।।ক্ষণজন্মা জাদুকর।।

লিখেছেন – সত্যব্রত বিশ্বাস, সুইজারল্যান্ড থেকে ।।

২০১২-এর নভেম্বর, হটাৎ করেই একটু ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান হলো। কর্মসুত্রে তখন আমি সপরিবারে চেন্নাইতে বসবাস করছি। চেন্নাই-এ থেকে এত কাছের তাঞ্জোর ডিস্ট্রিক্টটা ঘুরে না গেলেই নয়।দেশের সবচেয়ে বড়ো মন্দিরের অন্যতম বৃহদেশ্বরা, অথবা ঐরাবতেশ্বরা বা দারাশুরাম মত জগতবিখ্যাত মন্দিরের পীঠস্থান এই তাঞ্জোর ডিস্ট্রিক্ট। এই মন্দিরগুলির ভাস্কর্য ও কারিগরি ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক উদাহরণের মধ্যে প্রথম সারীতে। স্বাভাবিক ভাবেই এগুলি দেখার ইচ্ছা এবং স্বপ্ন বহুকাল ধরেই ছিল।

শুক্রবার সকালেই দুর্গা বলে বেড়িয়ে পড়লাম পুরো ফ্যামিলি নিয়ে। শুক্রবার আর শনিবার কুম্ভকোনাম আর তাঞ্জোরের নানা মন্দিরের ইঞ্জিনিয়ারিং আর আর্ট দেখে অভিভূত, সঙ্গে দেখা পেলাম তামিল আর মারাঠা সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। শনিবার বিকাল ৪টায় হোটেলে ফেরার সময় বুঝলাম সবাই ভীষণ তৃপ্ত। সঙ্গে এটাও বুঝলাম দুদিনের ঘোড়াঘুড়িতে পরিবারের সকলেই ভীষণ পরিশ্রান্ত।

তাই সময় নষ্ট না করে একা একাই বেরিয়ে পড়লাম কুম্ভোকোনামের শেষ দ্রষ্টব্যটি দেখার উদ্দেশ্যে। গন্তব্য এক ক্ষনজন্মা জাদুকরের বাড়ি। আরাধ্য মানুষটির বাড়ির সামনে দড়িয়ে শ্রদ্ধায় অজান্তে দুহাত কপালে উঠে গেছিলো। পরে গার্ডের কথায় বুঝলাম , যথেষ্ট অবাক হয়েছিল আমাকে প্রণাম করতে দেখে। এমনিতে এই মিউজিয়াম দেখতে লোকে আসে খুব কম, তাও কেউ প্রণাম করছে। সারাঙ্গাপানি স্ট্রিটের হলুদ ছোট বাড়িটার সামনে এসেই হটাৎ করে ফিরে গেছিলাম ২০-২৫ বছর আগের সময়ে।

সবকটা বইয়ের মধ্যে ক্লাস ৭-এর ফিজিক্যাল সাইন্স বইটা সেবার একটু অন্যরকম ছিল। সাধারণত ৬x৯ বা ৯ x ১২ সাইজের বই পড়তাম, হটাৎ করেই জুটেছিল ৭ x ৭। বইয়ের অদ্ভুত সাইজ বা স্যারের ভয়েই হোক, স্যার আসার আগে খুলে বসেছিলাম বইটা। নাম জানা বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকদির নাম ও জীবনী দেখতে দেখতে হটাৎ করেই একটা পাতায় চোখ আটকে গেছিলো। সাধারণ কালো সাদা ছবির মধ্যেও জ্বলজ্বলে চোখ দুটো বোধহয় আকর্ষণ করেছিল।

মহান মানুষটি জন্মেছিলেন একটি সাধারণ তামিল ব্রাহ্মীণ পরিবারে আর ছোটবেলা থেকেই অমোঘ আকর্ষণে আটকে গেছিলেন গণিতে। অন্য সাবজেক্টে নিতান্তই সাধারণ হলেও গণিতকে ভালোবেসে ছিলেন জীবন দিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই কোনোক্রমে পাশ করা মানুষটির জীবন অতিবাহ সহজ ছিল না, টাকার অভাব আর চাকরি না থাকায় অনেকটা সময় তিনি কাটাতেন না খেয়ে।এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার জীবনের ধ্যান আর জ্ঞান ছিল গণিত।

কোনোক্রমে অনেক চেষ্টার পরে ক্লার্কের চাকরি করেই জীবন অতিবাহ করছিলেন,এরপরের ঘটনা থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন গণিতজ্ঞ। বোধহয়,ট্যালেন্ট ঠিক একদিন না একদিন কেউ চিনেই নেই, চাপা থাকে না। সেইসময়কার অন্যতম প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ হার্ডি খুঁজে পেলেন সেই ট্যালেন্ট সাধারণ তামিল ব্রাহ্মনের চিঠিতে। এরপর লন্ডন পাড়ি এবং প্রতিষ্ঠা পাওয়া। দ্বিতীয় ভারতীয় হয়ে ফেলোশিপ পাওয়া রয়্যাল সোসাইটিতে। ভারতীয় হলেও, ট্রিনিটি কলেজ মাথা নোয়াল গণিতের এই জাদুকরের সামনে, দিতে বাধ্য হল ফেলোশিপ।

ভগবান বোধহয় এরকম ট্যালেন্টেড মানুষকে বেশি দিন দুরে সরিয়ে রাখেন না। মাত্র ৩২ বছর বয়েসেই অনেক গণিতের জটিল সমস্যার সমাধান করে আর অনেক কিছু শেষ  করার আগেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। এই পর্যন্ত পড়েই কোনো কারণে তিনি আমার আইডল হয়ে উঠেছিলেন।

এর পরের অংশ আমাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। হার্ডি একদিন এই গণিতজ্ঞকে প্রায় ডেথ বেডে থাকা অবস্থায় দেখতে এসেছিলেন। “বুঝলে আজ একেবারেই একটা অতি সাধারণ নাম্বারের ট্যাক্সি ১৭২৯ এ এলাম, এরকম বাজে নাম্বার খুব কম দেখা যায়”। “হার্ডি,১৭২৯ সংখ্যাটা খুব সাধারণ না, এটাই সবচেয়ে ছোট ন্যাচারাল নাম্বার যাকে দুটো নাম্বারের কিউব হিসাবে দু ভাবে লেখা যায়।”

১৭২৯ = 13 + 123 = 93 + 103

সত্যি ১৭২৯ কোনো সাধারণ  নাম্বার নয়, প্রত্যেকটি ডিজিটের যোগফল ১৯ (১+৭+২+৯) এবং এই ১৯ কেই উল্টো করে লিখে মাল্টিপ্লাই করলেও পাওয়া যায় সেই ম্যাজিক নাম্বার। ১৯X ৯১ = ১৭২৯। 

অবশ্য এখানেই মজার শেষ না, গণিতজ্ঞ যে মজার নাম্বার বলেছিলেন। ১৭২৯ এর মতন সবচেয়ে ছোট ন্যাচারাল নাম্বার যাকে দুটো নাম্বারের কিউব হিসাবে দু ভাবে লেখা যায় যদি নেগেটিভ নাম্বারকেও ধরা হয় তাহলে ৯১ = 63 + (−5)3 = 43 + 33 এবং ৯১ আবার সেই ট্যাক্সিক্যাব নাম্বারের বিভাজক।স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষণজন্মা গণিতজ্ঞের জীবনেও ১৭,২৯ বা ১৯ এর দ্যোতনা থাকাটাই স্বাভাবিক।কিছু উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে গণিতজ্ঞের জীবনে এই নাম্বারগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯:

জন্ম ২২-১২-১৮৮৭ এবং মৃত্যু ২৬-০৪-১৯২০, এবং এদের যোগফল ৩৮৭১ (২২ + ১২+ ১৮৮৭+ ২৬+ ০৪+ ১৯২০) আর সিমপ্লিফায়েড ১৯ (৩+৮+৭+১)। জন্মস্থান তামিলনাড়ু, সেটিও যোগফল ৯৫ বা ১৯ এর গুণিতক।প্রতিষ্ঠা লাভ এবং প্রশ্নাতীত ভাবেই জীবনের শ্রেষ্ট সময় কাটিয়ে ছিলেন ইংল্যান্ডে, স্বাভাবিক ভাবেই ইংলান্ডেরও লেটারগুলোর যোগফল ১৯ এর গুণিতক ৫৭। গণিতজ্ঞের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বিবাহ, ১৪ই জুলাই ১৯০৯, জুলাই কে ইংলিশে লিখলে ডেটের যোগফল দাঁড়ায় ৩৮। এমনকি জানকী, গণিতজ্ঞের স্ত্রীর মৃত্যু দিনের যোগফলও সেই ৩৮।

২৯:

১৯ এর পরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম্বার গণিতজ্ঞের জীবনে ছিল ২৯। চেন্নাই থেকে লন্ডন যাত্রা পূর্ণ করেছিলেন ঠিক ২৯ দিনে (১৭ই মার্চ ১৯১৪ – ১৪ই এপ্রিল ১৯১৪). প্রথম ভারতীয় হিসাবে ফেলোশিপ পেয়েছিলেন ট্রিনিটি কলেজ থেকে, এবং ট্রিনিটি কলেজের যোগফল ২৯ এর গুণিতক ১৭৪।

১৭:

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাটি ১৭, গণিতজ্ঞের সব চেয়ে কাছের বন্ধু এবং গাইড ছিলেন সেই সময়কার প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ গডফ্রে হার্ডি। যোগফল ১৭ এর গুণিতক, ১৩৬. গণিতজ্ঞের মৃত্যু স্থান, কুম্ভকোনামও ছাড় যায় নি,  যোগফল সেই ১৭ এর গুণিতক ১০২.

সত্যি কথা বলতে নিউমেরোলজিতে বিশ্বাসী নই,কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই হয়তো গণিতজ্ঞের জীবন নাম্বার সূত্রেই বাঁধা ছিল|

ধীরে ধীরে সেই হলুদ বাড়ি দেবস্থানে ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে বলেছিলাম, সত্যি,”The Man Who Knew Infinity”, শ্রীনিবাস রামানুজন তোমাকে নত মস্তকে প্রণাম।

কাকতালীয় ভাবে নামের লেটারের যোগফলও ১৭ এর গুণিতক ২০৪| রামানুজন এবং রামানুজনের নানা তত্ত্ব এবং ১৭২৯ চিরস্থায়ী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *