-আমার খেলা যখন ছিল–

জ্ঞানপীঠ পুরস্কার নিচ্ছেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখক – ডঃ অমলশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ( তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র)

    

      জ্ঞান হয়ে থেকে পরিবারটির ভরকেন্দ্র হিসেবে অনেক দিন পর্যন্ত দাদুকেই দেখে এসেছি।তবে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরে দাদুর মৃত্যুর সময় আমার বয়স হয়েছিল আঠার বছর। ঐ রকম একটা মানুষকে মোটামুটি জানা বোঝার পক্ষে সময়টা একেবারে অকিঞ্চিৎকর নয়। তবে কি দাদুর জীবিত কালে কিছুটা নিজের দৈনন্দিন পথ চলার ঝোঁকে আর বাকিটা ঐ মানুষটির ব্যক্তিত্বে আছন্ন থাকার দরুন ওঁর সম্বন্ধে সচেতন ভাবে কোন মতামত গড়ে তোলার সুযোগ তখন ঘটেনি। এরপর আরও চল্লিটা বছর কেটে গেলেও নানান অনুকূল প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যে বোধ গড়ে উঠেছে তা এক কথায় প্রকাশ করা কঠিন। সেই সময়ে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে আজকে যা বোধ হচ্ছেতাই উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছি মাত্র।

     কিন্তু দাদুর কথায় যাবার আগে তাঁর মা অর্থাৎ আমাদের বড়মা’র কথা কিছু বলে নেওয়াযায়। নিজের মা, প্রভাবতী দেবীর প্রশংসায় তাঁর পুত্র এতটাই পঞ্চমুখ যে আমার বলার বাকি কিছুই রাখেনি। তবু প্রপৌত্র হবার সুবাদে আমার স্মৃতির দু এক টুকরো হাজির করছি। দোর্দন্ড যে সব শাসকদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতাম তার মধ্যে বড়মাকে নিয়েই আজো কোনো বিরূপ স্মৃতি জাগ্রত নেই। কলকাতায় থাকলে রাত্রে ওঁর কাছে শুতে পারাটা ছিল বেশ আগ্রহের ব্যাপার, কারণ সুন্দর সুন্দর গল্প শোনার সুযোগ ঘটে যেত। রামায়ন মহাভারতের নানা কাহিনী উপ কাহিনী, রাজা মিন্‌কোহারা, সবুর্‌কর রাজকন্যা কি আট্টাপান বাট্টা সুপারীর কাহিনী ছিল কি সুখশ্রাব্য !! ঐ সব কাহিনীর দু চারটে মণিমুক্তো হলোঃ-

   “পহেলা প্রহরমে সব কোই জাগে, দুসরা প্রহর মে ভোগী; তিসরা প্রহরমে তস্কর জাগে, চহুথা প্রহর মে যোগী।’’ কিম্বা ডাল মুখে টিয়াপাখী্টির গল্প যেখানে  পাখিটার মুখ থেকে ডাল পড়ে গেছে একটা বাঁশ ঝাড়ে। সে একাদিক্রমে বর্হি (ছুঁতোর) তারপর রাজা, রাণী, সাপ, লাঠি, আগুন, সমুদ্রকে অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত হাতিকে  দলে পেয়ে বলছে, “হাঁথি হাঁথি সমুন্দর শুশো, সমুন্দর না ভার বুতাবে, ভার না লৌড়ি জ্বালে, লৌড়ি না সর্পে পিটে, সর্পে না রাণী দংশে, রাণী না রাজ বুঝাবে, রাজা না বর্হি দন্ডে, বর্হি না কিল্লা ফারে, কিল্লা মে মোর দাল বা, কা খাঁউ-কা পিঁউ, কা লে কে পর দেশ যাঁউ।’’ওঁর মুখে টম কাকার কুটির শুনেছিলাম জ্যোৎস্নার আলোয় প্লাবিত নির্বাপিত দীপ ঘরে সব দাদা দিদি ভাই বোন পরিবৃত হয়ে সম্ভবত ১৯৫৮-৫৯ সালে। এর থেকে মনে হয় যে বড়মা অনুবাদের সুত্রে বিদেশী সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচিত ছিল।যে বার রথের সময়ে থাকত সে বার রথ কিনে দেবার জন্যে স্পন্সরের অভাব হতো না।গুরুজনদের ঘন ঘন শাসন ও শাস্তির তীব্রতা ওঁর উপস্থিতিতে কিছুটা শিথিল হতো।

   পুরনো স্মৃতির পুনর্মূলায়ন করতে করতে যে বোধটা বার বার ভেসে উঠেছে মনের ওপর দিকে তা হল পৌত্রের যোগ্যতায়, আশে পাশে ঘোরা ফেরা থাকার সুবাদে অনেক ঘটনাই মনে ভীড় করে আসছে—যার অনেকটাই একরঙা দৈনন্দিনতায় ছাওয়া,সর্ব সাধারণের সামনের পরিবেশন যোগ্য অল্পই। তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বা বা রাজনেতিক জীবনবোধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্র এটা নয়। পরিবেশন যোগ্য হচ্ছে পৌত্র হিসেবে পিতামহের মূল্যায়নের তর্পণ। এর অনেকটাই বৃহৎ এক যৌথ পরিবারের বহু দায়িত্বে নুব্জ অসহায় বৃদ্ধের কাহিনী। আত্মজ ও আত্নীয় পরিজনদের নিয়ে বসবাস করার জন্যে দাদু টালার বাড়ী বানিয়ে ছিল সাধ্যের বাইরে গিয়ে। ফলে এল. আই. সি.’র কাছে জমির দলিল বন্ধক রেখে ধার নিতে হয়েছিল। কিন্তু ঐ পরিবার প্রতিপালনের জন্যে ১৯৬৭ সালে জ্ঞানপীঠের টাকা পাওয়ার আগে অব্দি সে ধার আর শোধ করা যায়নি। ঐ ঋণের কিস্তি দেওয়া নিয়ে বাড়ীতে অশান্তি হতো, থেকে থেকেই বাবা দাদুর হাতে যৎপরোনাস্তি তিরস্কৃত হতো নিয়মিত। খামখেয়ালিপনা হয়তো কিছু ছিল, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হবার কোন সুযোগই ছিল না। কারণ বৃহৎ একটি সংসারের অন্ন সংস্থানের স্বেচ্ছারোপিত দায় মাথায় ছিল তাঁর।আর সে অন্নসত্রে আমরা কেউ অনাহুত ছিলাম না। সহজ অধিকারেই সেখানে পাত পাতা চলত। আমাদের বাবা গেজেটেড পদের হলেও সাধারণ সরকারী কর্মচারী ছিলেন। আর সরকারী চাকুরেদের মাইনে খুব আকর্ষণীয় ছিল না। তাই জীবনে যদি আজ কোথাও এসে পৌছে থাকি তবে সেটা পিতামহের করুণায়।  এমনি  কর্তব্য জর্জর কোন মুহূর্তে মানুষটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কিছু কথা। এই সুত্রে সেই বেদনবহ প্রসঙ্গের উল্লেখ করা যায়। ঐ রকম একটি বৃহৎ পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাঁকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে দেখেছি, সব সময় খুশি মনে নিশ্চই নয়।ফলে জীবনের শেষ দিকে একটা কথা ঘুরে ফিরে বলতে শুনতাম,’’ভাই, তোমরা সব কাকের মত হাঁ করে বসে আছ, কখন আমি খাবার এনে তোমাদের মুখে তুলে দোব। সে জন্যে এই বয়সে আমাকে অনেক আবর্জনা সৃষ্টি করতে হয়েছে। আমার মৃত্যুর পর এ দেশের পণ্ডিত ব্যক্তিরা মিলে ঠিক করবেন কোন লেখাগুলো থাকা উচিত আর কোনগুলো নয়। যেগুলো অমনোনিত হবে সেগুলো যেন নিঃশেষে ফেলে দেওয়া হয়।’’এমনি ঐ পরিশ্রমের কথায় মনে পড়ছে যে দাদু বার বার বলত যে,’ছাত্ররা যেমন রোজ সকলে উঠে পড়তে বসে, আমিও তেমনি রোজ সকালে উঠে লিখতে বসি।‘আমাদের পারিবারিক পরিমন্ডলে এটাকে একটা লক্ষ্য মাত্রা হিসেবে নির্দেশ করা হয়ে থাকে। আজও তাই কোন কারণে সকালে উঠে এই নিত্যকর্মটির অনুবর্তন না করতে পারলে অপরাধ বোধ লাগে বৈকি।

     শুধু অন্নদাতাই নয়, ভয়ত্রাতাও ছিলেন বটে। আমাদের মেজদা দিব্যশঙ্কর একবার এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে পড়ে আঘাত পেয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠে বলে ওঠে, “ওগো, তোমরা আমাকে তারাশঙ্করের কাছে নিয়ে চল। শিশুর অসন্দিগ্ধ মনে মায়ের চেয়েও বেশী নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়েছিল দাদুকেই। সত্যিই দাদু ছিল এমনি এক বটবৃক্ষের মতো, যার আশ্রয়ে আমরা ছিলাম নির্ভয়, র্নিভার। ছোটবেলায় মা বা দাদাদের হাতে অন্যায্য ভাবে নির্যাতিত হয়েছি বলে মনে হলে, কখনো সখনো একটু  সরবে কাঁদতে কাঁদতে যাত্রা করতাম দাদুর লেখার ঘরের উদ্দেশ্যে, অথবা কাঁদার মাত্রা বা সময়টা একটু বিলম্বিত হতো। জানা ছিল যে দাদু মধ্যস্থতা করতে আসতেও পারে। অনেক সময়েই দাদু কাজ ছেড়ে উঠে এসে জিজ্ঞাসা করতো, “কি হয়েছে, কাঁদছ কেন ভাই ? কে মেরেছে ? ইত্যাদি। আর শাসনকর্ত্রী যদি মা হতো তবে, আমাদের সামনেই ডেকে বলত,”না মা, অতো জোরে কি মারতে আছে ? আরেকটু আস্তে তো মারতে হয়, দেখছো না কতো লেগেছে ! কতো চোখের জল পড়ছে ?’ইত্যদি ইত্যাদি।কিন্তু তাতেই জগৎ তুষ্ট হয়ে যেত, তখনকার মতো কান্নার ইতি। তবে সব সময় এমন  হতো তা নয়, বাস্তব কারণেই দাদুর পক্ষে সব সময়ে আমাদের করুণ ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে আসা সম্ভব হতো না।ভাবতে ভালো লাগে কল্পনা করে, সত্যি করে সান্তনা পাই যে আমার শেষ মুহূর্তে দেখতে পাব দাদু, দিদি, বাবা, দাদুর এলসিসিয়ান কুকুর বেটিকে।

     ঘুরে ফিরে মনে হয়েছে দাদু শেষ দিন পর্যন্ত মূলগত ভাবে গ্রামীন অনুষঙ্গবহ একটি মানুষই রয়ে গিয়েছিল। জন্ম ও বেড়ে ওঠার মূল পর্যায়টি কোলকাতায় না হওয়ার দরুন  নিজেকে এখানে বহিরাগত বলেই নিজেই ধরে নিয়েছিল। আর শুরু থেকে এখানকার নাগরিক বাতাবরণকে আত্মস্থ করে নিতে না পারার দরুণ এই জগতে কোন দিনই সচ্ছন্দ বোধ করেনি। এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা করা সত্ত্বেও মানুষটির মর্মের মধ্যে নাগরিক পরিমার্জনা বা শহুরে কায়দাকনুন তোড় তারিখা বিশেষ প্রবেশাধিকার পায়নি, আর তার প্রয়োজনও বোধ হয়নি শেষ দিন অব্দি। তাই বাহ্যিক আচার আচরণে একান্ত প্রয়োজনীয় অদল বদলটুকু ছাড়া অন্য সব কিছুকেই ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাক বনে যাওয়া বলে ভীত থাকত। মৃত্যুর দিন কতক পরে হিন্দিভাষী স্টেনলেস স্টিলের এক বাসনওয়ালী যা বলেছিল তার মর্মার্থ হল এই যে,’’বাবু ইতনা বড়া ভারী আদমি থেঁ ও মুঝে মালুম নেহি পরা, মেরি সাথ এইসেই বাতে করতে রহতে থে কি লাগতা থা কি উয় মেরে বরাবরকে কই হ্যাঁয়। আরৌ উনকি গুজর জানেকে বাদ, ইতনে লোগ আয়েথে যেইসে লাগতা থা মেলা যৈসা। তব মেরি সমঝ মে আয়ি।‘সহরে বাস করেও সহুরে হয়ে উঠতে পারেনি কোন দিনই। এর প্রভাব আমরা আজও বহন করে বেড়াচ্ছি। কোলকাতার বহু সুদর্শন মানুষের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এলেও ওঁর জীবনের হীরো থেকে গিয়েছিলেন লাভপুর গ্রামে শৈশব কালের তরুণ কবি ও পরবর্তি কালের বৈবাহিক নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় মাশাই। এই রকম আরো বহু অদ্ভূত কান্ড কারখানার কথা যথা সময়ে আসতে থাকবে।

      ইদানীং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে গচ্ছিত দাদুর কাগজপত্রের তালিকা প্রস্তুত করার সুত্রে ঐ মানুষটির মনোজগতের কিছু অদ্ভুত তাৎপর্যময় দিক চোখে পড়ছে। বলাই বাহুল্য যে ঐ কাগজপত্রগুলো ঐ রকম একজন মানুষের জীবনের সমস্ত কাগজপত্রের অতি সামান্য অংশ; ইতিহাস যেমন হয়ে থাকে, তেমনই আর কি। ও গুলোর থেকে সামান্য কিছু ইঙ্গিত মেলে বড়জোর, সার্বিক কোন ধারনা গড়ে তোলা যায় না। যাইহোক স্বভাবগত ভাবে ব্যক্তিটি মোটেই সুশৃঙ্খল ছিল না কোন দিনই; তার ওপরে ছিলাম আমরা, বাকিটা ঘেঁটে বিশৃঙ্খল করে দেবার জন্যে। বেলা ন’টা সাড়ে ন’টার পর পাঁচ সাতটা খবরের কাগজের এক বা একাধিক পাতা বেপাত্তা হয়ে যেত।হয়তো বা আমাদের হাতে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ছবি সংগ্রহ করার শিকার হয়ে, অথবা দাদা বা ভাইদের কোন প্রয়োজন মেটাতে সেগুলো এক ‘মিস্টার নো—বডি’র খপ্পরে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। এছাড়াও প্রায় নিয়মিত অন্নপ্রার্থীদের পরিবেশনের পাত্র হয়েও কাগজ ব্যবহার করা হতো। নানান ধরনের পত্র পত্রিকা দিয়ে উনুনে আঁচ ধরানো হতো; একটু রঙচঙে হলে মলাট দিতে লাগত। আর চিঠিপত্র দাদু দেখার পর, খুব দরকারি না হলে, গড়িয়ে পড়ত ড্রয়িংরুম ঘরের মেঝেতে। সেখান থেকে ঘর পরিষ্কার করার সময় ঝাঁটার ঘায়ে যত্রতত্র। ডাকটিকিট জমাবার জন্যে খামের টিকিট ছিঁড়ে নেওয়া ছিল দাদার বিশেষাধিকার। সুস্থির বিধিবদ্ধ ভাবে আলাদা আলাদা ফাইলে গুছিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল না অনেক ক্ষেত্রে, তেমনি প্রয়োজনটুকুও বোধ হয়নি কারোর। এই এতো কিছু পার হয়ে যেটুকু রয়ে গেছে সেটা নেহাৎই বরাত জোরে, নিছকই কার্যগতিকে।

অদ্ভুত স্নেহময মানুষ ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল অলঙ্ঘনীয়।মন মেজাজ (যা দিনের মধ্যে বেশ কযেকবারই খারাপ হত) মন যদি ভাল থাকল তো খালি গাযেই জড়িয়ে ধরে ফোকলা দাঁতে চুমু খেয়ে আদর করতে করতে বলে চলল,‘আরেতু হারমজাদ, তেরা বাপ হারামজাদ, তেরা ঠাকুরর্দা ভি হারামজাদ।‘একেবারে গ্রামীন ভাঙ্গি আর কি? আর যদি কারোর ওপর মেজাজ বিগড়োল তাহলে মানুষটিকে একেবারে মিশিয়ে দিল মাটির তলায়।তবে আমাদের অর্থাৎ নাতিদের পর্যায় এটা হতো কদাচিৎ। কারণ দাদু আমাদের মধ্যে  সারাক্ষণ থাকলেও আমাদের সঙ্গে থাকত না। সঙ্গ দিতেন অকাতরে কিন্তু সঙ্গী হতেন কালে কস্মিনে। কাছে যাওয়া যেত অনায়াসেই, কিন্তু ভেতরে ঢোকা ছিল দুঃসাধ্য। আজও স্পষ্ট মনে করতে পারি—ড্রয়িংরুম ঘরে মাটির ওপর ইঞ্চি চারেক উঁচু ছোবড়ার গদির ওপর পাতা হরিনের চামড়ার আসনে কাঠের নিচু ডেস্কের সামনে বাবু হয়ে বসে ফাইলে আটকানো কাগজের ওপর লেখায় মগ্ন। মাঝে মাঝেই লেখা থামিয়ে বাহ্য জগৎ বিলুপ্তের মতো তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, চোখের দৃষ্টি অপলক স্হির, আঙ্গুলে কলম ধরা।সেই অবস্থায় ঘরটার মধ্যে দিয়ে অবাধে ঘুড়ে বেড়ানোর ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিলনা।এখন বুঝতে পারি, সৃষ্টিকর্মের ওই ধ্যানমগ্ন তন্ময় স্তব্ধতার মুহূর্তে ‘দাদু লোক এস্‌ছে’ বলে কোন দর্শন প্রার্থীর আগমনবার্তা দিয়ে চিন্তাসুত্র খান খান করে দিয়েছি। লেখা থামিয়ে আগত ব্যক্তিটির সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তায় সরে যেতে খুব অনিচ্ছা বা বিরক্তি দেখিনি। মৃত্যুর কিছু দিন আগে নকসাল আমলে অতর্কিত আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন সাতেকের মত বাড়ীর দরজায় তালা লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। এর আগে বা অব্যবহিত পরেও বাড়ীর দরজা হাট করে খোলাই থাকত। শহুরে প্রথায় নিয়ম মাফিক সদর দরজা খোলা ও বন্ধ করা শুরু হয় তারপর থেকেই। গ্রামের অনুসঙ্গবহ পরিবারটিকে শহুরে করে তোলার কোন চেষ্টাও দেখিনি কোন দিনও। সচেতন ভাবে পরিবারটির মধ্যে কিছু নাগরিক প্রথা প্রকরণ চালু করে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তাকে সুনিপুণ যত্ন ও পরিচর্যার দ্বারা সুনির্দিষ্ঠ পথে পরিচালনা করার কোন মানসিকতাই ছিলনা। এখানে এমন একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায় যা কিন্তু বেশ সুপরিচিত। ১৯৫৮-৬১ সালে প্রতি বছর দোলের দিন এই অঞ্চলের বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক,শিল্পী,বুদ্ধিজীবীরা সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ নানা রঙে রঞ্জিত নানা পোষাকে ঢোল মাদল ইত্যাদি বাজাতে বাজাতে আমাদের বাড়ী আসতেন। রঙ খেলার শেষে মিষ্টিমুখ করে তাঁরা ফিরতেন, রাত্রে লুচি মাংসের নেমন্তন্ন নিয়ে। ১৯৬১ সালের পরে আমাদের বড় পিসেমশায়ের অসুস্থ্তাকে উপলক্ষ করে ঐ সমাবেশটি বন্ধ হয়ে যায়। বহু জনের লেখায় এর জন্যে আক্ষেপের সুর ধরা পড়েছে।

     যে কথা এর থেকে নির্দেশ করতে চাই তা হলো এই যে হবু  (তারাশঙ্করের ডাক নাম) শর্মা (পারিবারিক পর্যায়ে কখনো সখনো ওই নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে) ব্যক্তিটি  তীব্র আবেগ সম্পন্ন আর আদ্যন্ত সৎ মানুষ ছিল। রাজনীতিগত ভাবে কিম্বা সাহিত্যিক নৈতিকতা ইত্যাদি প্রশ্নে অনেকের সঙ্গে  মত পার্থক্য ছিল, ছিল ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে অপছন্দ। ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে পর্যাপ্ত প্রভাব। আর তা  থাকা সত্ত্বেও আমি অন্তত জ্ঞানত কারো বিরুদ্ধে কোন গোপন অভিসন্ধিমূলক কাজ করতে দেখিনি। বিরক্তি রাগ রোষ সবই পারিবারিক পরিমণ্ডলে। আর সেটা মূলত ঘরোয়া  অন্তরঙ্গ মহলে। কিন্তু চরিত্রের এই দিকটা সযত্ন পরিচর্যায় সর্বদাই আয়ত্বে থাকত, বাইরের লোকের সামনে প্রকাশ পেত কদাচিৎ।

        তা ছাড়া পিতামহ হিসেবে নাতি নাতনিদের নিয়ে সোহাগ করার মতো দাদু  তারাশঙ্কর ছিলেন না। আমাদের এক বন্ধুর ‘সভাসমিতি করা মা’ পূর্ণিমা সম্মিলনীর একটি অধিবেশনে ঘরোয়া কথাবার্তার ফাঁকে হঠাৎ দাদুকে, “আচ্ছা, আপনার নাতিরা আজ স্কুলে গিয়েছিল, কি না জিজ্ঞেস করে বসাতে দাদু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কারণ সংসারের কর্তা হিসেবে তাঁর আমলের মূল্যবোধে এটা খেয়াল রাখাটা কর্ত্তব্যবোধের আওতাভুক্ত, কিন্তু আমরা প্রতিদিন ইস্কুলে যাচ্ছি কি না সেটার হিসেব রাখা দাদুর কাছে অপ্রত্যাশিত, স্বভাব বর্হিভূত। আবার কলেজ স্ট্রিট পড়ায় কোনও রকম গন্ডগোল হবার সম্ভাবনা আছে মনে হলে দাদুই ইস্কুল না যাবার ফতোয়া জারী করে বসত।এ হেন দোর্দন্ড প্রতাপ দাদুকেও নাতির কাছে অপরাধ  স্বীকার করতে এবং হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে দেখেছি। ১৯৭০-৭১ সালের শীতকাল, বেলা সাড়ে বারোটা, আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার হচ্ছে—হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে, “কে বলে ‘যাও যাও’—আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।” একতলার উঠোনের রোদে দাদু চান করতে করতে নিজের বাঁচা মরা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছে। “আমি মরলে তুই সবচেয়ে বেশী কাঁদবি” তাতে মেজদা, দিব্যশঙ্কর (যে স্বভাবে আজও একান্ত আবেগ প্রবন রয়ে গেছে) খুব বেদনার্ত হয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে দাদুকে বলছে, ‘‘কেন তুমি এ রকম বল্লে, কেন বল্লে’’?  আর নিজের মন্তব্যের এ হেন প্রতিক্রিয়ায় অত্যন্ত অপ্রস্তুত বিব্রত হয়ে দাদু ওকে সান্তনা দিতে দিতে বলছে, ‘‘ও ভাই, এই দেখ আমি তো মরিনি। বেঁচেই আছি। তুই কাঁদিস না, ওমনি করে কাঁদিস না।’’

      এই রকম নাতি, নাতনি, দৌহিত্র দৌহিত্রী পরিবৃত হয়ে পুরোনো আমলের ঠাকুর্দার ভূমিকা ছিল, কিন্তু আদিখ্যেতা ছিল কদাচিৎ কারো কারো প্রতি। আর অন্ধ পক্ষপাতিত্ব ছিল ছোট মেয়ে বাণী (আমারা বলতাম বাণীমা)‘র একমাত্র মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া বা লালীর প্রতি। ১৯৫৫-৫৭ সাল নাগাদ বাণীমার বিয়ের আগে দাদুর সৃষ্টি কর্ম ও বৃহত্তর জাগতিক পরিমণ্ডলে স্বার্থকতার জোয়ার এসে ছিল। বাণীমা হয়ে উঠেছিল দাদুর ব্যক্তিগত সচিব বিশেষ, ‘মূর্তিময়ী বাণী’। বাহ্যিক পট পরিবর্ত্তনের অন্তরালে দাদু দিদির আধ্যাত্মিক জগতেও ওলট পালট হয়ে যাচ্ছিল। এরই জন্যে বাণীমার বিয়ে হতে দেরি হচ্ছিল। বাণীমার ছিল রোগ ব্যাধির বাতিক; আর লালী হবার সময়ে কিছু জটিলতা হয়েছিল, আর শিশু হিসেবে লালী খুব নজরকাড়া হয়েছিল—এইসব কারণে দাদুর পক্ষপাতিত্ব ছিল লালীর প্রতি। আর বাণীমার বিয়ের পরে কিছু দিন দাদুর মনে হয়েছিল তাঁর বাণী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে, তাই না কি লিখতে বসতেই পারছিল না।এই ব্যাপারটা আমার শোনা, তবে এই জাতীয় ঘটনা দাদুর মতো মানুষের জীবনে একেবারে আবিশ্বাস্য নয়। মানুষটিকে প্রায় একই জাতীয় আচরণ করতে দেখেছি  ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর যখন নিজের মনে হয়েছিল যে সাহিত্য চর্চা যে কারণে তা সম্পন্ন হয়ে গেছে, তাই লেখার আর দরকার নেই।“আমার কথা’ বলে দাদুর আত্মজীবনী মূলক রচনাটিতে যেরকম পাই তার থেকে একটু উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলাতে পারছিনা, ‘সে দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সনের পরই মন, এবং বলতে গেলে আমার জীবনেই যেন সব প্রেরণা, সব কিছু পাওয়ার একটি তৃপ্তির মধ্যে সূর্যোদয়ে প্রদীপশিখার মত আপনা থেকেই নিভে গিয়েছিল কর্তব্য শেষ হয়েছে বলে।—তাই স্বাধীনতা আসবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কর্ম আমার শেষ।এই তো সব পাওয়া হয়ে গেল। মনেও হয়েছিল—১৫ই আগস্ট রাত্রি অবসানে প্রভাতে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলে সঙ্গে সঙ্গেই যদি আমার শেষ নিশ্বাস পড়ে হৃদযন্ত্র থেমে যায় আনন্দের আতিশয্যে তবে পৃথিবীর আদ্যন্ত কালের মধ্যে আমার থেকে সুখি এবং ভাগ্যবান আর কেউ থাকবে না। দাদুর মৃত্যুর পরে দিদিরও অদ্ভূত এক নির্বেদ উপস্থিত হয়েছিল সে কথা নির্দষ্ট সময়ে বলা যাবে।

    আমাদের ব্যাপারে নজর ছিল তীক্ষ্ম, কিন্তু নাক গলানো ছিল কদাচিৎ, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণটা ছিল অর্ন্তপ্রবাহী। মনে পড়ছে ষাটের দশক পর্যন্ত জহরলাল থেকে শুরু করে বুল্‌গেনিন-ক্রুশ্চভ,এমন কি রাণী এলিজাবেথের মতো অনেক দেশী বিদেশী ভি.আই. পি.’রা কোলকাতায় এলে দমদম থেকে রাজভবন যেতেন যশোর রোড বেলগাছিয়া, শ্যামবাজার সেন্ট্রাল এভেনু হয়ে। একদিন মর্ণিং স্কুল থেকে ফিরে শোনা গেল যে প্রথম মহিলা মহাকাশচারী ভ্যেলেন্টিনা তেরেস্কোভা ঐ পথ দিয়ে  যাবেন। আমার ইচ্ছা দেখতে যাই, তখন বাজছে সাড়ে এগারোটা, গিয়ে  ফিরে আসতে আসতে চান খাওয়ার অনুমোদিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। মায়ের বারণ না শুনে যাবার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎই রঙ্গমঞ্চে দাদুর আর্বিভাব।  কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করলে বললাম, “ঐ যে প্রথম মহিলা, রকেটে করে চন্দ্র অভিযানে গিয়েছিল।’’ তখন দাদুর প্রশ্ন, “সে কি চাঁদ ?”শুনে খানিক হক্‌চকিয়ে গিয়ে যাওয়াটা তখনকার মত ভেস্তে গেল; আর ব্যাপারটার অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য বুঝতে লেগেছে অনেক দিন। তবে  দাদুর স্বেচ্ছাচারে সে যাত্রা আর আমার মাটিতে চাঁদের উদয় দর্শন হয়নি।

      দাদুর এই ধরনের বহু আচরণে সে দিন আশ্চর্য লেগেছিল,কিন্তু আজকে তার কিছু যেন তাৎপর্য খুঁজে পাই। তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ি, খাঁকি পোষাক পরা নেপালীদের মত দেখতে একটি লোক বাড়ীর কাছে রাস্তার মধ্যে আমাকে এসে বলে যে সে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনীর সৈনিক, হংকং থেকে ফেরার পথে খিদিরপুরে নেমে পকেটমারি হয়ে পরিচয় পত্র সহ সর্বস্ব খুইয়েছে। আমি যদি তাকে কিছু সাহায্য করি তবে সে নেপালে পৌছে শোধ করে দেবে। তাকে বাড়ীতে এনে ভাত খাইয়াই আর নিজের একটা বোকা ভাঁড় ভেঙ্গে তাকে সাড়ে এগারো টাকা মতো  দিয়েছিলাম, যা কিন্তু আজোও ফেরৎ পাইনি।  সে দিনের ঐ কাজে দাদু কোন বিরূপতা দেখায় নি বটে, তবে জানতে চেয়েছিল লোকটির বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে আমি  নিঃসন্দেহ হয়েছি কিনা ? যে দাদু নিজে নিয়মিত এমনি লোকদের খাইয়ে  থাকে। কিন্তু সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে চেষ্টা করার পরেও এই জাতীয় ব্যবহার কিছুটা আশ্চর্যজনক বৈ কি ? অভাবীকে অর্থসাহায্য করা বা নিরন্নকে ভোজন করানো তে দাদুর আপত্তি ছিল না, আর দাদু না চাইলে কিছুই করা যেতো না সে দিন।ধন্ধটা লাগছে অন্য জায়গায়। অসৎ মানুষটিকে যাতে আমি নিজের বুদ্ধিতে ধরতে পারি তাই সে দিন বাধা দেয় নি—সে নয় বুঝলাম। কিন্তু সে কথা মুখে বলেনি কেন ? আজকে নিজের সন্তানের সঙ্গে আদান প্রদান করতে গিয়ে বুঝতে পারছি যে তাদের কোন আচরণ বা বিশ্বাসে সায় দিয়ে গেলে ভালই। আর বিন্দু মাত্র ব্যাত্যয় ঘটলেই, বা মুখে কিছু বোঝাতে গেলে উঠতি বয়সের ছেলেরা (বর্তমানে মেয়েরাও) সর্বশক্তি নিয়ে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে নেমে পড়ে। দাদুকে মুখে প্রতিবাদ করার সাহস আমার হতো না, কিন্তু মনে মনে মেনেও নিতে দ্বিধা হতো। তাই কি নিজের মতো করে বুঝতে ছেড়ে রাখা ?

     আমাদের কোথাও যাওয়া বা রোজকার রুটিন বর্হিভূত কাজের ব্যাপারে ছিল অদ্ভুত ধরনের অপছন্দ দেখতাম, দাদুর ভেতরে। ষাটের দশকের শেষ দিকে কোলকাতা সহ গোটা রাজ্যেই অশান্তি অস্থিরতা খুব বেড়ে গিয়েছিল। চুরি, ছিনতাই (তখনো এলাকা দখল, প্রোমোটার রাজ বা সাপ্লাই সিন্ডিকেট ভবিষ্যতের গর্ভে) ঠেকাবার জন্যে বহু পাড়ার মতো আমাদের এখানেও শান্তিরক্ষা কমিটি গড়ে উঠেছিল। এরা রাত্রে পালা করে পাহারা দেবার ব্যবস্থা করেছিল। তখনও পর্যন্ত ছোটদের দলভুক্ত থাকার ফলে আমাদের যোগ দেবার প্রশ্ন ছিলনা। পাড়ার ঐ দায় বাড়ীর আর যারা  নিজের ঘাড়ে বয়ে নেবার মানসিকতা দেখিয়েছিল, তাদের যেতে হতো নুকিয়ে চুরিয়ে, দাদু শুয়ে পড়ার পরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষটির আরেক ধরনের খামখেয়ালীপনা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দাদা দিদিদের কেউ নির্দিষ্ট সময়ে ফিরতে না পারলে ঐ সময়ের আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত বিরক্ত দাদুর ঘর বার করা। দেরিটা তো দেরিই, তার কোন কারণ যে থাকতে পারে সে যুক্তি নিরর্থক তখন ওঁর কাছে। এ হঁটাচলা কখনো কখনো সম্প্রসারিত হতো বাড়ির সামনের রাস্তায়, সেখান থেকে বড় রাস্তায় বাস স্ট্যান্ডের দিকে। আর সমান তলে চলতো রাগারাগি, খুব তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে বাবা  বা দিদি তিরস্কৃত হতো, তীব্র ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতো মা পিসিমার ওপর–ঐ রকম ‘বে-টাইমে’ ফেরা সন্তানদের জন্ম দেবার জন্যে।দাদুর জীবনের একেবারে শেষের দিকে,আমরা তখন মনুষ্য পদবাচ্য হিসেবে গণ্য হবার পথে, কখনো সখনো খুব ঘনিষ্ঠ পরিবেশে খানিকটা অস্ফুট স্বগতোক্তির মতো বলতে শুনেছি, “ভগবান যেন ছোট ছেলের মত, বালিতে ঘর বানিয়ে, ভাঙ্গে খেলার শেষে আর বলে, হাতের সুখে গড়লাম, পায়ের সুখে ভাঙ্গলাম।  আমার সুখ (জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও সেই ধারায় ১৯৭১ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বন্যা স্রোতের মত সম্বর্দ্ধনা) ভগবানও তেমনি বরদাস্ত করবে না। এই যে ছেলে বেরিয়েছে, সে আর ফিরবেনা পাছে ভগবান সুখের ঘরে আগুন জ্বালে তাই নিজেকে অখুশি রেখে সুখি হয়ে পরার অপরাধ স্খালনের অদ্ভূত এক আত্মাহুতি। আর এটা যে নিছকই সৌখিন আত্মাহুতি নয়, এক ধরনের প্রয়াসসাধ্য আত্মরতির সমপর্যায় ভুক্ত আত্মদহন, একটা মানসিক কসরত, নিজেকে দিয়ে  কিছুটা বুঝতে পারি।

      যতোই চেষ্টা করছি দাদুর সঙ্গে আমাদের (একা আমার নয়, কারণ আমি একটা বিরাট সম্পর্ক জালের অংশ মাত্র ছিলাম) সম্পর্কটাকে স্পষ্ট করে তুলতে, ততোই মনে হচ্ছে ঠিক মতো হচ্ছে না। ১৯৬৬-৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল অব্দি নভেম্বর মাসে প্রতিটি জন্মদিনে দাদুর হাতে সই করা একটা  করে দাদুরই বই উপহার হিসেব নিয়েছি। ব্যাপারটা বলা যতো সহজ কাজটা মোটেই অতো সহজ হতো না। যেহেতু এই জাতীয় কাজ অন্য আর কেউ করত না, তাই  ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা ভ্রুকুঞ্চন উদ্যত থাকতো, তাই কাজ সারতে হতো সঙ্গোপনে। দাদুর লেখা বই বাড়ীতে থাকত ঠিকই, কিন্তু লেখক নিজে খুব একটা সুশৃঙ্খল ব্যক্তি না হওয়ায় প্রয়োজনের সময়ে প্রায়শই ঐগুলো পাওয়া যেত না। তাই খুব দরকারের সময়ে পিসিমাকে দেওয়া কপিটাও চেয়ে এনে কাজ সারতে হত। বাড়তি কপি থাকলে সেগুলো পড়তে নেওয়া যেত ঠিকই, তাই বলে ওই ভাবে নিজের বলে নিয়ে নেওয়ার ওপর  ছিল অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা। তাই বই সংগ্রহ করতে আমাকে অনেক ভাবনা চিন্তা করে, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে, দাদুর মেজাজ মর্জির দিকে নজর রেখে এগোতে হতো। হয়তো সকালে খেতে বসার আগে প্রনাম করেছি, বিকেলে ঐ কাজটি সারার সময়ে আমার জন্মদিনের ব্যাপারটা দাদুর মাথাতেও নেই—সেটা মাথায় রেখে বইটা হাতে নিয়ে সবিনয়ে  আবেদন জানাতে হতো। কোন বার হয়তো খুব খুশি হয়ে অনেক কথা বলে দু-চার লাইন হয়তো লিখে দিল, কোন কোন বার আবার  গম্ভীর মুখে দায়সারা ভাবে সই করে সারল। উত্তর পাব আশা করে  শিলিগুড়ি থেকে চিঠি দিলাম।  ও মা, পরের ভাই প্রায় কিছু না লিখেই পেয়ে গেল পুরো একটা কবিতা। আজকে বুঝি যে দূর থেকে খরর নেবার আন্তরিকতার চেয়ে চিঠি পাবার দূরভিপ্রায়কে  দাদু নির্ভুল ভাবে ধরতে পেরেছিল।আবার ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি এক দিন দোতলায় আমাদের ঘরে পড়ছি, দাদু এসে সাহিত্য এ্যকাদেমী প্রকাশিত লীলা মজুমদারের অনুবাদ করা ‘গ্যালিভারের ভ্রমন বৃত্তান্ত’ বইটি আমার হাতে দিল।কিন্তু দাদুর কাছে আসা যেহেতু সকলের সম্পত্তি, তাই এক আত্মীয় সেটিকে বগলদাবা করে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে চলে গেলেন। হাতে আর পেলাম না। বইটার সম্বন্ধে আজোও আকর্ষণ আছে। তাই এই শতকের প্রথমে একটি বই মেলায় কিনেছিলাম ছেলের নাম করে নিজের জন্যে।  দাদুর কাছ থেকে পরিবারের অনেকেই অনেক মজাদার ছড়া উপহার পেয়েছে। এখানে কয়েকটা উদ্ধৃত করছিঃ- ছোড়দা, কিশোরশঙ্করের চিঠির উত্তরে দাদূ লিখেছিল, “রন্টু তোমার পেলাম পত্র / আঁকাবাঁকা কয়েক ছত্র / এবড়ো খেবড়ো দাঁতের মতো / মেজে ঘসে সমান কর / নইলে বিপদ গুরুতর / চাকরি ক্ষেত্রে বিয়ের ক্ষেত্রে / দরখাস্তে ও প্রেমপত্রে / সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত।” পনেরো জন নাতি নাতনির মধ্যে লালীর জন্যে দাদুর পর্যাপ্ত প্রশ্রয় ছিল, ছিল বিপুল স্নেহ। সেই লালী যখন কয়েক মাসের তখন রাশিয়া থেকে লিখেছিল, “লালু দিদি লালু ভাই, তোমা লাগি নিরবধি মন, সদাই উচাটন;—-লালি যাবে জল আনতে সঙ্গে ক’জনসখি, কদম গাছের আঢ়াল থেকে শ্যাম মারে উকি।” আমাদের মা’কে লেখা একটি চিঠিতে খুড়তোতো দিদি, মীনাক্ষি প্রচলিত কথ্য ভঙ্গিতে মেজদাদুর বড় মেয়ে কাদুপিসি বা কলাপীর সন্তান সম্ভাবনার কথা জানাতে ‘বাচ্চা হবে’ কথাটা লিখেছিল। মানুষের বাচ্চা হয় না, পুত্র অথবা কন্যা হয় বোঝাতে দাদূ লিখেছিল,”শোন ভাই মঞ্জুলতা, শোনাই কথা, কানে কানে,রঞ্জু গোরা শুনতে না পাই সেটাই দেখো। যেমন তুমি সুন্দরী ভাই , হাতের লেখাও হয়েছে তাই। তাড়াতাড়ি পাস কর ভাই, কিনে দেব রঙিন শাড়ি, পেঁচিয়ে পরে করবে কপি দাদুর লেখা যত্ন করে। মাছেরা সব বাচ্চা পারে, শতেক দরুণ ডিম্ব ছাড়ে——–কাদুপিসির বাচ্চা হবে, পুত্র হবে কি কন্যা হবে ?—-” এই কাদুপিসি আর ছোড়দাদুর বড় মেয়ে কুমি অর্থাৎ কুমকুম, আর তার ভাই বাসু ওরফে বাসুদেবকে নিয়ে মুখে মুখে বানান ছড়া, “প্রথম ভাগে লেখা আছে, অ, আ, হস্যি। জ্যেটা খায় সিগারেট, বাবা নেয় নস্যি, কাদুকুমু ভালো মেয়ে, বাসু বড় দস্যি।“ বাস্তবে বাসু কিন্তু আদৌ  দস্যি ছিলনা কোন দিনই। সেই রকমই আবার মুখে মুখে বানানো, “বাকুম বাকুম পায়রা, ঠাকুমার চোখ খয়রা; মিষ্টি গড়ে ময়রা, খান বাবু মশাইরা। আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই প্রশান্তশঙ্কর ওরফে মুকুলকে নিয়ে মজা করে উক্তি,’ফাল্গুনে বিকশিত আম্র মুকুল—মুকুল তো কিসের মুকুল ? না আমড়া মুকুল, আমড়া মুকুল কিসে খায়; ঝোলে, ঝালে না অম্বলে ? আমি খেলাম অম্বলে। মুকুলের মা সন্ধ্যে বেলা খুঁজতে এসে বললে, বাবা আমার  মুকুল কোথায় ?আমার  মুকুলকে দেখেছেন ? আমার মুকুলকে দেখেছেন ? হ্যাঁ মা, আমি যে খেলাম মুকুলকে। তা কিসে খেলেন বাবা ? ঝোলে খেলেন না অম্বলে খেলেন ? অম্বলে খেলেন তো ঝোলে খেলেন নয়া কেন” ? ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এহেন মানুষদের বহু ধরনের উদ্ভটপনা থাকে। জীবিত কালেই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্য সন্মান লাভ করার পরেও দাদু নিজের প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার (সোজা কথায় ডিগ্রির) অভাবের ব্যাপারটা কোনো দিনই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। সম্ভবত দাদুর ঐ মনোভাবের জন্যেই আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অস্বাভাবিক জোর দেওয়া হয়েছিল।অতঃপর যখন ওঁর বড় নাতি হিমাদ্রিশঙ্কর ও বড় দৌহিত্রী শকূন্তলা এম,এ,পরীক্ষায় যথাক্রমে ইতিহাস ও ইংরেজীতে কলকাতা বিশববিদ্যলয়ে ভালো ফল করলে তা দাদুর কাছে খুব স্বস্তির কারণ হয়েছিল। আর তখন অবশ্য বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে লেখাপড়ার সমান্তরাল পেষা বা বৃত্তিগুলো এতো সুগম, হাতের কাছে সহজলভ্য হয়ে পড়েনি, সামজিক ভাবে স্বীকৃত বা সন্মানজনকও ছিল না। তাই মেজদা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’-হওয়া সত্ত্বেও বাড়ীতে তেমন কোন স্থান পায়নি, এমনকি ছোট ভাইদের কাছ থেকেও না।  ছোট ভাই মুকুলও খারাপ খেলত না, কিন্তু সে ওপথ-ই মাড়ায় নি, হয়তো ঐ প্রথাগত শিক্ষার স্বার্থেই হয়তো সর্ব প্রকার সৃজনশীল কলার চর্চাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সাহিত্য চর্চায় তো একদমই নয়। হয়নি তাই এ নিয়ে কপোলকল্পনার  অবকাশ কম। তাই বলে ঐ প্রথাগত শিক্ষার পাশেপাশে কি কোনো জাতীয় সৃজনশীল কলার চর্চাতেও কোন উৎসাই দেখান যেত না ? এটাও হতে পারে যে নিজে সাহিত্য সাধনার পথে যে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেছিল এবং ঐ কাজে যে সব বক্র সঙ্কীর্ণ পথ অতিক্রম করেছিল  সন্তান সন্ততিরা যাতে সেই সমস্যায় না পড়ে সেই জন্যেই ঐ সচেতন বাধা প্রদান। চেষ্টা করলে কি সবাই ব্যর্থ হতো ? আবার গ্রাম জীবনের সঙ্কীর্ণতা, দলাদলি, বক্রতা ইত্যাদির দরুণই কি দেশ বা গ্রামমুখি হতেও কোন উৎসাহ জোটে নি ? অথচ ছুটিছাঁটা বা পূজোর সময় লাভপুর যাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকতাম।  দাদুর জীবিত কালে কোলকাতা থেকে নিয়মিত লাভপুরের পূজোতে  অর্থ প্রেরণ নির্দিষ্ট ছিল। এর পিছনে অবশ্য দিদি (অর্থাৎ ঠাকুমা)‘র প্রেরণা ছিল নির্নায়ক। পূজোর খুঁটিনাটি নিয়ে কিন্তু দাদুর খুব একটা মাথাব্যাথা ছিল বলে মনে হয় না। কারণ দাদুর আধ্যাত্মিক বোধটাই ছিল ভিন্ন রকম। আস্তিকতা ও পারম্পর্যের প্রতি দাদুর আস্থা কমে গিয়েছিল, বটে তবে কোন দিনই লুপ্ত হয়নি। দীর্ঘ এক প্রবল মানসিক দ্বন্দ্বের অন্তে নিজের মা’র কাছে সস্ত্রীক দীক্ষা নিয়েছিল, দিদি ঐ পথে যাত্রা করেছিল আগেই।  ইষ্ট ছিলেন মা কালী। টালায় থাকলে সাড়ে বারোটা-একটা নাগাদ দোতলার ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পূজো করতো। ঘরটায় পাখা ছিল না, সম্ভবত প্রদীপ জ্বালার সমস্যার দরুন। পশ্চিমমুখী ঘরে গরমের মধ্যেই উচ্চ কন্ঠে চন্ডী পাঠ হতো। গীতা নয় চণ্ডীই দাদুর বেশী প্রিয় ছিল।স্বপ্নে নিজের বাবার কাছ থেকেও চন্ডি পাঠ করার নির্দেশ পাবার কথাও উল্লেখ করেছেন আত্মজীবনীতে। কিন্তু চণ্ডীতে বর্ণিত দেবীর মূর্তিময়ী প্রকাশ বা পৌরাণিক ঘটনা বিন্যাস নিয়ে উদ্বেল হওয়ার চেয়ে শরণাগতদের উদ্ধারের জন্য মাতৃরূপী মুক্তিদাত্রীর আর্বিভাব ও ভ্রান্তি, লজ্জা,দয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রূপকের উপস্থান তাঁকে টানত বেশী। দৈনন্দিন আলাপচারিতাতেও পূজো অর্চনা বা কোন বিশেষ আধ্যাত্ম সাধনের চেয়ে সুষম নৈতিক জীবন যাপনের ওপর জোরটা ছিল বেশী। তখন আকাশবাণী থেকে সাড়ে বারোটায় রবীন্দ্র সংগীত সম্প্রচারিত হতো। কোন কোন দিন পূজো করতে যাবার পথে ঠাকুর ঘরের উল্টো দিকের ঘরটায় বাড়ীর একমাত্র ভাল্ব সেটের রেডিয়োতে তা শুনতে পেলে দাদুকে কাঁদতে দেখেছি।মনে আছে একবার পূজো প্রসঙ্গে বলেছিল,পূজো আর কি নিজের মহৎ ও উত্তম গুণগুলির চর্চা করা। আর এই চর্চার বর্হিপ্রকাশ হতো কচিৎ কদাচিৎ।  নিজের দীর্ঘ সাধনা লব্ধ অভিজ্ঞতাকে ঐ রকম সুসংহত ভাবে অতি প্রিয়জনদের জ্ঞাত করার মধ্যে দিয়ে। সরস্বতীর সাধনা করলেও শুনেছি সরস্বতী পূজোর দিন দাদুর উপোস কাপাসের কোন গল্পই ছিলনা। স্বাভাবিক নিয়মে চা জলখাবার খেয়েই রোজকার লেখার কাজ সেরে বেশ বেলা করেই জলচৌকিতে রাখা বই-এর সামনে আচমন করে বসে দেবীর কিছু সুপরিচিত স্ত্রোত্রর পরে রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’র ‘পুরস্কার’ কবিতাটি থেকে সরস্বতীর বন্দনা অংশটি পাঠ করত। ঝোঁকটা ছিল নান্দনিক ও মানসিক চর্চার ওপর। ফলিত জ্যোতিষে অবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু তা নিয়ে সামান্যতম আগ্রহের বর্হিপ্রকাশ দেখিনি। দেখিনি প্রেতলোক বা পরজন্ম নিয়ে বিশেষ উৎসাহ। শেষ জীবনে ‘ভূতপুরাণ’ বলে কিশোরদের  কৌতুকপূর্ণ উপন্যাসে ভূত-প্রেত নিয়ে খানিকটা হাসি মস্করাই রয়েছে। আর ঐ পর্যায়ে ঠাকুমাকে বলতো মজা করে, মরে আমি বাগানের বেলগাছটার ডালে বাসা বাঁধব, আর বড়বৌকে দাঁত খিঁচিয়ে করে ভয় দেখাব। আর ঘুমের ঘোরে ভুতের এবং চোরের দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে ওঠাটা ছিল নিত্য কর্ম।

    দাদুর সঙ্গে আমাদের শেষ আদান প্রদানের ঘটনাটিও বেশ তাৎপর্যময়। ১৯৭১ সালে আগস্ট মাসের শেষাশেষি প্রবল এক ঝড় জলের রাত্রে ব্রেন ফিভার জাতীয় কোন কিছুর আক্রমনে দাদু অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বাড়ীতেই চিকিৎসা চলে। দিন সাতেক পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে শোবার ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কথা হচ্ছে। কোলকাতায় নকশাল আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ এক বছর প্রায় বন্ধ থাকার পর স্কুল আবার খুলেছে। তিন তিনটে পরীক্ষা না দিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠে গিয়ে মালুম পড়েছে পরীক্ষিত না হবার বিপদ। তাই সরকারী কর্মচারী শিক্ষকবৃন্দ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আর আমরা ছাত্ররা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ‘বুর্জোয়া পরীক্ষা ব্যবস্থায়’ আবার আস্থাশীল হতে বাধ্য হওয়ায় প্রি-টেস্ট শুরু হয়েছে। পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিত্যকার মতো দাদুর চার পাশে ঘোরাঘুরি কমই হয়েছিল হয়তো। একদিন পরীক্ষা দিয়ে আসার পর আহ্বান, “ভাই তোরা সবাই আমাকে ত্যাগ করেছিস, বুড়োটার কাছে আর আসিস না।“ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে দাদার পরিচিত, পাড়ার এক যুবক—কমলদা রোজ যেমন আসতেন তেমনি এসে ছিলেন, তার উদ্দেশে উক্তি, “ওরে কমল, আজকাল তোরা কেমন কেমন করে প্রেম করিস ?  তুই একটা প্রেম করে এসে আমাকে বলবি, আমি তোদের এ যুগের প্রেমের গল্প লিখব। একেবারেই ঘরোয়া কথাবার্তা আর কি। কমলদা তো পালাবার পথ পায়না। ইতিমধ্যে বাবা অপিস থেকে ফিরে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পূজো সংখ্যায় প্রকাশিত এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ওপরে প্রকাশিত উপন্যাস দুটির প্রকাশ নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলে দাদু বলল, “এক একটা সময় আসে একটা এক একটা বিশেষ মেজাজ পরিবেশ চিহ্ন বহন করে। যেমন বৈশাখ আসে গেরুয়া জয়ধ্বজা বহন করে। তেমনি এই উপন্যাস দুটো এ বছর দুই বাংলার পরিস্থিতির দ্যোতক। তাই দুটো উপন্যাস নিয়ে যে বইটা হবে তার নাম হবে ‘উনিশশো একাত্তর’, আর উৎসর্গ করা হবে দুই বাংলার বাঙ্গালীর উদ্দেশ্যে। এর পরেই কথাবার্তা ঘুরে গেল সাহিত্যের দিকে, নানা কথার মধ্যে দাদু সে দিন নিজে থেকেই বলে বসেছিল,’জান ভাই, আমার সাহিত্যের মূল কথা কি ? মূল কথা হলো।

“ভালোবসে এই বুঝেছি

 সুখের সার সে চোখের জলে—

তুমি হাঁস    আমি কাঁদি

বাঁশি বাজুক কদমতলেতে।‘

এর খানিক পরে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে আমরা উঠে এলাম,সে রাতেই দাদু দ্বিতীয় বারের জন্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ল, সে জ্ঞান আর ফেরেনি।

            দাদুর সম্বন্ধে আমার এই স্মৃতি তর্পণ শেষ করার আগে যে বিষয়টি খুব গুরুতর, জানাতে চাই তা হচ্ছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একজন প্রকৃত সৃষ্টিশীল ব্যক্তির মতো পরিতৃপ্তি বা সন্তোষ কখনোই মানুষটির জোটেনি। পুরুষার্থ বলতে যদি যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি কি বৈষয়িক প্রতিষ্ঠাকে বোঝায় তবে সে সবই তাঁর জীবনে অধরা ছিলনা। আর আমি যে সময়ে (অর্থাৎ ১৯৬০-৭১) ’র স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বর্তমানের এই কথাগুলো লিখছি, সেই বয়সে একজন ষাট অতিক্রান্ত মস্তিস্কজীবী (যদি সে নিতান্তই স্থুল রচির না হয় তবে)’র পক্ষে নিজের জাগতিক অর্জনগুলি নিয়ে আপ্লুত হবার মতো অবস্থা থাকেনা এমনিতেই; তার ওপর মানুষটি যদি তারাশঙ্করের মাপের হয়। ফলে যা দেখেছিলাম তা হল প্রতিদিন নিত্যকর্মের অন্তরালে সতত বিমর্ষ একটি সত্ত্বাকে। ঈশ্বর বিশ্বাস ছিল দাদুর আধারশিলার; তখন পর্যন্ত বহমান (ঘাতসহ, স্থিতিশীল) পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ভাবধারা ছিল বাতাবরণ; আর স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শগুলো ছিল বিধি নির্দিষ্ট লক্ষ্য। সে জগতেও কিন্তু পালা বদলের জোয়ার আসছিল, তবে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার পর্যায় আসতে তখনও কিছু দেরি ছিল। আমাদের প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে খুব কম জনই বর্তমান কালের বস্তুবাদী চিন্তার প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে অথবা দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে সক্ষম। ফলে ঈশ্বর আর তাঁকে জড়িয়ে গড়ে ওঠা বিশ্ববোধ আমাদের দুনিয়া থেকে ক্রমাগতই পিছু হাটছে। আর  দাদু, আমাদের দুই প্রজন্ম আগের সেই ব্যক্তিত্ব যারা ভাববাদের  সঙ্গে বস্তুবাদকে মেলাতে আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে। আমরা বাস করছি না ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা অবস্থায়।আমার জ্ঞানে নকশাল আমলের নির্বিচার হত্যাকান্ড দেখেও নির্বিকার থাকার মধ্যে দিয়ে বিবেককে গলা টিপে মারতে শিখে গিয়ে ছিলাম। তারপর এলেন’এশিয়ার মুক্তিসূর্য’। কংগ্রেসের বৃদ্ধ ঘাগুদের সিন্ডিকেট উপড়ে ফেলে,ব্যাঙ্ক, বীমা, কয়লাখনি জাতীয়করণ করে, স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানে সহায়তা দিয়ে  চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন। আর সেই অগোচরে নেমে এল ব্যক্তিপূজার ঢল, বংশবাদ, বস্তু বিজ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত দার্শনিক বিষ্ময় যাকে রোমাঞ্চিত করে। যৌক্তিক বস্তুনিষ্ঠার জায়গায় জাগতিক অমার্জিত বস্তু-সর্বস্বতা তার আবেগ সম্পন্ন মনকে নিষ্ঠুর ভাবে আহত করত। বিজ্ঞান মনস্কতার নামে বিজ্ঞানবাদীতা বিশেষ করে বস্তু বিজ্ঞানের বহু তাৎক্ষণিক সীমাবদ্ধতাগুলিকে ছদ্ম বোদ্ধার বিদ্রপ-মিশ্রিত বহির্প্রকাশ, জগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলার আগেই প্রয়াত হয়ে নিজের বহু পূণ্যফলের প্রসাদ লাভ করেন—এটা আমার কছে পরম স্বস্তির কথা।   

তারাশঙ্করের উত্তরাধিকার

শরীর-ধারনের সুত্রে সকলকেই রক্তধারার সঙ্গে পিতৃপুরুষের ভাবধারাকেও মাথার মধ্যে অদৃশ্য রপ্তানির মতো বয়ে বেড়াতে হয়। আর তারাশঙ্করের মত একজন পিতামহের পৌত্র হবার দায় কিন্তু কিছুটা অতিরিক্ত, যা জীবন দিয়ে ভোগ করতে হয় (শুধতে হয়)। এই মুহূর্তে আমার অস্তিতের দুর্বহ চাপের মতো লেগে রয়েছে ঐ রকম এক জন দাদুর নাতি বনে থাকার বোঝা। জীবনের শেষ তিরিশটা বছর স্বতন্ত্র একটা পেষায় নিজস্ব পরিচয়ে ভালমন্দ (সে যেমনি হোক) কর্ম জীবনে সাহিত্য বহির্ভুত ক্ষেত্রের মানুষদের সঙ্গে পার করে আসার পরেও অনুভব করছি যে আমার সঙ্গে জুড়ে থাকা ওই পরিচয়টা ছাপিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এটা পাকে পাকে আরোও জড়িয়ে গিয়েছে দাদুর নামের রাস্তার ওপর দাদুর তৈরি বাড়িতে কোন বড় ধরনের রদবদল ছড়াই ও এটাও ঠিক যে ঐ পরিচয়টা ছাপিয়ে ওঠার বিশেষ আগ্রহও আমার বিশেষ নেই।

 ঠাকুমা উমাশশী দেবী, দিদি

      রথের মেলায় কিনতে পাওয়া যায় মাটির মোটাসোটা কর্ত্তা গিন্নি পুতুল, দু-জন দু-জনের দিকে ঘাড় হেলিয়ে উবু হয়ে বসে আছে  কান এঁটো করা হাঁসিতে উদ্ভাসিত মুখ/এক গাল/মুখ হাঁসি নিয়ে। ভাবখানা যেন কাছে গেলেই বলবে, “আয় আয়, বোস বোস’, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মন্ডা মিঠাই খেতে দেবে।ঠাকুমা বলতে যেমনটা হয়, আমাদের দিদি ঠিক তেমনটা ছিল না। নিজের পুজোআচ্চা আর সংসার পরিচালনা নিয়েই ওনার দিন কাটাত।সহজ সরল গ্রামের মহিলা, কিন্তু গ্রাম্যতা ছিলনা একেবারেই। সে যুগের মূল্যবোধ অনুযায়ী মূলত ধর্মীয় সাহিত্য ছাড়াও বাংলা সাহিত্য  আর বাংলায় প্রকাশিত বিশ্ব সাহিত্যও কিছু পড়া ছিল। আশ্চর্য রকমের নিরভিমান (কিন্তু ব্যক্তিত্বহীন নয় মোটেই) মানুষ ছিলেন। নাতি নাতনি দৌহিত্র দোহিত্রি পরিবৃত হয়ে থাকলও আহ্লাদে আপ্লুত, বাৎসল্য রসে টইটম্বুর কি খুশিতে ডগমগ হয়ে সোহাগ দেখানো বা ঘুড়ে ফিরে থুতনিতে পাঁচটা আঙ্গুল ছুঁইয়ে সেগুলো আবার ঠোঁটে ছুঁইয়ে চুক্‌ করে আওয়াজ করে আদর  করা বা মাঝে মাঝেই ভাড়ার থেকে মিষ্টি মন্ডাটা খেতে দেওয়ার মহিলা তিনি ছিলেন না।তাঁর ধাতে ছিল না বাচ্চাকাচ্চার ন্যাঞ্জারী বওয়া। এমন কি ছোটপিসি বাণীমার আঁতুড় সামলাতে হয়েছিল আমাদের মাকে। কিন্তু অন্তর ছিল স্নেহে পরিপূর্ণ, ইতর প্রাণী সহ সর্ব জনের প্রতি মমতায় ভরা প্রাণ। আমরা যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দিদিকে দেখতাম এক কর্মচক্রে আবর্তন করতে। সকালে দিদি একটু বেলা করে, এই আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ উঠতো। প্রাতঃকৃত্য সেরে সেই যে ঠাকুর ঘরে ঢুকতো  বেরোতে বেরোতে সেই সাড়ে দশটা এগারোটা।

  আমার বাল্যকালে ঠাকুর ঘরে ঠাকুর দেবতার সঙ্গে দাদু-দিদির তাবৎ পার্থিব বস্তু রাখা ছিল। পার্থিব বস্তু বলতে কাঠের একটা বেঞ্চির ওপর দুটো লোহার ট্র্যাঙ্কে দাদু দিদির আটপৌরে ও তোলা জামাকাপড় আর গরম জামা, দিদির  ক্যাশ বাক্স (যাতে ক্যাশ থাকতো যৎসামান্য,থাকত টুকিটাকি কাগজপ্ত্র—পরবর্তিকালে যার মধ্যে দাদু দিদির চিঠিপত্র পাওয়া গিয়েছিল, আর থাকতো বিভিন্ন ঠাকুর দেবতার নির্মাল্য)। এর উল্টো দিকের মেঝেতে দেওয়াল ঘেঁসে ঠাকুরদের সংসার।  ঐ সংগ্রহ শালায় সিঁদুর আর চন্দনে আচ্ছন্ন ওঁদের ইস্ট দেবী কালীর ছবি ছাড়া আরও বহু দেবদেবীর ছবি, ধাতু ও মাটির মূর্তি ছিল। একবার একটা নিটোল ডিম্বাকৃতির পাথর পেয়ে ছিলাম, সেটাও শিব হিসেবে ওই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছিল কিছু কাল। আর এই জাতীয় দৃষ্টান্ত ওইটাই একমাত্র ছিল না।

নিজে নানা ধরনের পূজোআচ্চা করলেও দিদি কিন্তু নিজের ধর্মাচরণ দিয়ে পুত্রবধূদের ভারাক্রান্ত করে দিয়ে যায়নি। কয়েকটা ষষ্ঠী পূজো ছাড়া অন্য কোন পূজো পার্বণ করতে দেখিনি মা বা নতুন মা (মায়ের সহোদরা, অপর পুত্রবধূ) কে; যা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। টালার বাড়িতে খুব সাধারণ পূজো অর্চনাও (যথা প্রতি বৃহস্পতি বারের লক্ষ্মী পূজো বা মাঝেসাঝে সত্যনারায়ণ) হতে দেখিনি। কারণ ধর্মাচরণের অধিকাংশ দায় দায়িত্ব গচ্ছিত/নস্ত্য ছিল লাভপুরে গৃহীত উদ্যোগের ওপর।

     দুপুরে খাওয়া সময় আমাদের মা আর কাজের লোকদের সঙ্গে নিতান্ত অনিচ্ছার এক খাওয়া সারতো। খাদ্য তালিকায় বিশেষ কোন তারতম্য হতোনা। এর পর ঘ্ন্টা দেড় দুই জিরিয়ে নিয়ে উঠে ঠাকুরঘরের অতিথিদের শয়ন করিয়ে আবার বসত ভাগবত পাঠে;  একশো কুড়ি বা তারও বেশী বার ওই বইটা পড়তে পড়তে ওটার সেলাই খুলে এক গুচ্ছ কাগজের স্তুপ হয়ে উঠেছিল। রাত্রি এগারোটা সাড়ে এগারোটা ওব্দি পড়ে যেত, পড়েই যেত। ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে, চোখের দৃষ্টি যখন একেবারেই ক্ষীণ হয়ে পড়ে, তখন দিদির ঐ ভাগবত পাঠ সাঙ্গ হয়। এমন সচেতন ভাবে এমন আত্মনিগ্রহ করতে খুব কম লোকেই দেখা যায়। ক্ষিদের সময় আগ্রহের খাওয়াতেও ‘অনিচ্ছার” ব্যাপারটা শুধু কথার কথা নয়। কারণ যা খেতে বা পরতে ভাল লাগে সেগুলিকে পরিহার করাই ছিল ওঁর জীবনের আপ্রাণ চেষ্টা। মুখের লব্জই ছিল, “খেয়ে কি হবে ? বাহ্যে হয়ে যাবে। নতুন কাপড় পড়লেই তো শেষ মেশ ত্যানা হয়ে যাবে। খুব শীত না করলে ব্লাউজ আর অবশেষে সাদা রঙের হাফ হাতা সোয়েটার গায়ে উঠত। ও সব পড়লেই বলত পিঠ বেয়ে আগুন উঠছে।এই জাতীয় একটা সমস্যটা আমারও আছে।ওটা সম্ভবত স্পন্ডেলাইটিস জাতিয় কোন স্নায়ুর রোগ, যা চিকিৎসার সাহায্যে নির্ধারিত হয়নি। দিদি কিন্তু ডাক্তারকে ও সব বলার প্রয়োজন বোধ করেনি কোন দিন। কারণ দিদি বিশ্বাস করতো যে ওগুলো কোনো দৈবি বিধান।এমনিতে অর্ন্তবাস ছাড়াই দিন বা দিনের বেশির ভাগ সময় কেটে যেত।  একবার কুটুম্ববাড়ির কিছু লোকের আসা উপলক্ষ্যে  ওঁকে পরার জন্যে সায়া বার করে দেওয়া হয়। বহিরাগতদের সঙ্গে  কথাবার্তা শেষে করে ওঠার সময় দিদির নজর পড়ে কাঁধ থেকে প্রলম্বিত সায়াটার ওপর, আর সঙ্গে সঙ্গে অকপট সবীকারোক্তি, “হেই মা, দেখেছ, কি কান্ড, সায়াটা দিয়েছিল পরতে, ভুলেই গেছি।’’

     একদিক থেকে খুবই ভাগ্যাহত মহিলা ছিলেন। খুব অল্প বয়েসে নাবালক পাঁচটি সন্তান রেখে মা মারা যায়। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার পিতা পত্নীশোকে উন্মাদ হয়ে মদ্যপানে নিজের বেদনা ভুলতে চেষ্টা করেন। অবস্থা সামাল দিতে দোর্দন্ড প্রতাপ শ্বাশুড়ি, জগদম্বা ঠাকরুণ নবালক দৌহিত্র দৌহিত্রিদের স্বার্থে জামাই কর্তৃক কন্যার নামে রক্ষিত সম্পত্তি কৌশলে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেন। এতে আরো ক্ষুব্ধ হযে জামাই আবার বিয়ে করে সাবেক শ্বশুরবাড়ীর কাছেই। নতুন করে ঘর তোলেন দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। চার ভাই-এর একমাত্র বোন, আমাদের ঠাকুমা কয়লার ব্যবসায়ে লক্ষপতি দাদামশাই, যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিশাল এক বাড়ীতে দিদিমার তত্ত্বাবধানে নিজের মতো বেড়ে উঠতে থাকে। মা’র অবর্তমানে বাপের বাড়ির অনাদরের অভিজ্ঞতা বুকে লুকিয়ে রেখে। যাদববাবুর সঙ্গে জমিজমা ও গ্রামের নেতৃত্ব নিয়ে দাদুর বাবা হরিদাসবাবুর সঙ্গে ছিল পুরোনো দ্বন্দ্ব। অদ্ভূত সমাপতনের মতো ঐ দুই ব্যক্তির দ্বন্দ্বের জের চলে ওনার দৌহিত্রি ও এনার ছেলের বিয়ের প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে। প্রস্তাবিত বিয়ে ছিল দুটো, দাদু দিদির বিয়ের সম্বন্ধের সঙ্গেই দাদুর বোন কমলার (শিক্ষা সহবত দেখে) সঙ্গে দিদির বড়ভাই লক্ষ্মীনারায়ণের জায়ে বদলে বিয়ের প্রস্তাব হয়েছিল। বৈষয়িক বুদ্ধিতে প্রাগ্রসর ঐ পরিবারটির এই হিসেবটা একেবারে রাজজোটক না হলেও কাজ চালাবার পক্ষে খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু দুই পরিবারের মানুষদের স্বার্থবোধ ও অহমিকার বলি হয় এঁদের দুজনের দাম্পত্য জীবন।‘ধাত্রীদেবতা’তো এই নিয়েই লেখা। প্রতিষ্ঠিত পিতার কন্যা কি সম্পন্ন মামারবাড়ীতে কর্ত্রীর ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত দৌহিত্রি কি একটি গেরস্থ পরিবারের বড় বৌ হয়েও উমাশশী কিন্তু কখনই পাদপ্রদীপের সামনে আলোর সামনে আসতে পারেননি। প্রথম জীবনে শ্বশুরবাড়ির প্রতিকূল পরিস্থিতি, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মানুসন্ধানে নীরত স্বামীর অমনোযোগ, অন্য দিকে পারিবারিক সুত্রে লব্ধ স্ত্রীধনের  উত্তাপ দিয়ে সন্তানদের প্রতিপালনের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে মনের অলখ্যে জমে উঠছিল বেদনা, শূন্যতাবোধ। না।  ‘দুইপুরুষ’ নাটকটির প্রথম দৃশ্যে স্বামী-স্ত্রী রকম কথোপকথন শুনি, স্বামী জিজ্ঞাসা করছে, “কি চাল নেই না নুন নেই, ও দুটো না থাকলেই ভাবনা; বাকি সব কিছু বিলাসের পর্যায়ে ফেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তারপর যথারীতি স্ত্রীর মুখঝামটা, “উঃ অন্ন জোটেনা, কথা জোটে মেলা” ইত্যাদি ইত্যাদি। পারিবারিক সুত্রে শুনেছি যে সংলাপ গুলিকে যথা সম্ভব বাস্তব ধর্মী করার জন্যে দিদিকে রাগিয়ে দিয়ে ঐ কথাগুলো শোনার ব্যবস্থা করে দাদু স্বয়ং।  এটা ছিল ওঁদের মধ্য জীবনের প্রথম পর্বের বাস্তব প্রতিফলন। এই বোধ পরবর্তী জীবনে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠাকামী স্বামীর আত্মসমাহিত ব্যস্ততার দরুণ আরো বেড়ে গিয়ে এক সার্বিক তিতিক্ষায় পরিণত হয়। এর ফলে পুজোআচ্চা নিয়ে দিদি আধ্যাত্মিকতার জগতে এমন ভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে, যেখান থেকে প্রার্থিত/পার্থিব ক্ষেত্রে সফল স্বামীর শেষ জীবনের আর্তি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তারাশঙ্করের মানস সঙ্গী তিনি ছিলেন না, হতেও চান নি। ব্যক্তিত্ববোধের একটা সুক্ষ্ম দূরত্ব ছিল।তবু জীবনের শেষ ক’বছর স্বামী স্ত্রীর দীর্ঘ দিনের সমান্তরাল পথ চলা কিছুটা সমীপবর্তী হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর্গেশনন্দিনী শতবার্ষিকী থেকে ফেরার পর দেখলাম ’বড়বৌ, বড়বৌ’ ডাকটা বেশ বেড়ে গেছে। চানের সময় বড়বৌ জবাকুসুম তেলটা মাখিয়ে দিলেই ভাল লাগত। দিদিকে নিয়ে আমরা ছড়া বেঁধেছিলাম, “উমাশশী, উমাশশী, কি করহে বসি বসি ? দাঁড়াও না এক বার ভাই; না রে, না রে সময় আমার নাই রে, ফুল তুলিতে যাই। শুনে মহা উৎসাহিত হয়ে দাদু সংশোধন করে মুখে মুখে বলেছিল, “উমাশশী, উমাশশী, কি কর হে দিবা নিশি, দাঁড়াও না একবার ভাই; না রে না রে, সময় নাহি পাই রে, পূজা করিতে যাই। ঐ যদু রান্না ঘরে, ডাকে আমায় তারস্বরে; সামাল দিতে ধাই। মৃত্যুর অব্যহিত আগে অচৈতন্যের মধ্যে বাড়ির মহিলারা কেউ দাদুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলে দাদু হাত চেপে চেপে ধরছিল। মেয়ে বা পুত্রবধূদের হাত বুঝতে পারলে হাত ছেড়ে দিত,কিন্তু দিদির হাত হলে ছাড়তো না, ধরেই থাকত।

      শ্বাশুড়ি হিসেবে দিদির ভূমিকাও ছিল মর্মস্পর্শী। ‘শ্বাশ-বহু সিরিয়ালে বহুল চর্চিত সম্পর্কটির নানা দিকের কিছু অংশ আমাদের পরিবারেও নিশ্চয়ই অভিনীত হয়েছিল। দিদির দুই পুত্রবধূর মধ্যে কনিষ্ঠজনটি ছিল মাটির মানুষ, তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কোন ক্ষেত্রই ছিল না।  কারণ সে অনেক সময়েই স্বামীর সঙ্গে তার কর্মক্ষত্র থাকত। কিন্তু আমাদের মা’র ক্ষেত্রে ছিল আর তা র্নিদ্বন্দ্বও ছিলনা। বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে দাদুর জুটেছিল ‘নতুন মা’। আর মা’র জুটেছিল বিপুল পৃষ্ঠবল।সেই বলে বলীয়ান হয়ে মা এমন অনেক পদক্ষেপ নিতে পারতো যা একজন শ্বাশুড়ির মনপুঃত না হবারই কথা। ১৯৫৭ সালে ষষ্ঠ সন্তানটি জন্ম দেবার পর পুত্রবধূ লাইগেশন করাতে চাইলে শ্বাশুড়ি হিসেবে আপত্তি করাটা সে যুগের মানসিকতায় খুব একটা দোষবহ বলা চলে না। কিন্তু এই শ্বাশুড়িই তো আবার নিজের জামাই ঘরভর্তি সংসার ও নাবালক পুত্র কন্যাদের রেখে মারা যাবার পর পুত্রবধূকে কন্যার সঙ্গে সহমর্মিতা মূলক হবিষান্য গ্রহন করতে গিয়ে কষ্ট পেতে দেখে পেঁয়াজ দিয়ে ভাত খেতে পরামর্শ দেয়। কন্যা সন্তানের পক্ষে নিজের মায়ের সমর্থণ সমাদরের তীব্র প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা দিদি বুঝেছিল নিজের জীবন দিয়ে। এই ব্যাপারে তাই দিদি ছিল একান্ত স্পর্শকাতর। টালার বাড়ীর গৃহিনী হিসেবে তাই কন্যাদের স্বার্থ  সংরক্ষণ তাঁর জীবনের গুরুত্বপুর্ণ কাজ হয়ে উঠেছিল। আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পর্যায়ে তাঁর পত্নির লব্ধ স্ত্রীধন থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা লাভ করেছিলেন তারাশঙ্কর। উমাশশীর হাতে এটা ছিল তুরুপের তাস, যার সাহায্যে তিনি কন্যাদের বৈষয়িক ভাবে সুরক্ষিত করার সুযোগ পান।

    বড় জামাইয়ের মৃত্যু ওঁদের দু জনকে ভাল ভাবেই ধাক্কা দিয়ে গিয়ে ছিল। দাদুর মৃত্যুর পর থেকে দিদি ক্রমে ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। নিত্য দিনের চাল ডাল তেল নুন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত বিশাল পরিবারের কর্ত্রী, কোন বাহ্যিক কারণে নয়, নিজের ভেতর থেকেই কেমন যেন নিভে যেতে থাকে। কথাবার্তা খুবই কমে যায়, যা ও থাকে তা অবৈষয়িক, অসলগ্ন আর অস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। বিগত যুগ আর সেই যুগের মানুষদের কল্পনার মধ্যেই বিলগ্ন হয়ে যেতে থাকে।আর প্রায় কিশোরী অবস্থায় জাত বড় ছেলের আকস্মিক প্রস্থান ওঁকে হতচকিত বিহ্বল করে বাঁচার শেষ অবলম্বনটুকুও কেড়ে নিয়ে ছিল। ১৯৭৮ সালে ১০ই আগস্ট সারা দিন কোমায় থাকার পর বেশ রাত্রের দিকে যখন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয় দিদি তখন শুয়ে পড়েছিল, তাই জানানো হয়নি। পরের দিন সকালে জ্যেষ্ঠ সন্তানের মৃত্য সংবাদে আজন্ম গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসী ব্জ্রাহত মা’র উক্তি, ‘’সে কি মা যে বল্ল ‘যা, তুই শুতে যা; কাল সকালে গলা খাঁখারি দিয়ে দাঁত মাজার আওয়াজ শুনতে পাবি।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *