রোদ ঝলসানো পথে

                          

      ১৯৭১ সালের মহালয়ার দিন দশেক আগে দাদুর মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধশান্তি চুকতে চুকতে শুরু হয়ে যায় পূজো। স্বাভাবিক কারণেই সে বারের পূজো ছিল স্তিমিত, আজকের ভাষায় লো কি’তেবাঁধা।মহালয়ারসেই ভোরে মুজ্ঝ্যমান সুপ্তিমগ্ন পরিবারে একমাত্র আমিই ছাদের ঘরটিতে জেগেছিলাম আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান শুনতে।  পরবর্তী কালে শোনা আর তারও পরে বোঝা প্রাইভেট/ পারসোনাল স্পেস্‌ বিষয়টি আমার পরিপ্রেক্ষিতে খুব নিবিড় ভাবে জড়িত এই স্থানটি সম্পর্কে প্রযোজ্য। ছাদের সিঁড়ির বেয়ে ধেয়ে আসা বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচার জন্যে ১৯৬৫ সাল নাগাদ ছোট যে দশ ফুট লম্বা আর ফুট পাঁচেকের মত যে আচ্ছাদনটা বনে গিয়েছিল, সেটা হয়ে উঠেছিল আমার প্রথম যৌবনের উপবন। শীতগ্রীষ্মবর্ষা সারা দিনমান ওখানে পরে থাকতাম। প্রকৃতির প্রেমে বিভোর হয়ে থাকার ছিল চেয়ে বেশী ছিল নিজের একটযেন  একটা আস্তানা জুটেছ এমন ভাব। রাতের অন্ধকারে ছাদের গা ছমছমে পরিবেশে ভয় পাবার কাল তখন সদ্য শেষ হয়ে আসছে। ছাদের দিকর দরজাটা ছিল একেবারে রদ্দি। সহজে ছিটেকিনি লাগতনা বলে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হত। এখানে পড়তাম পাঠ্য-অপাঠ্য নির্বিচারে। সাহিত্য চর্চাও হত অল্পস্বল্প। মাঝে মাঝেই ছাদে টহল দিতাম—বসন্তের হাওয়ায়, গরমকালের সান্ধ্য বায়ে; ভরা চাঁদ এবং মরা চাঁদেও । পৈতেতে পাওয়া গায়ত্রী মন্ত্র আর পাঠ্যবই বা অন্যত্র সংগ্রহীত সংস্কৃত স্ত্রোত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল ঈশ্বর, পরলোক, জন্মান্তর সংক্রান্তভারতীয় বিশ্বতত্ত্বের সঙ্গে বস্তুবাদী যুক্তি সম্বৃদ্ধে শিক্ষাকে মেলাবার প্রাথমিক ভাবনা চিন্তা।বাড়ির ভাঙা চেয়ার টেবিল জুটিয়ে বানিয়েছিলাম নিজের স্টাডি। আর নিজের সেই লাইব্রেরীতে জমা করেছিলাম অন্য অনেক হাবিজাবি বই এর সঙ্গে সোভিয়েট বিপ্লবের অর্ধশত বছর উপলক্ষ্যে সে দেশের তরফে দাদুকে পাঠানো পকেট ডাইরির মত প্রচুর বই। ১৯৬৮ সাল নাগাদ কাকু সিউড়ি থেকে বদলি হয়ে আসাতে ঠাকুরঘর চলে এল এই জায়গাটায়; আমি স্থানচ্যুত হলাম বটে কিন্তু এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হল না। ১৯৭০এ ছাদ ছুঁইয়ে জল পড়ার জন্যে ঠাকুরদের নিয়ে দিদি একতলায় বড় বাথরুমের পাশে বাঁ দিকের শেষ ঘরটায় চলে আসতে বাধ্য হল।। আমি আবার জুটলাম গিয়ে ছাদের ঘরে। এইখানে থাকা কালে আমি পার্ট ওয়ান, পার্ট টু আর এম এ, পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়েছিলাম। 

   ১৯৭১ সালের শেষ দিক থেকে জোর কদমে হায়ার সেকেন্ডারির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। আর শুরু হল বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তিম পর্ব।পিছন ফিরে সে সময়কার ঘটনাগুলিকে মনে হচ্ছে যেন আগে থাকতে ছকে রাখা প্ল্যান অনুসারে পর পর হয়ে যাওয়া সিনেমার দৃশ্যের মত। পাকিস্থানের কিছু লোকের দ্বারা ইন্ডিয়ান ইয়ার লাইন্সের একটা এরোপ্লেন ছিনতাইকে উপলক্ষ্য করে ইন্দিরা গান্ধী অনেক আগেই পাকিস্থানের প্লেনগুলিকে ভারতের আকাশ পথ ব্যাবহার করা নিষিদ্ধ করে দেন। পশ্চিমবঙ্গে ঐ সময়ে চলছিল রাষ্ট্রপতির শাসন, ফলে এখানকার প্রশাসন সম্পূর্ণ ভাবে দিল্লীর নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদ্যেগে এখানে মানসিক বাতাবরণ যে উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল তাতে এই প্রদেশের গণতন্ত্রের হত্যা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিরোধিতা ছিল নিম্ন নাদে। অবশ্য ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। এত দিন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক হত্যা, পাড়া দখল, খোঁচর, সংশোধনবাদী, দলত্যাগী আর শ্রেণীশত্রু নিধনের জন্যে উন্মত্ত জিঘাংশায় এখানকার বন্ধু সহপাঠী পাড়ার ছেলেরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে পরস্পরের বুকে ছুড়ি মারছে, নলি কাটেছে, পাড়া ছাড়া দেশ ছাড়া হয়ে যাচ্ছিল–প্রবল রক্ত মোক্ষণ, দমন পীড়নের সামনে কলকাতাতে এই ব্যাপার কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করেছে। গোটা গরম কাল জুড়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে জনমত সংগঠনের চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। জুলাই-আগস্ট মাসে স্বা্ক্ষরিত হয় ভারত-সোভিয়েট রাশিয়ার প্রতিরক্ষা চুক্তি। অনেকের মনে হয়েছিল যে এর ফলে ভারতের বহু ঘোষিত জোট নিরপেক্ষ আদর্শ ভ্রষ্ট হল বুঝি । নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ব্রিগেডে আয়োজিত হল এক বিশাল জনসভা। গণমোহিনী বক্তৃতা দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লী রওনা দেন। তখন টি ভি ছিলনা—আকাশবাণীতেই একমাত্র তাৎক্ষণিক সংবাদ সরবরাহকারী। খবর শোনা গেল উত্তরপশ্চিম সীমান্তের বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকিস্থানের বিমান হানা দিয়েছে। রাত্রের অনুষ্ঠান শেষ হবার পরে বার বার ঘোষণা করা হতে থাকল যে ‘এক জরুরী সম্প্রসারণকে লিয়ে অপেক্ষা কিজিয়ে’—অবশেষে প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী জানালেন যে পাকিস্থান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতির দরুন জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে—ইত্যাদি ইত্যাদি। চালু হল নিষ্প্রদীপ, লাগু হল সান্ধ্য আইন। তারই মধ্যে চলল টেস্ট পরীক্ষা আর ভারতীয় সেনার জয়যাত্রা। শেষ পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকার পতন ঘটল। ছাদে উঠে আমারা বাজী ফাটানো আর গণ উল্লাস দেখলাম—জাতীয় বিজয়ের অংশীদার হয়ে।পরের দিন সংসদে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন। নিজের ব্যক্তি পূজার চালচিত্র রচনার উপকরণ হিসেবে তাঁর মুকুটে চড়ল আরেকটি পালক। কিন্তু তাঁর অন্য আরো পদক্ষেপের সঙ্গে এটিও ভারতের জন্যে কালাক্রমে যে বিষ ফলের জন্ম বহন করে এনেছে তা হচ্ছে পাকিস্থানের ‘ব্লিড ইন্ডিয়া হোয়াইট বাই এ থাউজেন্ড কাট্‌স।’ এই ঘটনার মারাত্মক ফল এখন আমরা ভোগ করে চলেছি। আরও কিছু কাল পরে জনৈক অধ্যাপকের কাছে শুনেছিলাম আরেকটি অভিনব ব্যাখ্যা। বাংলাদেশে ব্যাপারে ভারতের অত্যুৎসাহি উদ্যোগ নেবার কারণ হিসেবে উঁনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশে যদি দীর্ঘ দিন ধরে গণ সংগ্রাম চলতে দেওয়া হত তবে সেখানে কালক্রমে সশস্ত্র বিপ্লবী পরিস্থিতি গড়ে উঠত, যাকে আটকানোর কোন সুযোগ থাকত না। আর বাংলাদেশকে নিয়ে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। যাই হোক সে দিন কিন্তু মহিলাটির ক্যারিস্‌মা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

      টেস্ট পরীক্ষা চলল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ অব্দি—ডিসেম্বরের শেষের দিকে রেজাল্ট বেরল। স্কুলের শেষ পরীক্ষায় আমি নয় জন ছাত্রের ক্লাসে থার্ড হলাম। তারপর তিন মাসের গর্ভবাস—পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্ব। ১৯৭২ সালের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা সেবার প্রতিবারের মত মার্চ মাসে না হয়ে হলো এপ্রিলে। মায়ের অনুসৃত আচরণ বিধি অনুয়ায়ি আমাদের ওপর মায়ের খবরদারী নজরদারীর দিন হল অবসান। তখন পর্যন্ত জীবনের পরমাকাঙ্খিত গম্য—শিলিগুড়ি রওনা দিলাম দার্জিলিং মেলে মে মাসের ১৩ তারিখ। পরের ভাইটি কিন্তু সঙ্গী হয়নি। অন্য একটি ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হবার দরুন বোলপুর ষ্টেশনে প্রায় ন-ঘন্টা ট্রেন আটকে গেল। ফলে সকালের দিকে ফারাক্কা ব্যারেজ দেখতে দেখতে গঙ্গা পার হলাম। শুর হল বাকি জীবন জুড়ে এই কর্মকান্ডটির সঙ্গে মজার এক সখ্য। এর পর অন্তত বার পঁচিশেক গঙ্গা পার হয়েছি এই পথে ট্রেনে, বাসে, গাড়িতে, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। প্রতিবারই নিজের জায়গায় বসে অথবা দরজায় দাঁডিয়ে একে দু চোখ ভরে দেখতে দেখতে গেছি। পাঠ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে ফারাক্কা নিয়ে ভারত—বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাসে অনেককিছু পড়তে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু পরিণত কৈশোর আর প্রথম যৌবনের এই ভালোলাগার যেমন স্পষ্ট কারণ নেই, তেমনি এই বার বার শুভদৃষ্টির আকাঙ্ক্ষারও যেন শেষ নেই। যাইহোক সেবার আমি দু মাস মত জীবনের সবচেয়ে মুক্তবন্ধ,সচ্ছন্দ, নির্ভার দিন কাটিয়েছিলাম। বহু নিষেধাকীর্ণ আমাদের মত পরিবারের ১৮-১৯ বছরের একটি কিশোরের কাছে এটা হয়েছিল পরম এক প্রাপ্তি। সময়টা তখন সমাগত বর্ষার, উত্তরবঙ্গের বৃষ্টির কথা মা’র মুখে শুনেছিলাম বটে, নিজে দেখলাম মিথ্যে নয়। কখন কখনো এক নাগাড়ে তিন থেকে সাত দিন হয়ে চলেছে তো হয়েই চলেছে। ওখানকার লোকদের বলতে শুনলাম বন নিকেশ করার জন্যে বৃষ্টিপাত নাকি ভ্য়ঙ্কর কমে গেছে।  ভীত হলাম ভেবে এই যা দেখছি তাতেই কামাল, আগে না জানি কি ছিল ? এরই ফাঁকে ফাঁকে বেড়ানো ছিল পায়ে হেটে। মনে পড়ছে বৃষ্টি ধৌত এক বিকেলে মহানন্দা নদীর রোড ব্রিজ ছেড়ে তার পাশ দিয়ে প্রাতঃকৃত্যের পরিণতি সমাকীর্ণ নদীকূল বেয়ে সমন্তরাল রেল ব্রিজটির সামনে পৌঁছে তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে। সামনে পাহাড়ি স্রোতস্বনী নুড়ি—ছোটবড় পাথরের ওপর দিয়ে স্বচ্ছ শরীরে প্রবহমান, দুরে নীল হিমালয়ের আভাষ, সবুজ গাছপালা সমাকীর্ণ বসতির রেশ। রেলের এক কর্মীর ট্রান্সিস্টারে শুনলাম, “ আজি ওই আকাশ-‘পরে সুধায় ভরে আষাঢ-মেঘের ফাঁক, হৃদয়-মাঝে মধুর বাজে কী উৎসবের শাঁখ। ১৯৭২ সালে সিকিমের ভারত ভুক্তি ঘটেনি। মামামণি তখন চোগিয়ালের লিগাল এ্যাডভাইসার। নিজের কাজে মাঝে মাঝেই গ্যাংটক যেতে হয়। মেশোমশায়ের পরামর্শে সঙ্গে যাবার আবেদন করলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার সে আবেদন মঞ্জুর হল। সিকিমের রাজার অতিথি হিসেবে  তখন ওখানকার সবচেয়ে দামী হোটেল ‘নরখিল’এ এক রাত্রি বাস হল।

     

  জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কলকাতা ফিরলাম। দাদুর অনুপস্থিতে প্রথম ৮ই শ্রাবণ। ‘প্রতিশ্রতি’ বলে একটি লিটিল ম্যাগাজিনের তরফে সেবারের আয়োজন হয়েছিল। উদ্বোধন সঙ্গীত গেয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। ১৯শে আগস্ট রেজাল্ট বেরল। সঠিক অর্থে ১৮ই আগস্ট মাঝ রাত্রে খুড়তোতো ভাই রঞ্জনের সহপাঠী হিন্দু স্কুলেরই ছাত্র সিন্ডিকেট পাব্লিসার্সের বিপ্লব ভাওয়াল ফোন করে জানাল যে আমরা দু জনেই ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছি। পরের ভাইটি আর্টসে প্রথম এগারো থেকে কুড়ি জনের মধ্যে স্থান পেয়ে ন্যাশনাল স্কলার হয়েছিল। সে বছর সাড়ে তিন হাজার জন কলা বিভাগে প্রথম বিভাগে গিয়েছিল। সেই বিবেচনায় বিশাল কৃতিত্বের ঘটনা কিছু ঘটেনি। তবে সে বার পাড়াতে আরও কয়েকজন হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছিল—সকলেরই ফলাফল তেমন হয়নি। ফলে আশেপাশের মানুষজনের তাৎক্ষণিক ভাবে একটা সপ্রসংশ দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল।

      এই আমলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম সোপান এগারো ক্লাসের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঐ ফলাফলে নিঃসন্দেহে আনন্দিত হয়েছিলাম, আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম কিছু। কিন্তু নিজের ভেতরকার স্বভাব সিদ্ধ সতর্কতা আর সংযম ভেতর থেকে লাগাম টেনে রেখেছিল—দাঁড়িয়ে ছিল অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস, প্রগলভতা ও আত্মসন্তুষ্টির পথ রোধ করে। শিখেছিলাম ‘স্তরবনম্রা ফলাগমে।’ এক অত্মীয়ের ভাষায়,ভালো রেজাল্ট নতুন বউ এর মত, লোকে দু-চার দিন খোঁজ রাখে—তারপর দেখে সে ক্যামন করে কি কি করে ? বোধ হয়েছিল যে তখনকার পারিপার্শিতার মধ্যে ওই ফলাফলের দরুন যে পরিচয়টুকু গড়ে উঠেছে সেটা একান্তই তাৎক্ষনিক। প্রত্যাশা একটা সৃষ্টি হয়েছে যা উপর্যুপরি সুফল দেখিয়ে যেতে না পারলে মিলিয়ে যেতে বেশী দেরি হবেনা। দাদুর রেখে যাওয়া পরিচয়টুকু আমাদের ভিত্তি মাত্র,তাকে বজায় রাখতে গেলে নিজের পরিচয় নিজেকেই পরিশ্রম করে তৈরি করে নিতে হবে। আর সেই চেষ্টার মধ্যে দিয়েই নিজের ভিতরে গড়ে উঠল আরেক দফা জটিলতা আর টানাপড়েন।

    সেই টানাপোড়েনতার প্রথম ফল প্রসব করল কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসে আনার্সের জন্যে ভর্তি হবার পরীক্ষায় বসলাম, পাস করতে পারলাম না। পরীক্ষায় ছিল—একটা রচনা আরেকটা কম্প্রিহেনসন—দুটোই ইংরেজী মাধ্যমে। এত দিন পর্যন্ত ইংরেজীকে অবহেলা করার ফলে মোটেই সুবিধা করে উঠতে পারলাম না। ব্যার্থতাটা বড্ড কাঠিন হয়ে বাজল। এতটাই কঠিন যে পরবর্তী তিরিশবছরেও এই ব্যার্থতাকেভুলতে পারিনি। আজকে যত সহজে এই কথাগুলো লিখতে পারলাম, বছর দশেক আগেও তা প্রকাশ করতে সঙ্কুচিত হতাম। মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা হীনমন্যতার বোধ—শয়নে স্বপনে যা ভুলে থাকতে দেয়নি। মৌলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হলাম বটে কিন্তু মন পরে বইল কলেজ স্ট্রিটে। বইপাড়ায় নতুন বইয়ের দোকান, পুরনো বইয়ের স্টল, কফি হাউসের আড্ডা, লোকজনের ব্যাস্ততা, অনেক দিনের চেনা পরিচয় মনকে না টেনে পারেনা।

   এর পাশে নিজের কলেজে আকর্ষণ করার মতো বিশেষ কিছু চোখে পরত না। চারপাশের পরিবেশটা পড়াশুনোর মোটেই অনুকূল ছিল না। বই এর দোকান বলতে কয়েকটা রেসের বই আর সিনেমার ফোল্ডার জাতীয় গ্রন্থ বিক্রি হয়। শুধু গাড়ি সারানো, মোটর পার্টস, হার্ডোয়ার, ছবি বাঁধানো, ব্যাটারি বানানোর দোকান—সবগুলোই আলো—অন্ধকার,সাইনবোর্ডগুলোও ম্যাড়মেড়ে, ধুলিধূসরিত, ফুটপাতগুলো ভিখারিদের দখলে—হাইদ্রান্ট দিয়ে জল গড়িয়ে কলেজের মুখটা দুর্গম হয়ে আছে। ঐস্লামিক স্থাপত্যের অদলে গড়া কলেজ বিল্ডিংটি কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। তা হলে কি হবে—সর্বত্রই কেমন একটা নিঃঝুম বিষণ্ণতা। ছাত্র সংখ্যা নিশ্চই কম ছিল,না হলে গোটা বাড়িটা কেমন যেন শুনশান ফাঁকা ফাঁকা লাগত। লাইব্রেরীতে নতুন বই কমই পাওয়া যেত, অধিকাংশই পুরোনোসংস্করণের ঝুঝ্‌ঝুড়ে,পাতা কাটা, রিডিং রুমে পড়ার পরিবেশ নেই বিন্দুমাত্র, কিছু ছেলে সেখানে আড্ডা দেয়,গুলতানি মারে সারাক্ষণ, বারন করার জন্যে কেউ নেই। চূড়ান্ত হাস্যকর ব্যাপারটা ঘটলসেপ্টেম্বর মাসে সেসেন শুরু হবার মুহূর্তে। কো-এডুকেশন চালু সহ ওয়াটার কুলার ইত্যদি হাবিজাবি কিছু দাবি তুলে কলেজে স্ট্রাইক ডাকা হল—যার সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের কোনই সম্পর্ক নেই। যেখানেই যাই সেখানেই কোএডুকেশনের দাবীতে কলেজ বন্ধ জেনে সকলেই হাসাহাসি করে—শুনে অস্বস্তিতে পরি। পূজোর পর কলেজ যেদিন খুলল সেদিন সকাল থেকে অপেক্ষা করেও কোনও অধ্যাপকের দেখা মিলল না।  অনন্য উপায় হয়ে দেখা করলাম বিভাগীয় প্রধান রবি দাসের সঙ্গে। দাদার শিক্ষক, দাদাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। রোগা একহারা চেহারা,তাই যতটা না লম্বা তার থেকেও বেশী লম্বা লাগে, ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি পরিহিত, সর্বদাই মুখে স্নেহপূর্ণ সঙ্কুচিত একটা হাসি লেগে আছে। পরাতেন খুব আবেগ দিয়ে, কলেজ   হিস্ট্রি অনর্সের ক্লাসে ছাত্র মাত্র ন-জন। এর মধ্যে ছ-জন গ্রামের স্কুল থেকে আগত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তারা কেউ মানুষ খারাপ ছিল না। কিন্তু তাদের ভাবনা চিন্তা, রুচি ও লক্ষ্যের অগ্রাধিকার ছিল শহরবাসী আমাদের থেকে ভিন্ন। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আদান প্রদান ছিল, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। আর বাকি দু-জনের সঙ্গে আদান প্রদান চলতে থাকল ঠিকই, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বা অন্তরঙ্গতা তেমন জমল না। জমল না অনেকে কারণেই; তার দায়িত্ব কিছুটা আমার, আর কিছুটা ওদের সঙ্গে ওয়েভ লেন্থে না মেলার দরুন। আমার তখন শিরে সংক্রান্তি কেন, মাথায় বজ্রপাত বললে বোধহয় কম বলা হবে। প্রার্থিত কলেজে চান্স পাইনি। বুঝতে পেরে গেছি যে এবারের পড়াশুনো সবই ইংরেজীতে করতে হবে। চেষ্টা করছি ভাষাটাকে আয়ত্ব করতে, কিন্তু কি করে তা করবো তা ধরতেই পারছিনা। ওপরপরা হয়ে জ্ঞান দেবার জন্যে আশেপাশে ছিল অনেকেই, কিন্তু সঠিক রাস্তা খুঁজে পেতে তখনও অনেক দেরি। অন্ধের মত পথ হাতড়াচ্ছি।

       উনি থাকতেন আশুবাবুর বাজারের কাছে সরকারি আবাসনে। ১৯৭৩ সালে পূজোর পর বিজয়ার প্রনামের অছিলায় সাহস করে আমরা দু-জনে ঢুকে পড়লাম ওঁর ফ্ল্যাটে। উঁনি যে গান্ধীবাদী জানা ছিল, কিন্তু গান্ধীজির রচনাবলী যে একশ খন্ডের ওপর এবং উঁনি তা মোটামুটি পড়েছেন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নকশাল আমল তখন সদ্য বিগত, উঠতি বয়েসের অপরিপক্ক বুদ্ধিতে হিংসা বনাম অহিংসা, সুভাষচন্দ্র বনাম গান্ধী, ভারতীয় আদর্শ বনাম পশ্চিমী ধ্যান ধারণা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের বক্তব্যকে উনি তুচ্ছ ভেবে পাশ কাটান নি, নিজের আদর্শের মধ্যে থেকে সাধ্যমতো সংশোধন/মার্জিত করে দিতে চেষ্টা করেছিলেন আমাদের চিন্তা ভাবনাগুলোকে।

     এজেন্ট বলে প্রচার করাটা একটা মানসিক রোগের স্তরভুক্ত হয়ে  উঠেছিল অনেক দিন আগে থাকতেই। সেটা কেমন বোঝাতে দাদুকে লেখা একটা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক- কাজিপাড়া, উত্তর চন্দননগরের এ-পি-সি ক্লাবের সদস্যবৃন্দ—

১৪/০৩/৬৮ তারিখে প্রেরিত চিঠিতে লিখেছিলেন,

 “গ্রামের চিঠিতে কম্যুনিস্ট বিরোধিতা বিশ্বের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে যথেষ্ট লাভবান করে থাকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সি-আই-এ’র অর্থদপ্তর আপনার নামে মাসে মাসে কত টাকা বরাদ্দ করেছে তা যদিও আমাদের জানা নেই, তবু এটা সুনিশ্চিত,এই প্রতিক্রিয়াশীল গুপ্তচর সংস্থাকে সেবা করে শেষ জীবনে নিজের ও নিজের বংশধরদের আখের গুছিয়ে নিতে আপনার জুড়িদার বাংলাদেশে খুব কমই আছে।”

হায়রে, সেদিন সি-আই-এর টাকা যদি বা মিলতো তবে প্রায় এককভাবে দাদুর ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কিছু সুরাহা হতো। এর কিছু পরে লেখা অমিতাভ চৌধুরীর একটা ছড়া মুখে মুখে খুব ফিরত,

“হাঁড়ির মধ্যে সকল চালের একটি ভাত টিপিয়াই—

কোনটা দালাল সি আই এ’র বলতে পারে সি-পি-আই।”

ওদিকে হাঙ্গেরী, তিব্বত, চোকোস্লোভাকিয়ার ঘটনার জন্যে ব্যাখা ছিল ‘জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, বিপ্লবের বিরোধিতা, পার্টি বিরোধী কাজকর্ম’ ঠেকাতেই ঐসমস্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক পরিচালনাধীনে ঐ দেশগুলো দুর্দান্ত অগ্রগতি হচ্ছিল। দারিদ্র দূরীকরণ, স্বাক্ষরতা, উৎপাদন বৃদ্ধি, সুনিশ্চিত কর্ম নিযুক্তি, শিশু মৃত্যুর হার নিম্নমুখি, মূল্যস্তর অপরিবর্তীত, অবসর যাপনের সুবিস্তৃত ব্যবস্থা, দেহ ব্যবসার অবলুপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে সুবিস্তৃত তথ্য পরিসংখ্যান এঁদের মুখে মুখে ফিরত। এঁরা বুঝিয়ে দিতেন যে কেবল বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত পুরোনো সুবিধাভোগীরা মার্কিনী প্ররোচনায় ‘সমাজতান্ত্রিকরাষ্ট্রবিরোধীকার্যকলাপ’ ঠেকানোরজন্যেইরাশিয়াকেসৈন্যপাঠাতেবাধ্যহতেহয়েছে।অসুখহলেতিব্বতেরমানুষওষুধেরবদলেলামাদেরমলমুত্রখেতেঅভ্যস্তছিল।সেখানকাররমণীগণগর্ভেধারণকরেধন্য বোধকরত বুদ্ধের অবতার বলে পরিচিত লামাদের অবৈধ সন্তানদের । চীনের আধুনিক ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যবস্থা এ সব কিছুর অবসান ঘটিয়েছে। এঁদের অনেকে নিজেরা বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও এঁদের মুখে অহরহ শুনতে মিলত হাঁচতে কাশতে বিজ্ঞানের এই দোহাই পাড়া, যাকে এখন বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞনবাদীতা–যা এ যুগের অন্যতম মানসিক প্রতিবন্ধকতা, চারিত্রিক ব্যাধি।  এ এক ধরনের নিদান হাঁকার প্রবণতা। সমস্ত আলোচনার অন্তে বিজ্ঞানের এই তুরুপের তাস খেলে/চেলে। শেষ হাসিটা হাসতে চেষ্টা করা। আমার সমস্যা অরো এক কাঠি বেশি। ভাইটি বা পিসতুতো দাদার মতো ‘আমিমানিনা’ বলেঝেড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না। যেহেতু আমি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র নই, তাই  আমার কাছে বক্তব্যের মধ্যে ফাঁকটা ধরার এবং নির্দেশ করে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপযোগী তথ্য নেই। আবার যদি তত্ত্বার্থী আরেকটু বেশী জানতে আগ্রহী হয়ে আলোচনা চালাতে চাইলে সমস্যা দেখা দিত। প্রথমেই তথ্যভিজ্ঞ বন্ধুটি বা বয়জ্যেষ্ঠ বন্ধু স্থানীয় দাদাটি ধরে নিতেন আমি তাঁর পান্ডিত্যে বুঝি বা আস্থা রাখতে পারছিনা। তাই নানা দেশের নানান প্রসঙ্গের উপস্থাপনা করে হতবাক করে দিতেন। প্রায়শই তার অনেকটাই হতো আমার অজানা, আর সে অংশগুলোকে যাচাই করা ছিল প্রায় সাধ্যের অতীত। তবে হ্যাঁ, আমার জানা অংশের সঙ্গে ওঁদের দেওয়া তথ্য মিলে বিশ্বাসযোগ্য একটা ধারণা গড়ে উঠত। যেমনতিব্বত ভ্রমনকারী অনেকের লেখাতেই পূর্ব্বর্ণিত তথ্য জানাছিল। আমার পরের ভাইটি বা পিসতুতো দাদা বাবলুভাই-এর মতো আমি আগে থাকতে জগৎ আর জীবনের অনেক বিষয়েই একটা পরিষ্কার অবস্থান গ্রহন করে ফেলতে পারতাম না কোনো দিনই।তাৎক্ষণিক ভাবে কোনো সিদ্ধান্তে না পৌছে নিজের মতো সময় নিয়ে বিশ্লেষণের আতস কাচের তলায় বুঝতে চেষ্টা করলে খুব তাড়াতাড়ি খুব বেশি কিছু বোঝা হয়ে ওঠে না। মুখের ওপর মত পার্থক্য নির্দেশ করতে যাওয়া বা প্রতিবাদ করার কোন পথই খুঁজে পেতাম না। পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে মনে হতো উল্টো দিকে কত কথাই না বলা চলত। কিন্তু ততক্ষণে এ কথা সে কথার পর সেই চোখে আঙুল দাদাটি  ‘মাঅতিপ্রক্ষিগার্গী’রভঙ্গীতেবলেচলতেন, “এগুলোবৈজ্ঞানিকসত্য—ওমুকরসায়নবিদএটাএইভাবেদেখিয়েছেন;তমুক পদার্থবিদ সেটাকে ঐ ভাবে সমর্থন করেছেন। এর থেকেও আরোও অগ্রসর হতে চাইলে মুখের ওপর মর্মছেদী শব্দে ব্যক্তিগত আক্রমন/সাত গুষ্টি উদ্ধার করা হয়ে যেত। অনুপুঙ্খ ভাবে মনে করতে পারি ক্লাস ইলেভেনে পড়তে বাংলার সুদক্ষ শিক্ষক প্রফুল্ল সমাদ্দারের সঙ্গে  এমনই আদান প্রদানের একটি ঘটনার কথা। এমনিতে বেশ হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, ব্যবহারও বেশ ভাল করতেন। একদিন ক্লাসের বাইরে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটানিয়েআলোচনারসুত্রেজমিদার-প্রজাসম্পর্কিতপ্রসঙ্গেউনিপ্রজারকাছেজমিদারদেরঋণেরব্যাপারেবলতেবলতেরবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। বেশী পান্ডিত্য দেখাতে আমি রবীন্দ্র রচনার মধ্যে পড়া পুরোনো জমিদারদের প্রজা কল্যাণমূলক পদক্ষেপের প্রসঙ্গ তুলতে, উঁনি মন্তব্য করেছিলেন যে আমি এই রকমই তো বলব, কারণ আমাদের যে জমিদারির রক্ত। জমিদারি রক্তের ঋণ আমার ‘দাদুলিখেকিছুটাশোধকরতেপেরেছে।’

    এর কিছু কাল পরে পিকিং (বর্তমান বেইজিং) থেকে বৈদেশিক ভাষায় প্রকাশন সংস্থার দুর্দান্ত গেট আপের বেশ কিছু বই হাতে এসেছিল।  তাতে সাম্যবাদী চীনের নিজের অতীত ব্যাখায় ধরা পড়েছিল ইতিহাসের আরেকটা দৃষ্টিকোণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *