স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বামী বিবেকানন্দ

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বামী বিবেকানন্দ

Image result for vivekananda and freedom movement

একথা ঠিক যে, স্বামী বিবেকানন্দ প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন না; তবে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর বিবেকানন্দের একটি প্রভাব বরাবরই ছিল। শুধু প্রভাব নয়, স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিবেকানন্দ যে আন্তরিকভাবে সমর্থন করতেন, এবং সে সংগ্রামের প্রতি তাঁর যে সমর্থনও ছিল-তা-ও সমসাময়িক বিপ্লবীদের সাক্ষ্যেই প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় সে সময়ে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকার লেখাতেও। বাল গঙ্গাধর তিলকের গোষ্ঠীর পত্রিকা ‘মারাঠা’ বিবেকানন্দ সম্পর্কে ১৯১২-র ১৪ জানুয়ারি লেখে, ‘Swami Vivekananda is the real father of India nationalism. He wanted to develop a modern India…He wanted the Indian to become ‘an occidental of occidentals in his spirit of equality, freedom, work and energy, and at the same time a Hindu to the very back-bone in religious culture and instincts…Every Indian is proud of this father of modern India.’

স্বামীজির মৃত্যুর পর, ১৯০৩-এর জুলাই মাসে ‘ইণ্ডিয়ান রিভিউ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘To us, however, Vivekananda was always more than a mere Vedantic preacher. He was a patriot and a patriot of right type. He loved his country with a devotion which, if he were to live in violent times, would have marked him out as a Wallace or a Bruce, a Humpden or a Cormwell, or a Mazzim…’

১৯১২-র ২০ জানুয়ারি ‘মাইসোর টাইমস’ লিখেছিল, ‘His heart bled at the degradation of his countrymen and how he put himself to physical torture to show up his aliveness to the miseries of countrymen is current history… Renouncing his whole life at the alter of service for the country, Swami Vivekananda stands out as valiant patriot…To what extent one great soul can be savior and exalter of one’s country is more than illustrated to him.’

Freedom fighters of the Bengal Province in the time period 1921 ...ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের ভিতর অন্যতম, তৎকালে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনন্দ চালু বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছিলেন, বিবেকানন্দের পূজা করার অর্থ বীরের অর্চনা করা। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম্‌’ পত্রিকা বিভিন্ন নিবন্ধে বিবেকানন্দের উল্লেখ করে বলে যে, ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাপুরুষ বিবেকানন্দ। তাঁকে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী হিসাবেই ‘বন্দেমাতরম্‌’ চিহ্নিত করে। এমনকী, রবীন্দ্রনাথ, যিনি স্বামীজির ধর্মভাবনাকে সমর্থন জানাতে পারেননি, এবং স্বামীজি যাঁর প্রতি বিরূপই ছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথও ১৯২৮ সালের ৯ এপ্রিল সরসীলাল সরকারকে লিখেছিলেন, ‘আধুনিককালের ভারতবর্ষে বিবেকানন্দই একটি মহৎ বাণী প্রচার করেছিলেন, সেটি কোনো আচারগত নয়। তিনি দেশের সকলকে ডেকে বলেছিলেন, তোমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি-দারিদ্রের মধ্যে দেবতা তোমাদের সেবা চান। এই কথাটা যুবকদের চিত্তকে সমগ্রভাবে জাগিয়েছে। তাই এই বাণীর ফল দেশের সেবায় আজ বিচিত্রভাবে বিচিত্র ত্যাগে ফলছে। তাঁর বাণী মানুষকে যখনি সম্মান দিয়েছে তখনি শক্তি দিয়েছে। সেই শক্তির পথ কেবল একঝোঁকা নয়, তা কোনো দৈহিক প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তির মধ্যে পর্যবসিত নয়, তা মানুষের প্রাণমনকে বিচিত্রভাবে প্রাণবান করেছে। বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যেসব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙুলকে নয়।’ গান্ধীর চরকা কাটার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত রবীন্দ্রনাথকে বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দকেই জাতীয় জীবনের নায়ক হিসাবে দেখেছিলেন।

এইসব লেখাগুলি থেকে এটুকু অন্তত বোঝা যায়, বিবেকানন্দের বৈপ্লবিক চরিত্রটি কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বরং, তাঁকে নিছক বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হিসাবে না দেখে, একজন দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদীর চেহারাতেই দেখতে পছন্দ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা। বিশেষত, সে সময়ে বাংলা এবং বাংলার বাইরে থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্রপত্রিকাগুলি বিবেকানন্দকেই জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাপুরুষ বলে মনে করত।

কিন্তু জীবৎকালে বিবেকানন্দের কী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি? এ প্রসঙ্গে সেই সময়ে যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। যেমন, হেমচন্দ্র ঘোষ। ১৯৭৮ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী শঙ্কর বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার নেন। হেমচন্দ্র ওই সাক্ষাৎকারে বলেন বিবেকানন্দের মৃত্যুর একবছর পূর্বে, ১৯০১ সালে তিনি বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসেন। তখন বিবেকানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম দরকার স্বাধীনতা – Political freedom, তাই সর্বপ্রথম ইংরাজকে এদেশ থেকে তাড়াতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বুলি কপচিয়ে নয়, গায়ের জোরে, সংঘবদ্ধ সংঘটিত আক্রমণের সাহায্যে, Organized collective action under one leadership. তারা (ইংরেজরা) দস্যু, তস্কর, পরস্বাপহারী, তারা intruders, exploiters,  তারা blood suckers – আমাদের মায়ের বুকে বসে রক্ত খাচ্ছে। এই রাক্ষসদের আমাদের ধ্বংস করতে হবে। What right the Britishers have to rule our country? They shall have go back to England. It is our birthplace. To drive these intruders and plunderers away from our country, therefore, is your only religion. এই তোমাদের একমাত্র ধর্ম- the only programme to be executed… যে ভাবে হোক, যে-কোনো প্রকারে হোক তাকে বিন্যাস করতে হবে।’

এই সাক্ষাৎকারেই জানা যাচ্ছে, বিবেকানন্দ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের শক্তিলাভ করে পরস্বাপহারীদের দেশ থেকে দূর করে দে। …গোলামির শিকল ছিঁড়ে ফেল। ছিনিয়ে নে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা কি কেউ এমনি দেয় রে, তা অর্জন করতে হয়। যা ভারত হারিয়েছে তা তোদের পৌরুষের বলে, মানুষের শক্তিতে আবার পুনরুদ্ধার কর। পশুও চায় না বন্দী হয়ে থাকতে। গরুকে বেঁধে রাখলে গরুও দড়ি ছিঁড়তে চায়, ছিঁড়তে চেষ্টা করে। আর তোরা কি করছিস! তোরা ওঠ, তোরা জাগ। তোরা মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠ। আর হাতে কৃপাণ ধর, ধর বন্দুক। চলুক গুলি-গোলা! ভীমা রণরঙ্গিণী মহাকালীর সন্তান আমরা। ভয় কাকে? কিসের ভয়?’

স্বামীজির ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ‘মৃত্যুর একবছর পূর্বে তাঁর দুজন বিদেশী অনুরাগী (তন্মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর শিষ্যা) কলকাতায় কয়েকজন নাগরিকের সহায়তায় একটি জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। এই দলটিই পরে বাংলায় বিপ্লববাদী আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিল। স্বামীজি তাঁর শিষ্যাকে এই দলে যোগদান করতে বারণ করেছিলেন। ভগ্নী ক্রিস্টিন স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তিনি সেই শিষ্যাকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে অনুরোধ করলেন? উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘নিবেদিতা ভারতের পরিস্থিতি ও রাজনীতি সম্পর্কে কী জানে? আমার জীবনে আমি তার চেয়ে অনেক বেশী রাজনীতি করেছি। বিদেশি শাসন উচ্ছেদ করবার জন্য ভারতীয় নৃপতিদের নিয়ে একটি শক্তিজোট তৈরি করতে চেয়েছিলাম। সেই জন্যই আমি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই জন্যই আমি বন্দুক-নির্মাতা স্যার হাইরাম ম্যাক্সিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলাম। কিন্তু দেশের কাছ থেকে আমি সাড়া পাইনি। দেশটা মৃত।

হাইরাম ম্যাক্সিমের সঙ্গে বিবেকানন্দ যে যোগাযোগ করেছিলেন তা স্বীকার করেছেন জোসেফিন ম্যাকলিয়ডও। জোসেফিন ম্যাকলিয়ড লিজেল রেমঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বামীজি বিদেশ থেকে অস্ত্র আনার পরিকল্পনা করেছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর কাছে রেমঁ জোসেফিন ম্যাকলিয়ডের এই কথাটি জানিয়েছিলেন। তা লিপিবদ্ধও করেছেন শঙ্করীবাবু। তবে, স্বামীজির সে পরিকল্পনা সফল হয়নি।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকেই জানা যায়, স্বামীজি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘স্বামীজি নিজেই একথা বেলুড় মঠে ইতিহাস লেখক পণ্ডিত সখারাম দেউস্করের সঙ্গে আলোচনাকালে একবার বলেছিলেন। পণ্ডিত দেউস্কর বিপ্লবী দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেউস্করের প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘সমস্ত দেশটা বারুদ কারখানায় পরিণত হয়েছে। একটি অগ্নিস্ফূলিঙ্গই একে প্রজ্বলিত করে দিতে পারে,আমার জীবদ্দশাতেই বিপ্লব প্রত্যক্ষ করে যাবো।’ বিপ্লবের প্রকৃতি কী হবে এবং ভারতীয়রা বৈদেশিক সাহায্য চাইবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘না, ভারতবাসীরা চতুর্থবার এই ভুল আর করবে না। আমি কয়েকজন নৃপতির কথা জানি যাঁরা এই বিপ্লবকে সফল করতে পারেন।’ পরে এই আলোচনার কথা দেউস্কর ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার বিপ্লবীদের কাছে প্রকাশ করেন।’

বিবেকানন্দের এই কথাগুলি শুনলে বোঝাই যায় ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষেই তাঁর মত ছিল। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি যে তিনি পছন্দ করেন না, তা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন স্বামীজি। স্বামীজির আর-এক ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায় স্বামীজি গুরুভ্রাতা সারদানন্দকে বলেছিলেন, ভারতের লোকগুলি কংগ্রেস কংগ্রেস করে মিছামিছি হৈ চৈ করছে কেন? কতকগুলো হাউড়ে লোক এক জায়গায় জুটে কেবল গলাবাজি করলেই কি কাজ হয়? চেপে বসুক,  নিজেদের independent বলে declare করুক, হেঁকে বলুক, ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন হলাম,’ আর সমস্ত স্বাধীন Governmentকে নিজেদের declaration পত্র পাঠিয়ে দিক, তখন একটা হৈ চৈ উঠবে।’

মহেন্দ্রনাথের লেখায় আরো জানতে পারি, বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘বেপরোয়া হয়ে কাজ করতে হবে। বিধি মত কাজ করে যাব, তাতে যদি গুলি বুকে পড়ে, প্রথমে আমার বুকে পড়ুক। …পড়ুক গুলি আমার বুকে, আমেরিকা, ইউরোপ একবার কীরকম কেঁপে উঠবে। তখন বুঝবে বিবেকানন্দ কি জিনিস! আমেরিকায় এমন স্থান নেই যেখানে বিশ-ত্রিশ হাজার লোক নিতান্তই আমার অনুগত নয়। আমার রক্ত পড়লে সারা জগতে একটা সাড়া পড়ে যাবে। কংগ্রেস জোর গলায় নিজেদের স্বাধীনতা declare করুক, শুধু মাগীদের মতন বসে বসে কাঁদুনি গাইলে কি হবে?’

বিবেকানন্দের এই কথাবার্তা স্বাভাবিকভাবেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থীদের প্রভাবিত ও উজ্জীবিত করেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, কংগ্রেসি বা অন্যান্য নরমপন্থীদের তুলনায় চরমপন্থীরা বিবেকানন্দকে গ্রহণ করেছিলেন বেশি। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির কাছে বিবেকানন্দই ছিলেন সংগ্রামের প্রেরণাদাতা, প্রাণপুরুষ। বিপ্লবী গনেশ ঘোষ ব্রহ্মচারী শঙ্করকে ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, -‘আমাদের দেশের অতীত বিপ্লবী সংগ্রামের উপর বিবেকানন্দের প্রভূত পরিমাণে প্রভাব ছিল। আমার অভিজ্ঞতায় আমিই দেখেছি-আমরা যখন ছোট ছিলাম এবং বিপ্লবী আন্দোলন এবং গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসি, তখন বিপ্লবী সাহিত্য বলে বিশেষ কিছু ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, রমেশ দত্তের Victorian Age, সখারাম গনেশ দেউস্করের বই এবং বিবেকানন্দের লেখা বই সমূহই আমাদের ভালো করে পড়তে বলা হত। এই কয়খানি বই বিভিন্ন বিপ্লব আন্দোলনে অনুপ্রেরণা পাওয়ার মতো। আর বিশেষ কোনো সাহিত্য অথবা বই ছিল বলে তো মনে হচ্ছে না।’

গনেশ ঘোষ লিখেছেন, ‘মাস্টারদা সূর্য সেন, যদুগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃবর্গের সঙ্গে দীর্ঘকাল অতি ঘনিষ্ঠভাবে মেশবার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁদের কাছে এবং বিপ্লবী আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য বহুসংখ্যক নেতৃবর্গের কাছে আমি স্বামীজির কথা অনেক শুনেছি। প্রত্যেকেই স্বামীজির কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করেছেন। …আমার সতীর্থ অনন্ত সিংহের বেলাতেও ঠিক তাই। প্রথম-প্রথম তাকেও বিবেকানন্দের সাহিত্য, বিশেষত স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতা সেইযুগে অবশ্যই অনেকবার পড়তে হয়েছে। …

‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো একজন ব্যক্তির অবদানের কথা বলতে গেলে একথা বললে বোধহয় ভুল হয় না যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর একেবারে সূচনাকালে বিবেকানন্দের বাণীই বাংলাদেশের তরুণদের সবচাইতে বেশি মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল।’

বাংলাদেশে চরমপন্থী বিপ্লবীদের উপর বিবেকানন্দের কী গভীর প্রভাব ছিল তা জানা যায় সূর্য সেনের সহকর্মী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের কথা থেকে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ফাঁসি হওয়ার কিছুদিন আগে প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদারকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে একদিন তোমার ব্লাউজে একখানা স্বামীজির মনোগ্রাম আঁটা দেখেছিলাম। আমার ওটা খুব ভালো লেগেছিল। যুগগুরুর প্রতি অকপট শ্রদ্ধা এমনি করে চিরদিন তোমার অন্তর আলো করে রাখবে কি? ওঁকে তোমার খুব ভালো লাগে, আমারও তাই। কেউ যদি আমায় জিজ্ঞাসা করে, ওঁর কী পরিচয় তোমার জানা আছে? কী জবাব দেব তা ভেবে পাইনে। ওঁকে কতখানি-ই বা আমরা চিনতে পেরেছি। পশ্চিমের লোকেরা বলছে Cyclonic Hindu-আমার মতে, He is moral and spiritual forces of India. আজকালকার দিনে তো কথা কাটাকাটির অন্ত নেই। কারন, blind belief জিনিসটা পছন্দ করে না কেউ। কিন্তু বিবেকানন্দের বেলায় কোনো যুক্তিতর্কের আমল দিতে চাইনে। ওঁর প্রত্যেকটি কথা শুধু ওঁর কথা বলেই বিনাবিচারে মেনে নেওয়া চলে, ওঁর আদর্শের উপর একান্তচিত্তে নির্ভর করে চলে! শুধু সেন্টিমেন্টের দিক থেকে আমার এ ধারণা জন্মেনি, ওঁকে চিনবার যেটুকু চেষ্টা করেছি তার তরফ থেকেই আমি বলছি, মনুষ্যত্বের এতবড় আদর্শ আর কেউ দিতে পারেনি, পারবে কিনা তাও জানি না। মানুষকে শুধু মানুষ বলেই আর কেউ এমন ভালবেসেছে কি?’

আর সূর্য সেনের বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধার কথা উল্লেখ করে গেছেন আর এক বিপ্লবী অনন্ত সিংহ। অনন্ত সিংহ লিখেছেন, ‘মাস্টারদা…বিনয়ের সঙ্গে অথচ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে চারজন বিপ্লবী বন্ধুকে বললেন, আমরা চট্টলার বুকে বসে মাত্র এই পাঁচজনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের পরিকল্পনা করছি। …বর্তমানে মূলত আনন্দমঠের আদর্শে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চলা উচিত এবং মা-কালী পূজা, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও গীতাপাঠ কর্তব্য হওয়া প্রয়োজন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘সবাই আলোচনার পরে মাস্টারদার এই সমস্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নিলেন। তাঁরা ঠিক করলেন, গভীর রাত্রে পাহাড়ে ঘেরা নিভৃত স্থানে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মায়ের পূজার বেদীর সামনে বুকের রক্ত দিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন। তাঁরা মায়ের পূজাও করেছিলেন, অঙ্গীকারবদ্ধও হয়েছিলেন। এঁদের প্রত্যেকের ঘরে মা-কালীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি ও একখানা গীতা রাখাটা নিয়মে পরিণত হল।’ অনন্ত সিংহের এই লেখাটি পরে আরো পরিস্কার বোঝা যায়, সেই সময়ে বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে বিবেকানন্দের কতখানি আবেগঘন আবেদন এবং শ্রদ্ধার স্থান ছিল।

বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত লিখেছেন, ‘বিবেকানন্দের প্রতি আকর্ষণের ফলে বিপ্লবীরা তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলেন। মিশনের সঙ্গে অনেক বিপ্লবীর ছিল নিবিড় যোগাযোগ। অনেক বিপ্লবী পরবর্তী জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়েছেন, এ দৃষ্টান্তও কম নয়। …আমার সতোর্থ স্বামী জ্ঞানাত্মনন্দ (পূর্বাশ্রমে সুধীরকুমার রায়চৌধুরী) পূর্ব জীবনে বিপ্লবী ছিলেন। তাঁকে আমার সঙ্গে প্রায় একই সময়ে ১৯১৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। বৎসরাধিককাল অন্তরীণ এবং বন্দিজীবন যাপন করার পর মুক্তি পেয়েই তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেন।’

Karma Yoga:The concept of work and duty by Swami Vivekananda

বিবেকানন্দের প্রভাব যে বাংলা এবং বাংলার বাইরের বিপ্লবীদের ওপরও ছড়িয়ে পড়েছিল, তা স্বীকার করেছিলেন সেই সময় ব্রিটিশ পুলিশের কর্তা চার্লস টেগার্টও। বিবেকানন্দের প্রয়াণের অব্যবহিত পরেই টেগার্ট রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। ওই রিপোর্টেই স্বামীজির বেশ কিছু রচনাকে ‘আপত্তিকর’ হিসাবে চিহ্নিত করেন টেগার্ট। এবং রিপোর্টে বলেন, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা স্বামীজির দ্বারা অনুপ্রাণিত। রিপোর্টে আর-একটি অভিযোগও আনেন টেগার্ট। তা হল, স্বামীজি মায়াবতীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুলিশের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য। এরও আগে, ১৮৯৬ সালে স্বামীজি যখন ইংল্যাণ্ডে যান, তখন লণ্ডনের পুলিশ তাঁর সম্পর্কে একটি গোপন রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্টে বলা হয়, বিবেকানন্দ নাম্নী ব্যক্তিটির উচ্চতা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি, ভারী চেহারা, ডানদিকের কপালে কাটা দাগ। সন্ন্যাসী হলেও রাজনীতি সম্পর্কে উৎসাহী।

আরো বিস্তারিত আলোচনা না করলেও, এরপর বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থেকেও স্বাধীনতা আন্দোলনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বামীজি পালন করে গেছেন। তবে স্বামীজি শুধুমাত্র চরমপন্থীদেরই আকৃষ্ট এবং প্রভাবিত করেছিলেন-তা-ও নয়। স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো অহিংস মন্ত্রের উপাসকও স্বামীজির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। গান্ধীজি তাঁর আত্মজীবনীতেই সে কথা লিখেও গিয়েছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে গান্ধী কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে উৎসুক হয়েছিলেন গান্ধী। এতটাই উৎসুক হয়েছিলেন যে, কলকাতা থেকে হেঁটে বেলুড়েও গিয়েছিলেন স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে। গান্ধীর দুর্ভাগ্য, স্বামীজি সেই সময় বেলুড়ে ছিলেন না; ফলে স্বামীজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এর পর মাত্র যে ক’মাস স্বামীজি জীবিত ছিলেন-সেই সময়ের মধ্যে এই দুই ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক সাক্ষাতের সুযোগ আসেনি। গান্ধী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ Haveing seen enough of the Brahmo Samaj, it was impossible to be satisfied without seeing Swami Vivekanand. So with great enthusiasm I went to Belur Math, mostly, or may be all the way, on foot. I loved the sequestered site of the Math. I was disappointed and sorry to be told that the Swami was at his Calcutta house, lying ill, and could not be seen.’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *