।।প্রেম যখন গণিত – প্রেমিকা লীলাবতী।।

লিখেছেন – সত্যব্রত বিশ্বাস, সুইজারল্যান্ড থেকে ।।

ছোটবেলায় প্রত্যেক পরীক্ষার আগে রীতিমতো তৈরী হতে হতো রচনা লেখার জন্য। রচনা, সে বাংলাতেই হোক বা ইংরেজী, আমার পান্ডিত্ব ছিল অসাধারণ। কোনোদিনই ঠিক বাগে আনতে পারিনি,চেষ্টার কোনো ত্রূটি অবশ্য রাখিনি। রথের মেলা থেকে ইন্ডিয়ার ক্রিকেটে বিশ্ব-বিজয় কোনোটাই ছাড় ছিল না।চেষ্টার দমফুরানে সেই একান্ত মরীয়া হয়েই ফিরে গেছিলাম সেই চিরাচরিত গরুর রচনায়। স্যারেরাও কম গোঁযার ছিলেন না,দিয়েছিলেন বাঙালির উৎসব নিয়ে রচনা লিখতে, কোনো ক্রমে গোমূত্র সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো।

সেই রচনাময় দৈনতার দিনেও একমাত্র শান্তি ছিল গণিত, কেশব মাস্টারের সেই বাঁশে চড়া বাঁদরের বাঁদরামি ক্রমশঃ মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে যাচ্ছিল। সেই সময় হটাৎ করেই পরিচয় লীলাবতীর সাথে, আকস্মিক পরিচয় ক্রমশঃ মায়াময় হয়ে উঠছিলো।সদ্য ইংরেজী শেখা মানুষের পক্ষে ইংরেজিতে যোগাযোগ করা যে কতটা কষ্টের সে যারা ষষ্ট শ্রেণী থেকে ‘এ’,’বি’ বলেছে বা শিখেছে তাদের বলার দরকার পরে না। মুশকিল হলো লীলাবতী তখনও বাংলা বলে না, হয় ইংরেজি নয় তো হিন্দি, এছাড়া সংস্কৃত বা উর্দুও চলতে পারে। ভেতো বাঙলির কাছে তখনও একমাত্র সহজ সরল ভাষা বলতেই ছিল বাংলা।

লীলাবতীও নামের সাথে সাজুস্য রেখেই ছিল লীলাময়, কখনও কৌতুক, কখনও গম্ভীর কখনও বা চিন্তাময়।অদ্ভুত জীবন এই লীলাবতীর, বোধহয় বাবা বড়ো গণিতজ্ঞ বা জ্যোতিষশাস্ত্রবীদ হলে এরকম হয়। বাবার জ্যোতিষ আর গণিতের যোগফলে বিধান এলো লীলাবতীর কোনোদিন বাচ্চা হবে না এমনকি বিবাহও হবে না। অংক কষে বের হলো বিবাহের সময়।একদম সঠিক সময় জ্ঞানের জন্য তৈরী হলো জল ঘড়ি। খুব সাধারণ ইঞ্জিনীরিংয়ে একদম নিখুঁত মাপের ছিদ্র একটা পেয়ালায়, ডুবিয়ে দেওয়া হলো পাত্র ভর্তি জলে। মাহেন্দ্রক্ষন বের করার কারণে লীলাবতীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল শৈশবেই। 

স্বাভাবিক কারণেই জলঘড়ির সামনে লাগানো হলো সতর্কীবার্তা লীলাবতীর জন্য, কোনো কারণেই যেন লীলাবতী এই জলঘড়ি স্পর্শ না করে।অসম্ভব বুদ্ধিমতী, গুণবতী আর সুন্দরী লীলাবতীর বিয়ের সানাই বেজে গেলো, শুরু হয়ে গেলো খোঁজ সৎ পাত্রের। কমবয়েসী লীলা বিয়ে ব্যাপারটা না বুঝলেও শিশুর মন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো, যাকেই দেখে তাকেই বলে, জানো আমার বিয়ে হবে খুব শিগগিরই, নতুন পুতুল খেলার সঙ্গী পাবে ভেবে লীলার  লীলা বেড়ে গেলো।

আমার অংকের পান্ডিত্ব আর হামবড়াইয়ে অতিষ্ঠ হয়ে,আমার বুদ্ধি পরীক্ষার জন্য লীলাবতী হটাৎ করেই একখানা সাধারণ প্রশ্ন সামনে রাখলো, অংকটা সামনে পেয়ে বেশ সহজ অংক হিসাবেই দেখলাম, আসলে লীলার কাছ থেকে এরকম অংক পাবো আশা করিনি।

এক তীর্থযাত্রী ভ্রমণ করার সময় তার সম্পূর্ণ অর্থ থেকে অর্ধেক প্রয়াগে দান করলেন।কাশীতে ভ্রমণরত অবস্থায় অবশিষ্ট অর্থ থেকে নয় ভাগের দুই ভাগ দান করলেন।কর প্রদয়ের কারণে অবশিষ্ঠাংশের এক চতুর্থাংশ ব্যায় করলেন।গয়া প্রদক্ষিণ করার সময় বাকি অর্থের ১০ ভাগের ৬ ভাগ দান করলেন।বাড়ি ফিরলেন তীর্থযাত্রী হাতে ৬৩ টাকা নিয়ে।তীর্থযাত্রী তাহলে কত টাকা নিয়ে ভ্রমণ শুরু করেছিলেন?

সেই সময় অংক দেখলেই মাথা কাজ করতো ভীষণ সহজ সরল ভাবে, শুরুতেই লেখো ধরা যাক অমুক “X” আর শেষ করা যে ভাবেই হোক hence proved লেফ্ট হ্যান্ড সাইড = রাইট হ্যান্ড সাইড। এখানে দ্বিতীয় সম্ভবনা না থাকায় যথারীতি শুরু করলাম, ধরা যাক তীর্থযাত্রীর কাছে শুরুতে টাকা ছিল x, এটুকু লিখেই বেশ পরিতৃপ্তি পেলাম। এরপর অংকটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেলাম।

১।প্রয়াগের পর টাকার সংখ্যা, X/২

২। কাশি তে অর্থদানের পর পরে রইলো, x/২-(x/২*২/৯)= x/২-x/৯ = ৭/১৮X। 

৩।কর প্রদাণের পর পরে রইলো , ৭/১৮x – ৭/১৮x*১/৪ = ৭/১৮x- ৭/৭২x = ২১/৭২x =৭/২৪X।

৪। এরপর গয়াতে ৬/১০ দেওয়ার পর থাকে ৭/২৪x -৭/২৪x*৬/১০ = ৭/২৪x-৭/৪০x = ১৪/১২০X = ৭/৬০X।

৫। সুতরাং ৭/৬০X = ৬৩ এবং X = ৬৩*৬০/৭ = ৫৪০। 

লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম এর চেয়েও সোজা উপায় হয়। সেই প্রথম শিখলাম বিনা “X” এও অংকের উত্তর বের করা সম্ভব।

১। গুনফল (ডিনোমিনেটর – নিউমারেটর ) = (২-১) * (৯-২) * (৪-১) *(১০-৬) = ১*৭*৩*৪ = ৮৪ 

২। গুনফল ডিনোমিনেটরের = ২*৯*৪*১০ = ৭২০ 

৩। মূল অর্থ ছিল শুরুতে ৬৩/(৮৪/৭২০)= ৬৩*৭২০/৮৪ = ৫৪০ 

কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না, তিন লাইনে এতো সহজেই উত্তর বেরিয়ে গেলো। লীলাবতী মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছিল আমার সাথে ছেলেখেলা করবে। আমার অংকের দৌড় একেবারেই শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছায় আমার সামনে রাখলো একটি অতিসাধারণ দেখতে একটি অংক।

দুটি একদম সোজা বাঁশ মাটিতে পোঁতা রয়েছে। একটার উচ্চতা ১৫ মিটার আর অন্যটির ১০ মিটার।দুটো নারকেল দড়ি মাথায় আর নিচে বাঁধা রয়েছে, কোনাকুনি করে। দড়ি দুটো যেখানে কেটেছে সেটার জমি থেকে উচ্চতা কত?

বাঁশের ব্যাপারটা শুনেই হটাৎ করে কেশব মাস্টারের কথা মনে পরে যাচ্ছিলো, এটাও বুঝছিলাম লীলাখেলা আমার সাথে ভালোই চলছে। সবচেয়ে অবাক লাগলো মাত্র দুটো বাঁশের উচ্চতা থেকে আমি অংকটা করবো কি করে? অংকটা আমার কাছে নির্ভেজাল ভুল লাগছিলো। লীলাবতীর আশ্বাসনে বুঝলাম অংকে ভুল থাকতেই পারে না। সেই সময় আমি স্লোপ ইন্টারসেপ্ট ফর্ম বা y = mx + c জানতাম না, তখনও আলজেব্রা শিখছি ভালো করে। স্বাভাবিক ভাবেই জিওমেট্রি লাগিয়ে লড়াই শুরু করলাম, প্রায় ২ – ৩ ঘন্টার প্রচেষ্টায় উত্তর বেরোলো, ৬ মিটার।

স্বাভাবিক ভাবেই একটা হিরো হিরো ভাব এসে গেছিলো, দিলাম তো সলভ করে গোছের একটা ভাব। লীলাবতীর সেই বক্র, ক্রুর আর কৌতুক পূর্ণ হাসি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, ভাবছিলাম এছাড়া আর কোনো উপায় আছে কিনা। সেই প্রথম জানলাম হার্মোনিক মিনের কথা, পরে ১১-১২ ক্লাসে হার্মোনিক প্রোগ্রেশন পড়েছিলাম। কনসেপ্টটা তৈরী করে দিয়েছিল লীলাবতীর লীলা।

উত্তরটা এক লাইনে, 1/h =1/h1 + 1/h2 আর সংখ্যায় ৬।

যাকগে অংক থেকে ফিরে আসি আবার লীলাবতীর বিয়ের কথায়। লীলাবতীর বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকলো এক নাগাড়ে, পছন্দও করা হলো একজনকে। লীলাবতীর মতন সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতীর জন্য পাত্র জোগাড় করা বেশ সহজসাধ্যই ছিল।জাঁকজমকের সাথে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো, বিবাহের সরঞ্জাম, বিবাহের জন্য মতি লাগানো সুন্দর পোশাক আর নিমন্ত্রিতদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা।

স্বাভাবিক ভাবেই ছোট্ট মিষ্টি লীলাবতীর মন খুশিতে নেচে উঠলো, সারা ঘরময়, পাড়াময় নেচে নেচে ঘুরতে লাগলো। সুন্দর মুক্তো লাগানো শ্বেতশুভ্র পোশাক পরে বারবার আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। মাহেন্দ্রক্ষণ বলা জলঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে উঠছিলো লীলাবতী, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।আর যে তর সইছে না, অনেক কষ্ট করে লীলাবতী নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছিলো, একদিন ভেঙে গেলো ধৈর্যের বাঁধ।জলঘড়ির সামনে সেই অসম্ভব সুন্দর পোশাক পরে ঝুঁকে দেখলো আর কত দেরি, পোশাকের একটা মুক্ত অজান্তেই সেই পেয়ালায় পরে বন্ধ করে দিলো পেয়ালার ছিদ্র।

সবার অজান্তেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে চলে গেলো, বেশ কিছুদিন পর লীলার বাবার নজরে পড়লো জলঘড়ির খারাপ হয়ে যাওয়া।একটু খুঁজতেই ধরা পড়ে গেলো কারণটাও। লীলার বাবার চেয়েও বেশি ভেঙে পড়লো লীলা নিজে, নিজের বিয়ের সঙ্গে একটু বেশি মিশে গেছিলো। সেই ছোট্ট লীলা একদৌড়ে ছাদে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। লীলার বাবা ছাদে সেই ছোট্ট মেয়েটার দুঃখে নিজেকে হটাৎ করেই ভীষণ অসহায় মনে করতে লাগলো, কি ভাবে সান্ত্বনা দেবে ছোট্ট মেয়েটাকে।

লীলাবতীর একটি পাতা

আস্তে আস্তে লীলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে লীলার পিতা ভাস্করাচার্য্য আশ্বাস দিলেন, তোর নামে আমি নিজে বই লিখবো। সারা পৃথিবী ওই অংক বইয়ের জন্যই তোকে মনে রাখবে, মনে রাখবে তোর বুদ্ধিমত্তা আর তোর নামের বইটিকে।ভাস্করাচার্য্য মাত্র নিজের ৩৭ বছর বয়েসে লিখলেন সিদ্ধান্ত শিরোমনি, ৪টি গ্রন্থের সমন্বয়ে। লীলাবতী,বীজগণিত,গ্রহগণিত আর গোলাধ্য, সিদ্ধান্ত শিরোমনি লেখা হলো ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে। পাঠ্য পুস্তক হিসাবে সবচেয়ে বেশি দিন ব্যবহৃত এই বইটি। প্রায় ৬৫০ বছর একনাগাড়ে। সমগ্র ভারতে গণিতের পাঠ্য বই হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ইংরেজ আমল অবধি।

আমারও লীলাবতীর কাছে ধীরে সুস্থে অংক শেখার সাথে সাথে ক্রমশঃ অংকের প্রতি প্রেম অনুরাগ জন্মেছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *