মানুষ হবার প্রথম পদক্ষেপ

সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে সুযোগ্য পুত্র সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

          ১৯৬৭ সালের গরমের ছুটিতে সদলবলে শিলিগুড়ি যাওয়া ঘটেছিল। বেডিং এর সঙ্গে  বাঁধা হয়ে বইপত্তরও গিয়েছিল ট্রেনে চড়ে, তবে পড়াশুনো হয়েছিল অল্পই। মামারবাড়ির বিশাল বাগানে নানা ধরনের স্ব-উদ্ভাবিত খেলা আর ভালোমন্দ ভোজনের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো যেন উড়ে চলেছিল। এরই মধ্যে বড়োদের কিঞ্চিৎ উতপ্ত আলাপচারিতায় জানতে পারলাম কোথায় যেন হাটে কি সব গন্ডগোল হয়েছে, ‘সোনাম ওয়াং ধি’ বলে একজন পুলিশ অফিসার হাটুরে লোকজনের আক্রমনে মারা পড়েছেন, আর তাঁরই এক সহকর্মী ‘বাহে’দের তীরে বুকে আঘাত পেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন বুক পকেটে সোনার সিগারেট কেস থাকার দৌলতে, হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। নিজেদের খেলার ঝোঁকে কে আর ও সব নিয়ে মাথা ঘামায় ? পরের দিন দেখলাম হিল কার্ট রোড বেয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে পুলিশের শোভাযাত্রা সহকরে দেহগুলি শেষকৃত্যের জন্যে নিয়ে গেল। মায়ের কাকাদের আলোচনার সুত্রে জেনে ছিলাম ওয়াং ধি ভদ্র পরিবারের সন্তান, স্ত্রী ডাক্তার, ছেলে মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ে, উনি চাকরি করতেন প্রায় সখের জন্যে। কিন্তু  সে সব কিছুতেই বিশেষ কোনো ভাবান্তর হবার মন সে দিন কোথায় ? শিলিগুড়ি থেকে ফিরতে সে বার খুবই মন খরাপ হয়েছিল। বেশ কিছু দিন ছাড়া গরু হয়ে থাকার পর আবার নিত্যকার জীবনে ফিরে আসার বিরক্তি আর কি। তবে কিছু দিন পর থেকে কানে আসতে লাগল ঐ দিনের ঘটনার অপরিসীম তাৎপর্য। আর এরও কিছু দিন পরে নকসালবাড়ি ফলশ্রুতি ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলের জীবনের ওপর।   

       ফিরেই হাফ্‌ ইয়ার্লি পরীক্ষা, তারপরের ক্লান্তিকর মাসগুলো পার করা পূজোর ছুটির প্রত্যাশায়। পূজোর সময়টায় লাভপুর যাওয়া বেশ অনিশ্চিত, বাবার ছুটি, মায়ের তহবিলের হিসেব ইত্যাদি অনেক কিছু পার হয়ে তবেই ট্রেনের গ্রীন সিগন্যাল পড়ত। যাওয়া না যাওয়ার দোলায় দুলতে দুলতে দানাপুর র্ফাস্ট প্যাসেঞ্জা্রের তৃতীয় শ্রেণীর জানলা দিয়ে বাইরের শরৎ প্রকৃতির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিস্ফারিত চোখে শুষে নিতে গিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্‌গারিত ধোঁয়া বিসর্জিত কয়লা কুঁচি আক্রান্ত চোখ কচলাতে কচলাতে  অবশেষে ছোট-লাইনের ন্যারো গেজ ট্রেন গিয়ে থামত শান্ত স্টেশনটাতে। তখনও পর্যন্ত অনেক অদল বদল,উত্থান পতনের মধ্যেও গ্রামের যে সব মানুষ কাজ কর্ম পেশা শিক্ষা ইত্যাদি নানা সুত্রে সারা বছর বাইরে কাটাতেন তাঁরা পূজোর সময় স্বগ্রামে ফিরতে চেষ্টা করতেন। চেনা পরিচিত প্রায় সব বাড়ির লোকজন স্টেশনে আসতেন। নিজেদের যারা যারা ফিরেছে তাদের প্রত্যুদ্‌গমন করতে। তারপর কে আগে এসে গেছে, কে কেন আসতে পারল না, কবে নাগাদ আসতে পারে এই কথায় গ্রামের পথে মশগুল হয়ে পর্যালোচনা করতে করতে বাড়ির পথ ধরা। আমরা দৃশ্যতই গ্রামের লোক নই তাই বাবা কাকাদের ঐ কথাবার্তাগুলো শুনে বেশ আশ্চর্য লাগত। বাপ রে বাপ কতগুলো কাকা, তারা আবার কতজন কাকার খবর দিচ্ছে, নিচ্ছে ! দাদুর তিন ভাইদের মধ্যে পৈত্রিক সম্পত্তি বিভাজনের পর আমাদের সাত-আনিদের (বৃদ্ধ প্রপিতামহের আমলে পৈত্রিক সম্পত্তি ন-আনা ও সাত আনা হিস্যায় ভাগের দরুণ আমাদের গোষ্ঠিটির গ্রামীন পরিচিতি) তিন পুরুষের বৈঠকখানা বাড়ি পড়ে দাদুর ভাগে। রাস্তার অন্য দিকে মূল বাড়িটির সংলগ্ন বিস্তৃত একটি চত্তরের (চলতি কথায় সদর) একদিকে দূর্গাবাড়ি কালীবাড়ি, উল্টো দিকে লক্ষীজনার্দনের মন্দির, শিবের মন্দিরই পাঁচটা, মাঝখানে প্রশস্ত টিনে চারচালা, যেখানে বলি দেয় কেলে মাঝি আর তার ছেলে জিতু। পাঁঠা বলি নিয়েও কত গপ্প, পাঁঠা কাটতে কাটতে নাকি মাথায় এমন খুন চড়ে যায় যে একটা সময়ের পর যাকে সামনে পায় তার গলাতেই খাঁড়ার চোপ দিয়ে দেয় ওরা বাপ ব্যাটায়। ওরা না কি পাঁঠার রক্ত খেয়ে বলি দেবার মুড আনে—এই রকম আরোও কত কি।

    আগেই বলেছি পরিবারের তরফ থেকে গ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে দেবার সক্রিয় চেষ্টা বিশেষ ছিলনা। যা হয়েছে সেটা শহরের রুটিন বাঁধা জীবন থেকে বার হতে পারার তাগিদে। এর আগেও লাভপুরে এসেছি বার কয়েক,পল্লীগ্রাম দেখার অভিজ্ঞতাহীন—এমন নয়। ১৯৬৬ সালেই কাকা পিসিদের বিয়ে উপলক্ষ্যে প্রচন্ড গরমের মধ্যে আসা হয়েছিল। কলকাতায় সন্ধ্যেবেলায় সুন্দর যে হাওয়া বয়, ওখানে নিরন্ধ্র গুমোট, সকাল দশটার মধ্যেই কুয়োর জল শুকিয়ে  কাদা ওঠে। আমাদের তাতে ফুর্তির কমতি হয়নি। পুকুরে চান আর রোদের মধ্যে খেলে বেড়িয়ে প্রচুর ঘামাচি আর অনেক আনন্দ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।  কিন্তু এই পর্যায়ে (অর্থাৎ ১৯৬৫-৬৮ সালের মধ্যে) পর পর বেশ কয়েক বছর পূজোর সময়ে আসার ফলে সেই বয়েসের চোখ দিয়ে যা প্রাণের মধ্যে ঠাঁই নিয়েছিল তা রূপ রস গন্ধে শব্দে টইটম্বুর। শহরের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তফাৎটা লাগত কানে, নিরবচ্ছিন্ন শব্দহীনতায়। দূরাগত কোনোও যান্ত্রিক শব্দের চাপা গুঞ্জন এখানে শ্রবনেন্দ্রিয়কে পীড়িত করেনা। সে নৈশব্দ্য থেকে থেকে ধাক্কা খেতো শাল পুকুর থেকে ভেসে আসা হাঁসের ডাক, গরুর হামলানোয়, কচিৎ কাদাচিৎ কারো টানা টানা ডাকে আর সন্ধ্যেবেলায় কুলায় প্রত্যাগত পাখ পাখালীর কলকাকলীতে। কলকাতায় জল দেখতে গেলে হাঁটতে হয় খানেক  দূর, আর লাভপুরে চোখ মেললেই শাল পুকুরের জলে বৃষ্টিধৌত গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শরৎ রৌদ্রের নাচানাচি চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে যায়।আর রাত্রে সে কি অন্ধকার! আকাশে যে এতো তারা আছে ওখানে না গেলে জানতাম না, সে যেন তারার ভারে মাথায় ভেঙ্গে পড়ছে মনে লাগত। ওখানকার আকাশগঙ্গা্তেই প্রথম এ চোখ স্নান করেছিল। ধূলো ধোঁয়া বিহীন দেবী পক্ষের সপ্তমীর সকালে গ্রামের চারটি পূজোর ঘট ভরাতে দোলা বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো লাইকারা বলে জলাশয়ে; নতুন যাদের পৈতে হয়েছে তাদের দায়িত্ব ছিল দোলা বওয়া। সেখানে ঢাক ঢোল কাঁসি সানাই বাজিয়ে নব পত্রিকার বোধন হতো। বড় বড় ধুনুচির ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যেত পুকুরের জলজ গন্ধ। ঐ সব ছাড়া গ্রামের নানা প্রান্তে মিলত গোবর আর ঘুটে,পাতা ও কাঠ পোড়ানো ধোঁয়ার সঙ্গে পুকুর পাড়ে মাছের জালের ঘ্রান। পূজোর আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা ছিল না বিশেষ, সদরে অর্থাৎ স্থায়ী পূজো পন্ডপে ভীড় জমাতাম কেবল বলিদান, আরতি, স্তবপাঠ আর ভোজ খাওয়া উপলক্ষ্য্ করে। আগে শুনেছি পূজোর চার দিনই ভোজ হতো, আমরা যখন দেখেছি তখন হতো দু দিন। প্রতিবেশী দুই বাড়ুজ্জে পরিবার প্রতি বছর পল্টাপাল্টি করে ষষ্ঠি-অষ্টমী অথবা সপ্তমী-নবমী পূজোর দায়িত্ব পেতেন। ভোজের নেমন্তন্ন ছিল পুরোনো কালের অনুসঙ্গবহ। আমন্ত্রণকারী পরিবারের তরফে এক ব্যক্তি বাড়ির দরজায় মুখস্ত বলার মতো বলে বলে চলে যেতেন, “ব্রাহ্মন সধবাবর্গ, আগত্‌ (অর্থাৎ ঐ দিন বাড়িতে আগত কোনোও অতিথি বা আত্মীয়) স্বাগত্‌দের ডাক নেমন্তন্ন।”  এই ‘ডাক’ এর আবার তাৎপর্য হচ্ছে উদ্দিষ্ট দিনে বাড়ির সামনে দিয়ে যখন ‘ডাক ডাক’ বলে হেঁকে যাবে তখন যেন নিজে থেকে যেন খেতে যেয়ো বাপু গোছের আহ্বান।  আজকাল টেবিল চেয়ারে বসে ক্যাটারিংএ খাবার অন্তে গরম জলের বৌলে আঙুল ডুবিয়ে কাগজের ন্যাপকিনে হাত মুছে যাঁরা অভ্যস্ত তাঁদের কাছে ঐ ভোজ খাওয়া দৃশ্যত ও কার্যত দুর্বিসহ। দুটি পরিবারের সদরে বিশেষ ঝাঁটপাটের বালাই ছিল না, সেখানে সানের ওপর কোনও আসন ছাড়াই আসন পিঁড়ি হয়ে বসে শালপাতায় খাওয়া হত, যার ছিদ্র পথে অনেক তরলই মাটিতে বয়ে যাওয়ার সু্যোগ পেত। জল খাবার জন্যে মাটির খুঁড়ির ব্যবস্থা ছিল না। কেউ কেউ দেখতাম কাঁসা কি এ্যালমুনিয়াম (তখনো স্টেনলেস্‌ স্টীল ওঠেনি) -এর গেলাস আনত,ফেরার সময়ে না-খেতে পারা ব্যাঞ্জন বা মিষ্টি তাতে ভরে নিয়ে যেত। কারো কারোর দেখতাম পাতের পাশে আরেকটা পাতা বিছানো থাকত, সেখানেও সমান ভাবে অন্ন ব্যাঞ্জন পরিবেশিত হতো, যা ছিল উপস্থিত হতে অসমর্থ পারিবারিক সদস্যদের ভাগ, যা নিয়ে যাওয়া কোনো অসন্মানের ব্যাপার ছিল না।  ভাত পরিবেশিত হবার বেশ কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর আসতো পাতলা ডাল, কচুর শাক, ডিঙিলীর তরকারী, বেগুনের ঘন্ট, নিজেদের পুকুর থেকে সে দিনের ধরা মাছের কালিয়া, বলি দেওয়া পাঁঠার ঝোল, দুধভাত—ওরফে পায়েস, মিষ্টি (পৈতে হলে দুটো না হলে একটা)। এরপর ঘটত খুব মর্মান্তিক একটি ব্যাপার—খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই এঁটো পাতের ওপর ঝাপিয়ে পরত বাউড়িদের বাচ্চা ছেলে মেয়েরা আর কুকুরের দল। তারপর একটি মাত্র টিউবোয়েলে লাইন দিয়ে অথবা পুকুরের জলে মুখ ধুয়ে গরমে ঘামতে ঘামতে বাড়ির পথ ধরা।

         আজ পিছন ফিরে স্মরণ করতে পারি পুরোনো সামাজিকতার শেষ কিছু অনুসঙ্গবহ ব্যবস্থাকে- —যা সেই সময়েও অব্যাহত থাকতে দেখেছিলাম। মনে পরছে দূর্গা ঘরে পূজো চলা কালে উল্টো দিকে পঞ্চ শিব মন্দিরের বাঁধানো চাতালে পর পর বসে গেছে তাস খেলার গ্রুপ, কোথাও চলছে নিছকই আড্ডা—প্রবাসী নিবাসী মিলে মিশে একাকার। বিকেলের দিকে প্রবাসী বনাম নিবাসীদের ফুটবল খেলাও হতো বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে। গ্রাম থেকে বিদায় নেবার আগে একটি কৌতুকময় ঘটনার উল্লেখ করা যাক। দেবী দূর্গার আরাধনায় ‘যোগিনীর পাতা’ বলে একটা পর্ব আছে, জানিনা সেটা একান্ত ভাবেই স্থানীয় কোনো প্রথা কিনা ?  মা যেহেতু বৈষ্ণবী/ব্রাহ্মণী—তাই তিনি শুদ্ধ শাকাহারী। তাঁকে নিরামিশ ভোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর সঙ্গে শিবের যে চেলা চামুন্ডরা আসে তারা নন্‌ ভেজিটেরিয়ান—তাদের সন্তুষ্ট করতে আমিষ পরিবেশন করাই প্রথা। প্রতি দিন তাই যোগিনীদের জন্যে তেরটি পাতায় মাছ মাংসের ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগ প্রসাদ গ্রহনের পর যোগিনীদের উচ্ছিষ্ট ঐ আমিষ পরিবেশিত পাতাগুলি আর গৃহস্থের বাড়িতে ফেরৎ নিয়ে যাওয়া যায় না, ওখানেই অর্থাৎ সদরেই যে চাইবে তাকেই বিলি করে দেওয়া যায়, যে কেউ আবার ইচ্ছা করলে তা নিয়েও নিতে পারে। তবে পূজোর যিনি পরিচালক, আজকে ভাষায় যাদের এঙ্কার বলা হয়ে থাকে, এগুলো তিনিই পেয়ে থাকতেন। আমার পরের ভাইটি কি জানি করে এই বিষয়টি জানতে পারে এবং আমাদের জানায়। ফলে সদলবলে আমরা (অর্থাৎ কলকাতা প্রবাসী ও গ্রাম নিবাসী সমবয়সী ছেলের দল) তাক করে রইলাম যোগিনীর পাতা তুলতে। পরিচালক মশাই এতগুলি নতুন দাবীদারের সামনে তাঁর দীর্ঘ দিনের স্বাধিকার ভঙ্গ হতে চলেছে দেখে পুরোহিত মশায়ের নিবেদন শেষ করার আগেই তল্পিতল্পা সামলাতে নেমে পড়লেন। আর আমাদের সম্ভাব্য সুযোগ হাত ফস্কে যায় দেখে সদলবলে দূর্গা বাড়িতে ঢুকে যে যতগুলি পারে যোগিনীর পাতা তুলতে চেষ্টা করলাম। বেঁধে গেল ধাক্কা ধাক্কি টানা হেঁচড়া, প্রসাদি অন্নে গোটা ঘরটায় নোংরা হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে ঐ বয়সের ছেলেপিলেদের কাছে কিছু খেতে পাওয়ার চাইতেও এটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা এ্যাডভেঞ্চারের মতো। গ্রাম নিবাসী ছেলের দল হয়তো এত দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে পরিচালক মশায়ের চক্রটি ভাঙতে না পেরে আমাদের সাহায্য নিয়েছিল। আমারাও ভেতরের ব্যাপারটা না বুঝে ওদের গেম খেলেছিলাম। মোটকথা ফল হয়েছিল কিঞ্চিৎ তিরস্কার ভোগ। তবে নিগ্রহটা কিন্তু আশানরূপ হয়নি। বড়দেরও বোধহয়  পরিচালক মশায়ের ঐ কায়েমি স্বার্থ ভাঙ্গার পিছনে মদত ছিল। লাভপুরেই গরুর গাড়ি চড়া আর যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল।

         সময়ের দিক দিয়ে প্রায় সমান্তরাল ভাবে এই পর্যায়ে আরেকটি যে অভিজ্ঞতা জীবনের ঝুলিতে সষ্ণিত হতে হতে চলেছিল—তা হলো মণিমালা সংগঠনের ব্যাপারটি । স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন মন্থনের সুবাদে যে সমস্ত ঐতিহ্য  বা পরম্পরা গড়ে ঊঠেছিল তার একটি ছিল দেশের ভাবী নাগরিকদের শৃখলা পরায়ন ও সৎচরিত্রবান করে তোলা। এর জন্যে ১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি অব্দি পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গঞ্জে একদল নিবেদিত প্রাণ মানুষদের দেখা মিলত, যাঁরা সৎ ও উন্নত বৃত্তির চর্চার জন্যে নানা ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতেন। সম্পূর্ণ অকাতরে নিজের শ্রম, অবসর ও অর্থের বিনিয়োগ করে এঁরা আশেপাশের শিশু বালক যুবক (ও কাদাচিৎ মেয়ে)‘দেরও হাতের কাজ, চারুকলা, অভিনয়, শরীরচর্চা, সমাজ সেবা ইত্যাদি নানান ধরনের কাজে নিয়োজিত রেখে অন্ধকার পথে পিছলে যাওয়া থেকে বাঁচাতে জীবন পণ করতেন—আজকে যেগুলি অনাবশ্যক নাক গলানো বা জ্ঞান দেবার চেষ্টা, দাদাগিরি বা বসিং বলে মনে হবে। সে যুগে পাড়ায় পাড়ায় মণিমেলা, সব পেয়েছির আসর জাতীয় অল্প বয়সি ছেলে মেয়েদের ক্লাব দেখতে পাওয়া যেত—যে গুলি বালক কিশোরদের বযঃসন্ধির অতি স্পর্শকাতর পর্যায়টি উন্নত সাহচর্যে অতিক্রম করতে সাহায্য করত। আমাদের টালা মণিমেলা গড়ে উঠেছিল চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, খুব সম্ভবত ১৯৪৬ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর। ষোল বছরের কম বয়সি ছেলে মেয়েরা হতো এর বর্তমান সদস্য—মূলত যাদের স্বার্থে মণিমেলা সংগঠন। ঐ বয়েসের পর এরাই হয়ে যেত প্রাক্তন সদস্য, যখন তাঁরা সংগঠনটি পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন। বর্তমান সদস্যের মধ্যে ষোল বছর কম অপেক্ষাকৃত দায়িত্বশীল কেউ নিযুক্ত হত মধ্যমণি, যার কর্মকালের মেয়াদ অবস্থা অনুযায়ি এক বা দু বছর। এই মধ্যমণি ও আরোও কিছু অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ বর্তমান সদস্য বা সচিবদের হাতে থাকত বর্তমান সদস্যদের রোজকার কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্ব।  মণিমেলার দৈনন্দিন কাজকর্ম কয়েকটি বিভাগের মাধ্যমে নির্বাহিত হতো, যথা শিশুমণি, বালক, বালিকা, কুচকাওয়াজ, ব্রতচারী, গ্রন্থাগার, সেবা বিভাগ ইত্যাদি। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন এক জন করে সচিব। আমি বরাবর গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলাম। দীপুদা (১,নং খেলাৎ বাবু লেনের দীপঙ্কর সেন)-দের বাড়ির এক তলার একটি ঘর থেকে  প্রতি রবিবার সকাল ১০টা থেকে ১২ অব্দি বর্তমান সদস্যদের বই দেওয়া হত। এই জাতীয় বর্তমান ও মণিরক্ষক বলে একজন প্রবীনতর সদস্য আরোও কিছু প্রাক্তন সদস্য নিয়ে গঠিত হতো কর্মী পরিষদ,যাঁরা মধ্যমণিকে মনোনীত করে তাকে পরিচালনার ব্যাপারে নির্দেশ দিতেন। নিজেদের পরিচালনা ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে মোটামুটি স্বাধীন হলেও বিভিন্ন মণিমালাগুলি মহাকেন্দ্র বলে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকত।

         আমাদের দাদা দিদিদের কয়েক জন-এর টালা মণিমেলার সদস্যপদ ছিল। ১৯৫৭ সালে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রের শিশু মহল বলে রবিবার সকালের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানটিতে মহা সমারোহে ‘তেপান্তর’ বলে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে। প্রায় দুই দশকের বেশ কর্ম বহুল অস্তিত্বের অন্তে একনিষ্ঠ কর্মীর অভাবে ১৯৬০ সাল নাগাদ সংস্থাটি নির্বাপিত প্রায় হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যেই কিন্তু খেলাধুলা, হাল্কা ব্যায়াম, সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে দিয়ে এই অঞ্চলে বালক বালিকা কিশোর কিশোরীদের ওপর এটি এমনই প্রভাব ফেলে যায় যে তারা নিজেরা যুবক যুবতী হয়ে উঠে নিজেদের বাল্য কৈশোরের ফেলে আসা সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলিকে কাজে লাগিয়ে ভাই বোনদের গড়ে তুলতে ১৯৬৬ সাল নাগাদ সংস্থাটিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে।

     নব পর্যায়ের মণিমেলায় শুরুতেই বিকেল চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ হত সংঘ প্রার্থনা, যা খুব সম্ভবত, “আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক’’ এই জাতীয় কথা দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হতো, “আমরা হয়ে উঠব মণির মতো উজ্ঞ্বল ও দৃঢ়’’বলে। তারপর ঘন্টা খানেক ধরে ল্যাঞ্চা(ল্যেম্‌ ম্যান), গাদি, খো খো, ইত্যাদি ছোটাছুটি হুড়োহুড়ির পর লাইন করিয়ে নাম ডাকা হতো।খাতা নিয়ে নাম ডাকতো মধ্যমণি। আমি ও আমার পরের ভাইটি আগে পরে মধ্যমণি হয়েছিলাম। এর পর ফ্রি হ্যান্ড এক্সাসাইজ, ডাম্বেল বা লেজিম ড্রিল, গান সহযোগে ব্রতচারী, অল্পস্বল্প কুচকাওয়াজ ইত্যাদি সারতে সারতেই সন্ধ্যে হয়ে আসত। শেষে আবার সংঘ প্রার্থনা, যার শেষ লাইনটা ছিল, “আমরা যখনই সময় পাব এসে মিলিত হব মণিমেলায়।”      

           তবে এই মণিমেলার বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতির চর্চা। নাচে গানে আবৃতি অভিনয়ে আমরা যেন নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতা আর নান্দনিক দক্ষতাগুলিকে ভালো ভাবে মেলে ধরতে পেরেছিলাম। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে ‘বাৎসরিক উৎসব’ আয়োজন করা হত। সদস্য আর পৃষ্ঠপোষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলা হত, স্টেজ বাঁধতে খরচ কমানোর আশায় বিভিন্ন বাড়ি থেকে বয়ে আনা হত চৌকি। তবু শীতকাল বলে স্টেজের ওপর আচ্ছাদন দিতেই হত, তেমনিই দর্শকদের মাথার ওপরে সামিয়ানার ব্যবস্থা না করে উপায় থাকত না। দর্শকদের বসার জন্যে তখন প্লাস্টিকের গার্ডেন চেয়ার নয়, কাঠের ভাঁজ করা চেয়ার যোগাত ডেকেরেটাররা। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হত তখনকার হিমানী বাড়িতে, ইলেক্ট্রিক আর মঞ্চ সজ্জার অনেক উপকরণ আসত হিমানী কোম্পানীর তহবিল আর তাদেরই প্রেস থেকে। প্রায় মাস খানেক ধরে রিহারসেল চলত।  রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনীর থেকে গীতিনাট্য, অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ বিভিন্ন বছরে মঞ্চস্থ করে ছোটোরা। আর বড়োরা করেছিল  নারাণ গাঙ্গুলীর ‘ভারা্টে চাই’; ছোট বড় মিলিয়ে নামানো হয়েছিল প্রশান্ত চৌধুরীর ‘কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ’ কি ‘তেপান্তর’এর মত সিরিও-কমিক নাটক। এর ডাইরেক্টার হতেন আমাদেরই দাদা দিদিরা। ঐ অনুষ্ঠানের সঙ্গে ছোটোখাট হস্ত শিল্পের প্রদর্শণীও থাকত, যার শিল্প দ্রব্যগুলির অধিকাংশই বানানো হত আমাদের বাড়িতে, পিসতোতো দিদি শকুন্তলার সহায়তায়।

     অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল নববর্ষ উজ্জাপন, ভাইফোঁটা,বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আর সুযোগ মত চড়ুইভাতি। এছাড়া প্রতি সোমবার বসত অধিবেশন।এখানে আনন্দবাজার পত্রিকার শেষ যে পাতাটি ছিল ছোটদের জন্যে নিবেদিত সেখানে মৌমাছি ছদ্দনামে বিমল ঘোষ মশায়ের যে চিঠি প্রকাশিত হতো তা পড়া হত। এর পরের পর্যায়টি আবৃত্তি মুকাভিনয়, গান, রচনা পাঠ ইত্যদিতে জমে উঠত। তারপর হতো অভাব অভিযোগের আসর। এই আসরে কোন সদস্যদের যদি অন্য কোন সদস্যের বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য থাকত বা কিছু প্রয়োজন দেখা দিত তবে সে তা জানাতে পারত।      

     এছাড়াও প্রকাশিত হতো হাতে লেখা পত্রিকা ‘মণি।’ বিভিন্ন রঙের আর্ট পেপারে হাতে লিখে এবং এঁকে শোভিত হতো পত্রিকাটি। তার পর পাতাগুলিকে বাঁধিয়ে বই এর রূপ দেওয়া হত। এতে ম্যাক্সিম গোর্কির শত বৎসর উপলক্ষ্যে ওঁনার জীবনী লিখেছিলাম ১৯৬৮ সালে; আর ১৯৬৯ তে মহাভারতের ভীষ্ম-অম্বার উপাখ্যান অবলম্বন করে একটা কাহিনী কাব্য জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু কচিকাঁচাদের পত্রিকার পক্ষে ওটি কিঞ্চিৎ প্রগলভতা সূচক বিবেচনায় তা মনোনীত হয়নি। তখন  প্রকাশ করা হয় কবিতাকারে বোকা শিষ্যের কাহিনী। দেশ ভ্রমন করতে করতে এক গুরু শিষ্যদের নিয়ে এমন দেশে পৌছলেন যেখানে মুড়ি মিছড়ির দাম সমান। দূরদর্শী গুরু বেগতিক দেখে এমন দেশ ছেড়ে যেতে উদ্যত হলে ভোজন বিলাসী এক শিষ্য উত্তম ভোজনের আশায় সেখানে রয়ে গেল এবং খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে উঠল। অতঃপর কোনো এক অপরাধে সে দেশের জনৈক ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ হলে দেখা গেল আসামীর গলা এতো সরু যে ফাঁসির দড়ি পরানো যাচ্ছে না। তাই দেখে দেশের রাজা মোটা গলার লোক জোগাড় করে আনতে আদেশ দিলেন, ধরে আনা হলো সেই খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে পড়া শিষ্যটিকে। ফাঁসির বিধান শুনে বেচারা প্রাণপনে ডাকতে লাগল গুরুকে। অর্ন্তযামী গুরু আর্বিভূত হয়ে রাজাকে বোঝালেন যে ফাঁসির এক মহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত, যখন মারা গেলে অক্ষয় স্বর্গলাভ অনিবার্য, সেই আশায় রাজা নিজে থেকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরলেন।

      শুরুতেই বলেছি যে একদিক দিয়ে এই পর্যায়টা কেমন যেন স্তিমিতির কাল ছিল। পড়াশুনো—যা আমাদের সেই সময়ের পারিবারিক পরিমন্ডলে একমাত্র বিবেচ্য ছিল—তাতে দৃশ্যত কোনো উল্লেখযোগ্য ফলই দেখাতে পারছিলাম না। পাঠ্যবহির্ভূত অন্য বিষয় সম্পর্কে অভিভাবকদের বিশেষ প্রশ্রয় ছিল না। আর আমাদের যত আগ্রহের উৎস ছিল সাহিত্য,দল-রাজনীতি,পরিষদীয় ব্যাবস্থার খুটিনাটি,আন্তর্জাতিক ঘটনা, বিজ্ঞনের আবিষ্কার ইত্যাদির মতো সব বিষয়গুলো। প্রসঙ্গক্রমে বলে নেওয়া ভালো যে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশ এবং বিদেশের রাজনীতিতে যৎকিঞ্চিৎ হলেও নৈতিকতার ছিঁটেফোঁটা বর্তমান ছিল।মাও-সে-তুং, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিনের মতো জননেতারা তখনো বেঁচে। কিছুদিন আগেমাত্র শহীদ হয়েছেন মার্টিন লুথার কিং। সমাজতন্ত্রের ‘মাটির পা’ তখনো সর্বসমক্ষে বেরিয়ে পড়েনি। তরুণ ভারতীয় সমাজতন্ত্রীদের গলায় চীন বলতে তখন বৈষ্ণবের ‘ক’-এ কৃষ্ণের মতো অবস্থা হতো আর কি। ইন্দিরাগান্ধীর জাতীয়করনের চমক আমাদের সচকিত করে রেখেছে। রাজনৈতিক ‘স্ক্যাম’ আজকের মতো জলভাত হয়ে পড়েনি। তাই রাজনীতি করা লোকজনদের কথায় মানুষজন কান দিতো, আজকের মতো তাদের সব কাথাকেই যেমন এককথায় হয় ঝেড়ে ফেলে দেয় অথবা তলিয়ে যাচিয়ে ভাবতে বসে যে এর মধ্যে আসল উদ্দেশ্যটা কি—তেমন করতো না।আমাদের অভিভাবকরাও এইরকম ভাবতেন—আর আমাদের ভাবাবেগ বা আদর্শবাদের দ্বারা ধাবিত প্লাবিত হতে বাধা দিতেন না। আমাদের মানসমুক্তির অনেকক্ষেত্রই ছিল।

      কিন্তু আরেক দিক দিয়ে দেখলে মনে হবে সে দিন অরোও কিছু ছিল। আমরা নিজেরাই ছিলাম অনেক জন—তাই সারাদিনমান সঙ্গি খুঁজতে বাইরে না গেলেও চলত। সারাদিনে বাড়িতে যেন ঝিম ধরা ঢিলেঢালা, ঢিমে তেতালা কোনো পর্যায়ই ছিলো না। সব সময়ে কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে,ঘটেই চলেছে। এ ঘরে ও ঘরে আলোচনা, তর্ক, ঝগড়া,বই (বিশেষ করে পূজো সংখা বা বাড়িতে নতুন কোনো নতুন বই এলেই তা) নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগেই থাকত। আমাদের সেই জমজমাট বাড়ি সম্বন্ধে  অনেকে আড়ালে মজা করে বলতো ‘তারাশঙ্করের ডাকাত দল। তাই বলে আমাদের সে দিনের টালার বাড়ি কিন্তু ভাগলপুরে মেশোমশাইদের বাড়ি বা কাতরাসগড়ে গৌতমকাকার শ্বশুরবাড়ির মতো ছিল না। কারণ আমাদের বাড়িতে ঐ পরিবারগুলোর মতো শূন্য থেকে হঠাৎ হঠাৎ করে  আনন্দ উৎসব বানিয়ে তোলা বা খুব সাধারণ ব্যাপারেও মজা করা বা নিছকই ‘ফান’সৃষ্টির জন্যে আলাদা করে কিছু করতে চাওয়ার কোনো ক্ষেত্র ছিলনা। সেই হিসেবে ঐ পরিবার-দুটিকেই মনে হয় ‘আমুদে পরিবার’ বা ‘আনন্দ নিকেতন’ বলাই শ্রেয়। খেয়াল রাখতে হবে ওই দুটি বাড়িতে দাদুর সমতুল্য কোনো ব্যক্তিত্ব ছিল না; আর দুটোই ছিল বাঙালীদের মূল জীবন স্রোত থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন প্রবাসী বাঙালী প্রায়-অনু-পরিবার।

       তখনকার পরিস্থিতিতে কোনো একটা দিন ভালো বা মন্দ যাওয়া বলতে যা বোঝাতো তা হলো সে দিন স্কুলে বা বাড়িতে কতটা কম বা বেশি—গালমন্দ শুনেছি, মার খেয়েছি বাসে. দিনের খেলাটা কেমন জমেছিল কিম্বা সে দিনের ভোজনের আয়োজনটা হয়েছিল কেমন ? আর এই শেষের ব্যাপারটা ঘটতো অকস্মাৎ কোন দিন মাংস খাওয়া হবে ঠিক হলে; অথবা প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির দিনে হঠাৎই খিচুড়ি খাওয়ার ধুয়ো তুলতো কাকু বা অন্য কেউ। তবে টালার বাড়িতে আমাদের আনন্দ উৎসবের বাঁধা সময় ছিল দুটি। সরস্বতী পূজোর আগের দিন বার’(সংযমের জন্যে) নিরামিষ খাওয়া, আর দাদুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। ঐ ‘বার’ উপলক্ষে রাত্রে মটরশুটির কচুড়ি খাওয়া নিয়ে সকাল থেকেই মনে বেশ একটা খুশি খুশি ভাব হয়ে থাকত।আর রাত্রে হত নতুন আলুরদমের সঙ্গে কচুড়ি খাবার প্রতিযোগিতা।আমাদের মতো অপগন্ড আর যুবক আধা যুবক নিয়ে প্রায় কুড়ি জন, তার ওপর বাড়ির মহিলা বয়স্ক এবং কাজের লোকদের সঙ্গে প্রতিবারই দু-এক জন অতিথি অভ্যাগত জুটে যেতোই যেত।মটরসুটি ছাড়ানো, বাঁটা, পুর-বানানো, পুর-ভরা—তারপর ভাজা সব নিয়ে এক ধুমধুমাক্কার ব্যাপার। তিনটে উনুন, ছ-সাত জন মহিলা, ঠাকুরদের প্রস্তুতি পর্বটাই খিদে ঘনিয়ে তুলতো। কিন্তু ঐ ভারি কচুরি কোন বারই খুব বেশী হলে ছ’টা আর নিদেনপক্ষে চারটের বেশি গলাদ্ধকরণ করা সম্ভব হয়নি। কোন কোন বার সঙ্গে সুজির পায়েসও হতো। সে এক বিশাল প্রাপ্তি। 

      আর দাদুর জন্মদিন—৮ইশ্রাবণ (ইংরেজী ২৪ অথবা ২৫শে জুলাই) উদযাপন জন্ম থেকেই দেখে এসেছি—আমাদের সেই আধা সহুরে পরিবারেও ওটা একটা বেশ ভাব গম্ভীর পরিবেশে গড়ে দিত। দিন কতক আগে থাকতেই বাড়ির সামনে ও পাশের জায়গা ম্যারাপ বাঁধা শুরু হত। ঐ দিন সকাল সাতটা নাগাদ দাদু সকালের পূজো সেরে নামতে নামতেই সারে-সাতটা নাগাদ আসতেন মিত্র ঘোষের গজেন মিত্র, সুমথ ঘোষ প্রমুখ। আর ওঁদের অনুগমন করে ভানুবাবু বা বাবুর মতো বয়ঃকণিষ্ঠের দল। প্রণাম করে, মালা পরিয়ে, মিষ্টি মুখ করে চলে যেতেন ওঁরা। এরপর দাদু দিদি গাড়ি করে সকাল ৮/৯টা নাগাদ যেত দক্ষিণেশ্বরে পূজো দিতে। সঙ্গি হতাম আমরা ছোটদের দঙ্গল। ফিরে এসে থেকে দু-জন চার জন করে আসতেন।অন্যদের সঙ্গে শিক্ষক, সাংবাদিক ও চলচিত্র জগতের লোকেরা, তবে মূলত আসতেন কবি,সাহিত্যিক, নাট্যকাররা। এঁদের মধ্যে আশাপূর্ণা দেবী ও তাঁর স্বামী, মনোজ বসু, বনফুল, শৈলদাদু (শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আচিন্ত্য সেনগুপ্ত, বাণী রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সন্তোষ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্র দুগার, গৌরকিশোর ঘোষ, জরাসন্ধ, মন্মথ রায়, অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য, সজনীকান্ত দাস,। বয়;কণিষ্ঠরা দাদুকে প্রণাম করত, সমবয়িসীদের সঙ্গে হতো কোলাকুলি, আর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কদাচিৎ কোনো বয়ঃজ্যেষ্ঠদের দাদু প্রণাম করত। নানান জন নানা উপহার আনতেন, অধিকাংশই পরাতেন রজনীগন্ধা বা জুইযের মালা, অনেকেই দিতেন নিজেদের সদ্য প্রকাশিত বই। দুপুরে দাদুর পূজোর পর দোতলার সামনের ঘরটিতে আসন পেতে দাদুকে খেতে দেওয়া হত। শুরু করার আগে সারা হতো প্রণাম পর্ব, বড় থেকে ছোটো ক্রমানুসারে চলত প্রণাম করা। তারপর শ্যামবাজারের ঠাকুর বাড়ির থেকে আনা  প্রসাদ মুখে দিয়ে মায়ের তৈরি পায়েস চাখতে হতো প্রথা মতো। পরের দিকে শোভাবাজার রাজবাড়ির অপর্ণা দেবও আনতেন ওঁদের গোবিন্দের প্রসাদ। লোকটি কোনো কালেই ভোজন রসিক ছিল না, ফলে দাদু উঠে যাবার পর বাকি যা থাকত তা নিয়ে চলত আরেক দফা কাড়াকাড়ি।ছোট বেলায় ঐ দিনগুলোতে  রাতের পর্যায়টা দেখার আগেই চলে যেতাম ঘুমের জগতে। পরের দিকে অবশ্য বাড়ি আর প্যান্ডেল এই দুয়ের মধ্যে চক্কর চলত ক্রমাগত।

      টালার বাড়িতে  সরস্বতী পূজো হতো বই সাজিয়ে। এর মধ্যে কেমন করে জানি ১৯৬৭ সালে ছোড়দা কিশোরশঙ্করের উদ্যোগে প্রথম ও শেষ বারের মতো বেলগাছিয়া থেকে মুর্তি এনে পূজোর ব্যাবস্থা করা হয়। দাদুর ‘ছোটগিন্নি’ হিসেবে এই জাতীয় ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তখন ওরই একমাত্র ছিল। ১৯৬৭ সালে দাদু জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারে পেয়েছিল।  চতুর্ভুজে বেদ,কমন্ডলু, অক্ষমালা ও পদ্মধারিণীব্রোঞ্জের সরস্বতী প্রতিমূর্তী। দ্বাদশ শতকে জনৈক ভোজ রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় পাথরের মূল মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল আধুনিক মধ্য প্রদেশের ধার (প্রাচীন ধারা ) সহরে। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে দিল্লীর সুলতানদের (বিশেষ করে আলাউদ্দীন খলজীর) উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে সেইটি কুয়োর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। কার্জনের আমলে সেখান থেকে উদ্ধার করে ওটি পাচার হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। পাথরের বৃহৎ মূর্তীটির অনুকরণে ক্ষুদ্রায়ত ব্রোঞ্জ রিপ্লিকা নিজেদের সংস্থার প্রতীক হিসেবে গ্রহন করে জ্ঞানপীঠ। এবারে দাদুকে উপলক্ষ্য করে দাদুরই মাধ্যমে আমাদের পরিবারে এই ভাবেই যেন দেবীর পদার্পণ ঘটল। প্রথম দিন থেকেই এই মূর্তীটি আমাদের পরম সমাদরের (বস্তু নয়) পাত্র হয়ে পড়ে। আমাদের সন্তান সন্ততিরা তারাশঙ্করের অন্য কিছুর খবর রাখুক না রাখুক—এই বিগ্রহটিকে সমাদর করে। ১৯৬৮ থেকে ২০১২ সাল অব্দি দাদুর পাওয়া মূর্তিটির পূজো করেছি আমরাই। তবে এই জীবনব্যাপী সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লেগেছে। ১৯৬৭ সালেও বাড়ির পূজোতে আমাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। নিজেদের অগ্রগণ্য কারার তাগিদে ওদিকে সেবারই টালা বালক সংঘের পূজোতে আমরাই হলাম উদ্যোক্তা। বাড়ির অজ্ঞাতসারে পাড়াতে চাঁদা তুলেছি। উদ্যোক্তার ভূমিকায় থাকায় ক্লাবে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া প্রয়োজন অথচ বাড়িতে গড়হাজির প্রমানিত না হবার জন্য কেবলই পিছু টানে ভুগছি। আবার মনপ্রাণ পড়ে আছে কাকলী বাড়ির পাশের মাঠের অকিঞ্চিৎকর মন্ডপটিতে। চাঁদা দাতাদের রসিদের  সঙ্গে দেওয়া হয়ছে রঙিন দু-পাতার কাগজে সামনে পেছনে ছাপা ক্লাবের প্রচার পত্র ওরফে স্মরণিকা। ওপরে বড় বড় অক্ষরে ক্লাবের নাম, তার নিচে সরস্বতীর ছবির নিচে (দাদুর ঐ মূর্তীটির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে) তৎসম শব্দ বহুল বেশ একটা শ্লোক শ্লোক ভাবাক্রান্ত আমার ‘সরস্বতীবন্দনা’—

“বন্দে হে জ্ঞানেশ্বরী বীণাবাদিনী সুরেশ্বরী

বন্দে হে ভারতীদেবী বিদ্যাদায়িনী  মাহেশ্বরী

কমন্ডলু কবচমালাধারী ইন্দীবর আরোহিনী

  হংসপৃষ্টাস্থিতা দেবী জ্ঞানাঞ্জন বিতরনী।”

       এর নিচে ছোট ভাইটির কলমে ভারতীয় জ্ঞান চর্চার প্রেক্ষাপটে সরস্বতী পূজোর মাহাত্ম্য বর্ণনা। ব্যাপারটা ভেবে আজকে খানিকটা মজাই লাগে ক্লাস সেভেনের ছাত্রের আত্মপ্রকাশের, পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা। অথচ বাড়ির পূজোতে সময়মত উপস্থিত না থাকতে পারার জন্যে থেকে থেকেই তিরস্কৃত হবার ভয়। সরস্বতী পূজোর দিনটা হচ্ছে বাঙালীদের ভ্যালেন্টাইন ডে। আমাদের অবশ্য তখনও ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপনের কাল হয়নি। এমন কি  স্কুলের সরস্বতী পূজো দেখতে যাওয়াটাও ছিল অভাবনীয়। শুধু সরস্বতী পূজো কেন,  স্কুলের ছুটির পর স্কুলের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকত না। স্কুলের সময়টায় যেন কেবল পড়তে যাওয়ার জন্যে।  আজকাল যেমন অভিভাবকরা ঘন ঘন স্কুলে যান (বলতে গেলে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন) শিক্ষকদের সঙ্গে সন্তানের পড়াশুনোর বিষয়ে খোঁজখবর নেন—আমাদের সময় একেবারে তা ছিল না বলব না—কেউ কেউ যেতেন বটে—তবে আজকের তুলনায়—তা ছিল অকিঞ্চিৎকর। আমাদের অভিভাবকদের স্কুলে হাজিরা না দেবার স্পষ্ট কারণ ছিল তাঁদের ব্যস্ততা। আর সরস্বতী পূজোর মতো ছুটিছাটার দিনে আমাদের স্কুলমুখী না করার একটা বাস্তব কারণ হতে পারে মায়ের পক্ষে বার বার বাস ভাড়া দেওয়ার সমস্যা মনে হয়। কিন্তু সমস্যাটা ছিল দৃষ্টিভঙ্গিগত। দূরে—বাড়ির বা পাড়ার সহজ নজরদারীর আওতার বাইরে স্কুলে যেতে দেওয়াটা আমাদের অভিভাবকদের যুক্তিযুক্ত মনে হয় নি। এইটা প্রায় বাতিকের মতো চেপে বসে ছিল আমার পরের ভাইটির মাথায়। বাড়ির এই ব্যাপারটাতে প্রায় নেশাগ্রস্তের মত সে ছুটির পর বাড়ির বাইরে থাকা বা আমাকে থাকতে দেওয়া  বা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যের পর বাড়ির বাইরে থাকাটা তার পক্ষে একটু একটু করে অপছন্দের ব্যাপার হয়ে উঠতে লাগল। আর তার সেই অসহিষ্ণুতা এমন ভাবেই আমাকে ঘিরে ধরতে থাকলো যে অমিও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী এর অনুবর্তী হয়ে উঠতে লাগলাম।   

       ১৯৬৮ সাল থেকে আমার পরের ভাইটি সংস্কৃত ভাষা নিয়ে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠতে থাকে। এ বিষয়ে তার পথ প্রদর্শক হয় ছোড়দি, কাঞ্চনকুন্তলা। সে বছর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ওর বাংলা খাতায় ‘অদ্ভূত’ বানানটিতে ছাড়া আর কোথাও লাল দাগ পড়েনি। এরপাশে আমার অবস্থা কহতব্য ছিল না। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংস্কৃত শ্লোক ও স্তোত্র খুঁজে ফেরা আমাদের কাজ হয়ে উঠল। দাদুর গ্রন্থ সংগ্রহে ‘সাধনা’ বলে একটা বই পেয়েছিলাম। সেটা ছিল ঋক বেদ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত সংস্কৃত, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় লেখা বহু আধ্যাত্মিক ভক্তি রসের স্তোত্র গানের সঙ্কলন। এর মধ্যে থেকে সংগৃহীত ঋক বেদের সরস্বতী বন্দনাটি  –“পাবকানঃ সরস্বতী বাজে ভির্বাজিনীবতী—যজ্ঞং বস্টুধিয়া বসু চ দয়িত্রী সূনৃতানাংচেতন্তীসুমতীনাম্‌–যজ্ঞং দধে সরস্বতী। মহো অর্ণ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা—ধিয়োবিশ্বাবিরাজতি।” (প্রথমমণ্ডল, তৃতীয়সুক্ত,শ্লোক১০-১২)। অর্থাৎ “কর্ম যাঁহার ধন, যিনি পবিত্র করেন ও যিনি অন্নসমূহ থাকায় অন্নবতী, সেই সরস্বতী (আমাদের)  যজ্ঞকামনা করুন। যিনি সূনৃত (অর্থাৎ সত্য ও প্রিয় বাক্য) সমূহের প্রেরণা করেন, যিনি সুমতিগণকে জানেন, সেই সরস্বতী যজ্ঞকে ধারণ করিয়াছেন। যিনি মহা সমুদ্রের ন্যায় অসীম পরমাত্মার স্বরূপ প্রকাশ করেন, তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকলের হৃদয়ে জ্যোতি ও সকল জ্ঞান উদ্দীপিত করেন। বাড়িতে শাস্ত্র মতে পূজোর অন্তে এই শ্লোকটি পাঠ করা হয়। এরপর দাদু যেমন করতো সেই রকম রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্যগ্রন্থের ‘পুরস্কার’ কবিতাটির মধ্যে যে সরস্বতী বন্দনাটি আছে তা পাঠ করা হয়ে থাকে।এমনি করেই ১৯৭৪ সালে জুটেছিল মীনার সিনেমা হলের বাইরে ‘বিগলিত করুণা জাহ্ণবী যমুনা’ সিনেমার আর্ট পেপারে ছাপা তিন ভাঁজ করা ফোল্ডারটি। ওতে পেয়েছিলাম ঐতেরেয় ব্রাহ্মণের শুনঃক্ষেপ উপাখানের আরেকটি স্ত্রোত্র

“নানা শ্রান্তায় শ্রীরস্তীতিরোহিত শুশ্রুম,

পাপো নৃষদ্দ্বর জন ইন্দ্র ইচ্চরতঃ সখা।

চরৈবেতি চরৈবেতি। ১

পুষ্পিন্যৌ চরনো জঙেঘ ভূষ্ণুরাত্মা ফলগ্রহিঃ।

শেরেঽস্য সর্বে পাপ্নানঃ শ্রমেণ প্রপথে হতা ।

চরৈবেতি চরৈবেতি।২

আস্তে ভগ আসীনস্যোধর্বস্তিষ্টতি তিষ্টতঃ

শেতে নিপদ্যমানাস্য চরাতি চরত ভগ

চরৈবেতি চরৈবেতি।”৩

কলিঃ শয়ানো ভবতি সংজিহানস্তু দ্বাপরঃ

উত্তিষ্টংস্ত্রেতা ভবতি কৃত সংম্পদ্যতে চরন।

 চরৈবেতি চরৈবেতি।৪                                             

চরন বৈ মধু বিন্দতি চরন্‌ স্বাদুমুদুম্বরম্‌

সূর্যস্য পশ্য শ্রেমাণং যো ন তান্দ্রয়তে চরণ।

চরৈবেতি চরৈবেতি।৫

এটা আমার হাতে অনুবাদ করে যা দাঁড়ালো তা হচ্ছে—

   শুনেছি রোহিত যে বা করে শ্রম শ্রীলাভ তাহারই জন্য। অলসেরা পাপী ইন্দ্র-সখ্যে সচলেরা শুধু ধন্য। চলো চলো শুধু চল।১।।

পুষ্প শোভিত জঙঘা তাহার ফলবান স্ফীত আত্ম। সে জনের পাপ ক্ষয়ে যায় যে বা শ্রমে দেয় সারা বর্ত্ম। তাই চলো শুধু চলো । ২ ।।

শয্যালীনের ভাগ্য শয়িত, উপবিষ্ঠের স্থানু—দাঁড়ান জনের দাঁড়িয়ে ভাগ্য চুমে চলিষ্ণু পদ রেণু। আগে চলো,চলো চলো চলো।৩।।

শুয়ে আছে কলি জেগেছে দ্বাপর উঠেছে মাত্র ত্রেতা—চলিতেছে যে বা সেইকৃত আর সেই সত্যজেতা।চলো চলো চলো চলো।৪।।

চলার মধ্যে আছে স্বাদু ফল, চলাতেই ঝরে মধু। দেখ অনাদির অতন্দ্র পুষণ আলোক দিতেছে শুধু। তাই চলো তাই চলো। ৫।।

      বামালগুলি প্রপার চ্যানেলে যথারীতি অভিভাকদের মঞ্চে পৌছে যেতে লাগল। দেখলাম ওগুলো দেখে তাঁদের চিরাচরিত অপছন্দ ব্যক্ত হলো না। বরং যেন কোথাও একটু প্রশ্রয়ের রেশই ছিল। সে দিনের সেই পরিস্থিতিতে এই স্বীকৃতিটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবে খুব অল্প অল্প করে ঐ তরফে যে অনুকূল একটা অবহাওয়া গড়ে উঠতে শুরু করল তা আমাদের যৎসামান্য হলেও কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন জুগিয়েছিল। মণিমালার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় অবতীর্ণ হয়ে, রবীন্দ্র কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্য পাঠ—আর তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা ইত্যাদি জড়িয়ে নিজস্ব একটা জগৎ গড়ে উঠতে থাকল।খানিকটা কাকতালীয়ভাবে আন্তর্জাতিক একটা ঘটনা এতে বড় প্রেরণা বয়ে আনল। ১৯৬৭ সাল নাগাদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়। অনুপুরক ভাবে কলকাতা ‘ক’ থেকে প্রতি শুক্রবার রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটা অব্দি চালু করা হয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরোধের আসর।’সে আমলে সিনেমা সম্পর্কে ভদ্র সমাজে (অন্তত আমাদের বাড়িতে) একটু ভ্রুকুঞ্চণ ছিল। সিনেমার গান শোনা গান বা গাওয়ার চেয়েও বেশী অপছন্দের ছিল সিনেমার গল্প বা নায়ক নায়িকাদের সম্পর্কে আলাপ আলোচনা। নিচু ক্লাসে পড়তে স্কুল থেকে শিখে আসা ছড়া—“নাইলন সাড়ি, পাইলট পেন; উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন”— অভিভাবকদের সামনে উচ্চারণ করার জন্যে কঠিন তিরস্কৃত হতে হয়েছিল।তাই রবিবার দুপুরের আধুনিক গানের অনুরোধের আসরের চেয়ে অনেক বেশী অনুমোদন প্রাপ্ত এবং সন্মানার্হ ছিল রবীন্দ্র সঙ্গিতের অনুরোধের আসরটি।তৃষিতের মতো কানের মধ্যে প্রাণে শুষে নিতাম সেই সুধা নির্ঝর। কিন্তু মন তখনো চপল, তাই রসাস্বাদনের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল গানের কথা সুর ও গায়ককে নিয়ে তর্ক করার প্রবনতা। নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলার জন্যে সিং নেড়ে তেড়ে যাবার মনোভাব। ঘুরে মরছিলাম রসলোকের বাইরের ঊষর প্রাঙ্গনে।

     এই সময়কার যে দুটো ঘটনা (যা বলতে গেলে খুব অকিঞ্চিৎকর হলেও)সে দিনে মনকে শক্ত করতে সাহায্য করেছিল। ১৯৬৬ সালে পূজোর সময় লাভপুরে ঠাকুর বাড়ির পন্ডিতমশায়ের কাছে অনেকে হাত দেখাচ্ছে দেখে আমিও হাত বাড়িয়ে বসেছিলাম। উঁনি পাঁজিপুঁথি দেখে যোগ বিয়োগ করে বলেছিলেন, “আরো বছর দুই পরে মাথা খুলে যাবে। মাথা কি খুলেছিল বলতে পারিনা, তবে বছর দুয়ের মধ্যেই জীবনের একটা লক্ষ্য অভিমুখ ধীরে ধীরে চেহারা নিতে শুরু করেছিল। আর সেই সুত্রে এই সময় আমার মধ্যে ঘনিয়ে উঠেছিল একটা বড়সড় টানাপোড়েন, আজকের ভাষায় ‘চাপ’। এগারো ক্লাসের পুরোনো হায়ার সেকেন্ডারী কোর্সে ক্লাস নাইন থেকে স্ট্রীম ভাগ হবার ব্যবস্থা ছিল।আর্টস না সায়েন্স কি পড়ব সেটা নিয়ে গভীর দ্বিধায় পড়েছিলাম। ছোট ভাইটির কিন্তু ঐ দ্বিধা ছিল না। আপাতত সংস্কৃত’র জন্যে আর্টস আর পরে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে পড়াটাই তার লক্ষ্য দেখলাম। চিরাচরিত দোলাচলের মনোভাব নিয়ে আমি ছিলাম দ্বিধাক্রান্ত। ঐ সময় চাকরি বাকরির বাজারে খুব মন্দা এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শ তাড়িত ও মদতপুষ্ট জঙ্গী শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল। নিজেদের ঘরের মিঠে জল ভাগিয়ে নোনা জলে ভরে তুলছিল রাজনীতির হত্তাকর্তারা। ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতকরা চাকরি পাচ্ছিল না। আজকের মতো চাকরির সন্ধানে অন্য প্রদেশে অভিপ্রয়ান তখনো জলভাত হয়ে যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গিয়ে তারা স্লোগান তুলছিল ‘ডিগ্রি চাই না, চাকরি চাই।’‘ভালো ছাত্রদেরই’ যখন এই দশা, তখন আর্টস পড়ে কোনোও লাভ হবে কি না—সে নিয়ে প্রবল দ্বিধার সামনে পড়েছিলাম। ইস্কুলে সায়েন্স পাওয়ার শর্তই ছিল—বিগত দুবছরের অঙ্কের ভালো ফল। আর বাড়িতে বা স্কুলে এমন কোনোও অঙ্ক শিক্ষক পাইনি যিনি অঙ্কটাকে ভালো বাসতে শেখান। বাড়ির তরফে অবস্থানটা ছিল ‘সায়েন্স পড়লে ভাল, না পড়লেও কিছু বলার নেই’ গোছের। ক্লাস সেভেন অব্দি সব সাবজেক্টে পাস করেই প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছিলাম। ইংরেজী ও বাংলা সাহিত্য (ব্যাকরণ নয়) ইতিহাস ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব ভালো না লাগলেও, খুব খারাপও লাগতো না,ওগুলো নিয়ে কোন অসাচ্ছন্দ বোধ করিনি। এইটের শুরু থেকেই বুঝতে পারছিলাম অঙ্কটা ক্রমাগতই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে; কি করব, কি করা উচিত এই নিয়ে দোলাচল ভাবটা স্বস্তি দিচ্ছিল না। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি গরম কালের এক সন্ধ্যে বেলায় দোতলার বারান্দায় মনমরা হয়ে পায়চারি করতে করতে নিজের মনেই আবৃতি করছিলাম ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে–“এতকথা আছে এতগান আছে এতপ্রাণ আছে মোর—এতসুখ আছে এতসাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর।” বহু বার পড়া, বহু বার বলা লাইনগুলো হঠাৎই কেমন যেন নতুন হয়ে প্রাণে বাজলো,বয়ে এল মনে কেমন যেন ভালো লাগার একটা অনুভূতি,অন্তরের অন্তস্থলে অতি ক্ষীণ আকুতি হয়ে ফুটলো অজানা কোনো আশার বাণী। এত দিন পর্যন্ত কোথায় ছিল কথা, কোথায় সাধ, কোথায় প্রাণ—সবকিছুই যেন থম্‌ মেরে, ঝিম ধরে অসম্পূর্ণ সম্ভাবনার ভারে অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এইবার যেন তা প্রকাশের ভাষা পেল। ঘটনার পরম্পরায় জীবনের গতিপথ আস্তে আস্তে আপনিই রূপ পরিগ্রহ করে ফুটে উঠতে লাগল।এ্যানুয়াল পরীঙ্কায় আমি অঙ্কে পেলাম ১৮ আর ভাইটি ১২। স্বভাব রসিক বুজুকাকা রহস্য করে বললেন আমরা যুগ্ম ভাবে পাস করেছি। অঙ্ক বিষয়টিকে অবহেলা করার ফল কিন্তু আখের ভালো হয় নি।

     মানুষ হবার পথের প্রথম পদক্ষেপটি করতে গিয়ে সে দিন নিজের ভেতরে যেটা অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো নিজের ওপর বিপুল আস্থা হীনতা। নিজের ক্ষমতায় যা পারি আর যা পারা উচিত বলে অন্যেরা বলে দেয়—এই দুটো মেলাতে গিয়ে নিজের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বিপুল চাপ। অন্যদের কথাগুলোতে কান না দেওয়াটা সেদিন যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় নি—আজও হয়না। কিন্তু পথ চলতে হয় নিজেকে—এগোতে হয় নিজের মতো করে পথ খুঁজতে খুঁজতে। আর সেটা করতে গিয়ে সামনে অন্যের ধরে দেওয়া লক্ষ্যতে পৌছতে না পারারই সম্ভাবনা। কারণ চলেছি তো আমি,অন্যে নয়।—অভিষ্টলক্ষ্যটাসকলেরকাছেইঅস্পষ্টথাকে প্রথম প্রথম। আর তার মধ্যে থাকে নানা মাত্রা।চাওয়া আর তাকে পাবার জন্যে উপযুক্ত পন্থা প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে যায় না—চলতেচলতেপরীক্ষা নীরিক্ষা, ঠিক ভুলের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে তা রূপ নেয়। কবির ভাষায় বেড়ার নিয়ম ভাঙ্গলে পথের নিয়ম আপনিই বেড়িয়ে পরে। ক্লাস সিক্সে পড়তে হাতে এসেছিল, হলদে রঙের মলাট দেওয়া খুব পাতলা পকেট ডাইরি সাইজের ঈশোপনিষদ। তার প্রথম শ্লোক, “—তেনত্যক্তেন ভূঞ্জিতা—”যার মানে ত্যাগের দ্বারা ভোগ কর’ পরষ্পর বিরোধী বলেই মনে হয়েছিল দীর্ঘকাল। গীতাতে যে নিস্পৃহতার উপদেশ আছে—দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে কোথায় তার শুরু কোথায় তার শেষ—প্রতিমুহূর্তে কে বলে দিয়েছিল আমায় ? যথার্থ ভাবে ভোগ করতে গেলে ভোগের গ্লানি অন্তরকে আবিল করে ছাড়ে। আবিলতায় আবদ্ধ  না হয়ে ‘মন বৃন্দাবনে অনন্ত রাসলীলা’-কে কেমন করে উপভোগ নয় অনুভব করতে হয়—তা নির্ধারণ করা কি এতোই সহজ ? ক্লাস এইটে পড়তে যখন নানা দিক দিয়ে উদ্‌ভ্রান্ত—তখন উইতে কাটা স্বামীপ্রণবানন্দের উপদেশ সমন্বিত ঐ সাইজেরই একটা পুস্তিকা পেয়েছিলাম। চরিত্র গঠনের জন্যে সেখানে যে সব উপদেশ ছিল—তা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। ব্রহ্মচর্য বীর্য ধারণ ইত্যাদি সম্পর্কে ওখানে যে সব উপদেশ লিখিত আছে তা রোজকার জীবনে কার্যকরী করে তোলা দুঃসাধ্য। কিন্তু প্রাণ মন তো চাইছিল ওমনি করেই বাঁচতে।

   সংশয়ের দোলায় দুলতে শুরু করার এই শুরু। নিজের বলে কোন অবস্থান নিতে না পারার আত্মপ্রত্যয়হীনতা—আত্মগ্লানি-হীনমন্যতা আমাকে গ্রাস করে নিল যৌবনের শুরুতেই, যখন নব্যযুবক আপন যৌবনের স্ফূর্তিতে মদমত্ত পদপাত করেফেরে পৃথিবীরপথে।আমার পথ খুঁজে পাওয়া তখন অনেক অনেক দূরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *