আনন্দ, ট্রফির আনন্দ, কর্পোরেট নির্দেশিত আনন্দ। মানুষ ছুটে চলে- কি দেখছি কেন দেখছি নয়, দেখতে হবে। রাস্তাঘাট  থৈ থৈ করছে, সবাই পুজো দেখতে বেরিয়েছে। সব আছে, চোখ ধাঁধাঁনো আলো, ভিড় আছে, প্যান্ডেল আছে নেই শুধু মায়ের পুজোর নিষ্ঠা। আর এই নিষ্ঠা-ভক্তি নেই বলেই মা-ও আর প্যান্ডেলে থাকেন না হয়তো বেড়িয়ে পড়েন ঠাকুর দেখতে।

কর্পোরেট জগতের এমন সুন্দর হাতছানিতে শধু মনে মনে বলি, ‘মাগো তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি…’

One comment on “তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি…।
  1. abhijit sen says:

    what about durgapuja of other state of India.also include something on durgapuja of ramkrisnamath

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *