আড়ালে আড়ালে ৷

খুব ছোটবেলা মানে প্রায় প্রাককৈশোর থেকেই আমার গল্পের বই পড়ার নেশা ৷ আর ঐ একটা নেশাই আমাকে আজও নেশাগ্রস্থ করে রেখেছে ৷ মনে পড়ছে, তখন সম্ভবত ক্লাশ ফোরে পড়ি ৷ তখন আমার সঙ্গে আলাপ দীপক চ্যাটার্জীর ৷ স্বপনকুমার নামে এক ভদ্রলোক লিখতেন এই গোয়েন্দা গল্প ৷ দীপক চ্যাটার্জীকে কোনওদিন গুলি করলেও ও মরতো না ৷ কারণ যারাই গুলী করত, তারা বেছে বেছে বুকের বাঁদিকেই গুলী করত ৷ আর ঐ দিকেই থাকত তার স্টীলের সিগারেট কেস ৷ ফলে গুলীটা ছিটকে পড়ে যেত ৷ এই দীপকের সহকারী ছিল রতনলাল ৷ তার পদবী কোনও দিন জানতে পারিনি ৷ আর আজ এই পরিণত বয়সে এসে মনে হল, জানাটা জরুরি ছিল ৷ কিন্ত বাজারে এখন আর স্বপনকুমারের নতুন বই মেলে না ৷ এরপরে পূজোসংখ্যায় এসেছিল ঘনাদা ৷ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা ৷ এই ঘনাদার নাম যে ঘনশ্যাম দাশ, মানে ” দাশ ” বানানটা দেখুন, শেষে “শ” আছে ৷ আর তাঁর চার বন্ধু ৷ আর আছে চাকর ৷ ঘনাদার যে চার বন্ধু, তাঁদের নাম হল, গৌর,শিবু,শিশির আর আমি মানে সুধীর ৷এঁরা কিন্ত যে সে লোক নন ৷ গৌর হলেন গৌরাঙ্গ প্রসাদ বসু ৷ ইনি প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার ৷ আর শিবু তো আরও বিখ্যাত ৷ অদ্বিতীয় শিবরাম চক্রবর্তী ৷ শিশির হলেন তৎকালীন এক চলচ্চিত্র প্রযোজক, শিশির কুমার মিত্র আর সবশেষে সুধীর হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজে ৷ তাঁর ডাক নাম ছিল সুধীর ৷ প্রেমেন বাবুর সৃষ্ট যে গোয়েন্দা, নাম পরাশর বর্মা ৷ আর এঁর সহকারীর নাম কৃত্তিবাস ভদ্র ৷ 
ঘনাদার পরেই যাঁর নাম মনে পড়ে, তিনি হলেন, টেনিদা ৷ অধ্যাপক  ডঃ তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনন্য সৃষ্টি ৷ হ্যাঁ, এই তারকনাথই হলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বা নারাণ গাঙ্গুলী ৷ এনার চরিত্র টেনিদা গড়ের মাঠে গোরা ঠ্যাঙাতো ৷ নাম শ্রী ভজহরি মুখার্জী ৷ আর সঙ্গীরা হল, ক্যাবলা , হাবুল আর প্যালা ৷ঐ ক্যাবলা একটু লেখাপড়ায় ভাল ৷ তার আসল নাম কুশল মিত্র ৷ হাবুলের নাম অনেকে বলেন হাবুল সেন ৷ তা নয় ৷ ওর নাম স্বর্ণেন্দু সেন ৷ আর প্যালারামের ভাল নাম  কমলেশ ব্যানার্জী ৷ 

Feluda - Wikipedia

আরও এক দাদা বাকি রয়ে গেলেন ৷ ঠিক ধরেছেন, ফেলুদা ৷ ফেলুদার ভাল নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ৷ প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার ৷ তার সহকারী ফেলুদারই খুড়তুতো  ভাই, শ্রী তপেশ রঞ্জন মিত্র ৷ সঙ্গে জটায়ু নামধারী লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ৷ তবে দাদা নয় বলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বঙ্গ সমাজকে কাঁপিয়ে চলেছেন, শ্রী ব্যোমকেশ বকশী , এঁর কথা ভোলা যাবে না ৷ শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় তৈরী করেছেন আর্থার কোনান ডয়েলের আদলে ব্যোমকেশ কে ৷ তার সহকারী হলেন অজিত বন্দোপাধ্যায় ৷ আমরা দেখতে পাই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র পিন্ডি দা কে ৷ প্রদীপ নারায়ণ  দত্ত বা PND থেকেই পিন্ডির উদ্ভব ৷ নীহার রঞ্জন গুপ্তর কিরীটী রায় এবং তার সহযোগী সুব্রত রায়ও বর্তমানে বেশ অনালোচিত ৷ কিন্ত একসময়ে কালোভ্রমরের গুঞ্জন যথেষ্ঠই শোনা যেত ৷ আর এক নারায়ণ হলেন, নারায়ণ স্যানাল ৷ নারায়ণ স্যানালের কাঁটা সিরিজ খুবই বিখ্যাত ৷ মাছের, উলের,অ আ ক খুনের, সারমেয় গেন্ডুকের, কুলের, সোনার এবং পথের কাঁটা ৷ আরও হয়ত আছে ৷ মনে পড়ছে না ৷ এই কাঁটা সিরিজের যে রহস্যভেদী, তাঁর নাম মিস্টার পি কে বাসু, বার এট ল ৷ ইনি আবার ক্রিমিনাল সাইড ব্যারিষ্টার এ কে রে র জুনিয়র ৷ এই এ কে রে হলেন ফৌজদারী মামলার এক অপ্রতিরোধ্য উকিল ৷ নারায়ণ স্যানাল এই চরিত্রগুলি ভেবেছিলেন স্ট্যানলী গার্ডেনারের প্যারী ম্যাসন এর মত করে ৷ রহস্য উন্মোচিত হত আদালতে ৷ কৌশিক আর সুজাতা হল পি কে বাসুর সহকারী ৷  বিমল করের কি কি রা কে মনে পড়ে ? এই কি কি রা হলেন, কিঙ্কর কিশোর রায় ৷ সহকারী হল চন্দন বা চাঁদু ৷সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যেমন এনেছিলেন কর্নেল নীলাদ্রী সরকারকে ৷ সহকারী জয়ন্ত ৷ এই জয়ন্ত নামটা খুবই পছন্দসই দেখছি গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে ৷ হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অমর সৃষ্টি জয়ন্ত, মাণিক আর সুন্দর বাবু ৷ এদের পদবী কি তা জানিনা ৷ যেমন বিমল আর কুমার ৷ সমরেশ বসু ছোটদের জন্য তৈরী করেছিলেন, গোগোল ৷ ওর ভাল নাম উদয় কুমার চ্যাটার্জী ৷ আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র হল, কাকাবাবু, নাম রাজা রায়চৌধুরী ৷ সহকারী ভাইপো সন্তূ ৷ ভাল নাম সুনন্দ রায়চৌধুরী ৷ আরও একজন বাদ পড়ে গেছে, শবর ৷ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর শবর দাশগুপ্ত ৷ গোয়েন্দা, লালবাজার ৷ সহকর্মী নন্দলাল ৷ যে কিনা জগবন্ধু ইস্কুলের ছাত্র ৷ রীণ উপন্যাসে শবরের নাম প্রথম পাওয়া গেল ৷  বুদ্ধদেব গুহ রিজু বোস কে দেখার জন্য আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যান ৷ সঙ্গে তিতির, রুদ্র আর ভটকাই ৷ মেয়ে গোয়েন্দার নাম পেয়েছি মোটে দূজনের ৷ এক প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কৃষ্ণা এবং সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যের মিতিন মাসী ৷

এই মিতিনের ভাল নাম হল প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় ৷ ঢাকুরিয়াতেই থাকেন ৷ পালাবার পথ নেই উপন্যাসে প্রথম আগমন ৷এবার লেখাটা শেষ করি ৷ আর এক নারায়ণকে দিয়ে ৷ ইনি নারায়ণ দেবনাথ ৷ বাঁটুল দি গ্রেট যাঁর অমর সৃষ্টী ৷ এই বাঁটুলের আসল নাম হল হরিপদ রায় ৷ বাঁটুলকে উড়িয়ে দেবার জন্য এক বিস্ফোরক বোঝাই পার্সেল এসেছিল হরিপদ রায়ের নামে ৷ তখনই জানা গেল যে বাঁটুলের ভাল নাম হরিপদ রায় ৷ হাঁদা ভোঁদার ভাল নামটা একটা জানি, অন্যটা জানি না ৷ হাঁদারাম পাকড়াশী হল হাঁদার ভাল নাম ৷ ভোঁদার নামটা জানি না ৷ তবে ওদের পিসেমশাই এর নাম হল, বেচারাম বকশী ৷ তেমনি নন্টে ফন্টে তে হোস্টেল সুপারের নাম পাতিরাম হাতি ৷ আর কেল্টুদার পুরো নাম কেল্টুরাম শর্মা ৷ 
এই হল আড়ালে আড়ালে থাকা চরিত্রগুলির আসল নাম ৷ আপনারও নিশ্চয় জানা আছে কয়েকটা ৷ বলে দিন না ৷ 

–সমগ্র রচনাটি লিখেছেন শ্রী গৌতমরঞ্জন বসু ৷৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *