বিদেশে দুর্গা

কোলকাতার কোনও কিউ-রিও শপে ঢুকে জিগ্যেস করুন জাপানী দুর্গা পাওয়া যায় কিনা। পেয়ে যেতে পারেন ১৮ হাতের এক দুর্গা মূর্তি। ইনি “জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)”, মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি।

j1

জুনতেই ক্যানন

দুর্গা পূজা আজ সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে। যেখানে বাঙ্গালি, সেখানেই দুর্গা পূজা। কিয়োতো থেকে কানসাস সর্বত্র পালিত হল এই উৎসব। আজকের প্রবাসের এই পূজোর আনন্দ নিতে নিতে আমরা এখানে খুঁজতে চাই ভারতের বাইরে প্রাচীন দুর্গা পূজার ঐতিহ্য।

দুর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল–তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃ-তান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃ পূজার। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্না-র।

e1ইনান্না, দ্বিতীয় সহস্র পূর্বাব্দ, সুমের (ইরাক)

কুশান রাজা কনিস্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনও দেবী চণ্ডী “বিবি নানা” হিসাবে এইসব অঞ্চলে পূজিত হন।

 

শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরন হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০ – ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্।  এই সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলি মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলি একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়।

c1দেবী চণ্ডী

মিং চাইনিজ চিত্রকলা

কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়া দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে।

d1মহিষাসুরমর্দিনী কম্বোডিয়া, ৭০০ অব্দ

অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পরে হিন্দুধর্মের হাত ধরে। এই সময়ের যে দুর্গা মূর্তিগুলি কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, অধিকাংশ চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুরমর্দিনী। মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী যে এখানে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন যা তাঁর চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।

জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিকধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলো মধ্যে প্রাচীনতমর তারিখ অনুমান অষ্টম শতাব্দীর। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎবিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ।

p1প্রাম্বানান মন্দিরে ৯বম শতাব্দীর মহিষাসুরমর্দিনী

১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।

লিখেছেন শ্রীধর আচার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *