দশভূজা

durga2

মা দুর্গা শান্তির বাণী নিয়ে আসেন আমাদের কাছে। দুষ্টের দমন করতে গিয়ে তাঁকে হতে হয়েছে দশভূজা। ধরতে হয়েছে অস্ত। অসুরকে নিধন করলেই তবেই তো শান্তির সুর বেজে উঠবে। অসুর নিধনে মা কোন কোন অস্ত ব্যবহার করেছেন? তাদের পৌরাণিক ব্যাখ্যা কী? এই বিষয়টিতে আলোকপাত করেছেন পুরাণ বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর বসু।

ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়েছে “ত্রিশুল, খড়্গ, চক্র বাণ ও শক্তি তব দক্ষিণে। খেটক, ধনু, পাশ অঙ্কুশ ও কুঠার দেখি বামে।।”(নিজের পূজা নিজে করুন;শ্রী গৌতম কুমাঃ ঝা। গিরিজা লাইব্রেরী, ২০১২ সংস্করণ, পৃ১৪২)

মায়ের ডান দিকে সব চাইতে ওপরের হাতে ধরা আছে ত্রিশুল। এটি তিনটি ধারালো ফলা লাগানো অস্ত্র। তিনটি ফলা রোগ, শোক,ক্ষোভ—এই তিনধরণের দুঃখ দেয়। ‘রোগ’ অর্থে শরীর বা মনের অসুস্থতা জনিত যন্ত্রণা, “শোক” অর্থে প্রিয়জনের মৃত্যু জনিত বেদনা ও ‘ক্ষোভ’ অর্থে আশাহত হওয়ার কষ্ট বোঝায়।

এর নীচে (ক্রমঃ অধৌ…) আসছে খড়্গ –যা মহাকালের অস্ত্র। শিবেরই অন্যরূপ মহাকাল। ‘কাল’ অর্থে সময়;-ভূত- বর্তমান-ভবিষ্যৎ, এই তিনটি ‘কালকে’ একত্রে ত্রিকাল বলে। ভূতকাল অর্থে অতীত- যা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি কিন্তু যাকে বদলাতে পারি না। ভবিষ্যতে কি হবে, তা আমাদের হাতে নেই—যদি থাকতো, তবে কোন দুর্ঘটনাই কখনো ঘটতো না! কাজেই আমাদের হাতে রয়ে গেছে শুধুমাত্র বর্তমান কাল। খড়্গ ‘বর্তমান’ কালের প্রতীক। খড়্গটি তুলে ধরে মা যেন আমাদের বলছেন “এখানকার এই মুহুর্তটাই শুধু তোমার হাতে রয়েছে, কাজেই যা করার তা এখনই করে ফেল”—। খড়্গ পুরুষকারের প্রতীক।

খড়্গের তলার হাতে গোল আকৃতির ধারালো কিনারাওলা চক্র—শ্রী বিষ্ণুর দেওয়া অস্ত্র এটি। নারায়ণ আমাদের পালন করেন; তাঁর হাতে চক্রটি অবিরত একি ভাবে ঘুরেই চলেছে। আমারাও জীবন- জীবিকার জন্য প্রতিদিন একই ধরণের কাজ করে যেতে বাধ্য হই।

চক্রের নীচের হাতে তীক্ষবাণ (বাঁদিকে ধনুক আছে—ধনুক আর বাণ, দুই এ মিলিয়ে একটিই অস্ত্র, পিণাক পাণি মহাদেব এর দান তীর ধনুক মনে করিয়ে দিচ্ছে, জীবিকার জন্য যে কাজি করে চলি না কেন, জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য যেন থাকে। যার জীবনের কোন দিক নেই, কোনকিছু চাইবার—পাওয়ার –অর্জন করার নেই, সে প্রকৃত অর্থে হতভাগ্য। জীবনে রোগ শোক ক্ষোভ থাকবে, রুটিন মাফিক একঘেয়ে কাজ থাকবে তবুও বৃহৎ কোন লক্ষ্য রাখতে- হবে—দেবীর ডান হাতে অস্ত্রের ক্রম এই কথাই বলছে। সবচাইতে নীচের হাতে আছে “শক্তি”। এটি লোহার তৈরী, বর্শার মতন ছুঁড়ে মারতে হয় দুই হাত তুলে। বহুদূর ছুটে যেতে পারে এই “শক্তি”- তবে যেহেতু নিক্ষেপ করা হয়, তাই এটি “শস্ত্র” পদ-বাচ্য(ত্রিশূল, গদা, খড়্গ ইত্যাদি যেগুলি নিজের হাতে ধরা থাকে তাকে অস্ত্র বলে; চক্র, বল্লম ইত্যাদি) যে গুলি দুর থেকে ছোঁড়া হয় সেগুলিকে ‘শস্ত্র’ বলা হয়। তীরশস্ত্র কিন্তু ধনুক অস্ত্র)। “শক্তি” দৈবকৃপার প্রতীক—এটি ছুঁড়ে দিয়ে ভক্তর বাধা-বিঘ্ন গুড়িয়ে দেন মা।

এবার দেখা যাক মায়ের বাম দিকে কী কী আছে। নারীদের ‘বামা’ বলা হয়, তাঁদের বাঁদিক বেশী কল্যাণকরী বলে। মায়ের বাঁদিকে সরস্বতী ও কার্তিক থাকেন। সবচাইতে ওপরের হাতে আছে খেটক অর্থাৎ ঢাল। বাঁপায়ের তলায় মহিষাসুরকে চেপে রেখে ধরে মা ভক্তদের অভয় দিচ্ছেন। তার নীচের হাতে ধরা ধনুক। শিবের ধনুকের নাম পিণাক—এটি দিয়ে শিব যুদ্ধের সময় তীর ছুঁড়তেন আর অন্য সময় একতারার মতো টুং টাং করে বাজাতেন। তাই মায়ের হাতে ধরা ধনুকটি ও অনবদ্য—একই আধারে অস্ত্র ও বাদ্যযন্ত্র!

এর নীচের দুটি হাতে আছে পাশ ও অঙ্কশ। ওয়েস্টার্ন সিনেমায় কাউবয়দের ল্যাসো ছুড়তে দেখা যায়, পাশ অস্ত্রটি অনেকটা সেই রকম। এটি ত্রিশগাছি দড়ির তৈ্রী, গোল করে গুটিয়ে কোমরে জড়িয়ে রাখতে হয়; শত্রুকে ফাঁসে বেঁধে ফেলার জন্য গোড়াটি নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখে, দড়িটা মাথার ওপর তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছুঁড়তে হয়। দড়ির আগার দিকে সাপের জিভ এর তীক্ষ্ণ ফলা থাকে বলে এটিকে নাগপাশ বলে। (প্রচলিত দুর্গামূর্তিতে এই নাগপাশকে সত্যকার সাপের মতো বানানো হয়)।

মায়ের হাতে পাশ থাকলে অঙ্কুশও থাকে হবে। মাহুতরা অঙ্কুশ ব্যবহার করে হাতিকে চালানোর জন্য—এটি অস্ত্র বা শস্ত্র, কোনটাই নয়। তাহলে অঙ্কুশ দিয়ে মা কি করছেন? মায়ের নাম মহামায়া—তিনি মানুষকে বদ্ধ করেন, ভুলিয়ে রাখেন রূপ-ধন-যশ- শত্রুদমন-জয়গৌরব-দিয়ে। সাধারণ মানুষ মাকে চায় না, মায়ের ঐশ্বর্য্য চায়—তাই বারবার জন্ম-মৃত্যু-পুর্ণজন্মের শৃঙ্খল তারা বন্ধ হয়ে থাকে। তাই মায়ের হাতে পাশ। আবার তিনিই মাঝে মাঝে অঙ্কুশ এর খোঁচা মেরে মনে করিয়ে দেন, “মানুষ জন্মের আসল উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ।” মহামায়া রূপে যিনি পাশবদ্ধ করেন, যোগমায়া রূপে তিনিই মুক্তি পথে চালনা করেন।

এই বার আসি বাঁদিকের একদম নীচের হাতে। এই হাতে ধরা ‘পরশু’ অথবা কুঠার। এটি অত্যন্ত ধারালো অস্ত্র—এহাত লম্বা দন্ডের মাথায় লাগানো হয়ে অর্ধচন্দ্র আকৃতির তীক্ষধার ফলা। পরশুরাম এই অস্ত্র দিয়েই লড়াই করতেন। মায়া বলতে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি স্বার্থযুক্ত ভালোবাসা বোঝায়।  মায়ার বাঁধন কাটা সহজ নয়—“জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই; ছাড়াতে গেলে ব্যাথা বাজে।” এই মায়ার বন্ধন এক কোপে কেটে দেওয়ার জন্যই মা কুঠার হাতে নিয়েছেন। কুঠার বৈরাগ্যর প্রতীক।

পরিশেষে বলি, প্রতিমা গঠন করা উচিৎ ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী। বেলুড় মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসী স্বামী অচ্যুতানন্দজী তাঁর শ্রী শ্রী দুর্গাঃ তত্ত্বে ও কাহিনীতে (প্রকাশক দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড) গ্রন্থে ধ্যানমন্ত্রের একটি সার সংক্ষেপ দিয়েছেন” অতসীফুলের মতো গাঁয়ের রং দশভুজা এই দেবীর দশহাতেই অস্ত্র। ত্রিশুল-খড়্গ-চক্র-তীক্ষ্ণ বান-শক্তি ডান হাতগুলিতে। বাম হাতে ঢাল-ধনু-নাগপাশ- অঙ্কুশ- ঘণ্টা বা পরশু। তিনি মহাসিংহের পিঠে ডান পা ও মহিষাসুরের ডান কাঁধের ওপর তাঁর বামচরণের বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে আছেন। ত্রিনয়না দেবীর শিরে জটাজুট ও তাতে অর্ধচন্দ্র শোভিত। নানা অলঙ্কার বিভূষণা ও রক্তবস্ত্র পরিহিতা দেবীকে ঘিরে আছেন তাঁর উগ্রচন্ডা-প্রচন্ডা প্রভৃতি অষ্টশক্তি।”

(পৃঃ ৫৭, ২০০৭ সংস্করণ)

দুর্গা পুজার সময় এই ধ্যানমন্ত্র বারবার উচ্চারিত হয়।

চন্ডীপাঠ দুর্গাপূজা সহ সমস্ত শক্তিপূজাতেই করা হয়। কিন্তু শ্রীশ্রী চন্ডীর দেবীর- যুদ্ধ সজ্জার বর্ণনার সাথে ধ্যানমন্ত্রের পুরোমিল নেই। দেবতারা যুদ্ধের আগে দেবীকে যে সব অস্ত্র-শস্ত্র দিয়েছিলেন, তার অনেকগুলিই ধ্যানমন্ত্রে উল্লেখ করা হয়নি। তাই অনেকে দেবী প্রতিমায় তরবারি,শঙ্খ, গদা, কালদন্ড, কমন্ডুলু ইত্যাদি সংযোজন করেন। কিন্তু দেবীর হাত যেহেতু দশটি, তাই ধ্যানমন্ত্রে উল্লেখিত কিছু অস্ত্রের বদলে এগুলিকে আনতে হয়। দেবী নিজে বলেছেন— যখন যে ভক্তসাধক আমাকে যেভাবে আস্বাস করতে চায়, আমি সেই মূর্তিতেই তাঁকে কৃপা করি।…

মাকে যে যেভাবে চায়, সে সেইভাবেই পায়। মা ভোগ ও মুক্তি, উভয়ই দিয়ে থাকেন(ভক্তের চাহিদা অনুযায়ী)। তাই ডান দিকের হাত- গুলি দিয়ে তিনি ইহকাল-পরকালে সুখদেন আর বাঁদিকের হাতগুলি দিয়ে মোক্ষদ্বার এর দরজা খুলে দেন। কিন্তু ভোগ ও যোগ ছাড়া আরও একটি দেব-দুর্লভ বস্তু তিনি দিতে পারেন—তা হলো ভক্তি। মায়ের হাতে পদ্মফুল ধরিয়ে দিলে তিনি “ক্যাতায়নী” রূপে ধারণ করে ভক্তি অমৃত দান করেন।

#

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *