বিদ্যাসাগর মশায়

Vidyasagar

বিদ্যাসাগর মশায়, আপনি বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন। সময়ের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। অতটা ভালোমানুষি, এতো দূরদৃষ্টির মানুষদের আমরা হজম করতে পারি না। সবাইকে নিজেদের মাপে দেখতে চাই। নয়তো নিজেদের থেকেও ছোটো করে, ওতে আসলে সব দেখতে পাই। সব বুঝতে পারি, বেশ সহজ লাগে। আপনি এতো উঁচু হয়ে গেলেন, মাথা ছুঁল আকাশে, অদেখা আর অবোধ্য হয়ে রইলেন তো আমাদের আর দোষ কি! আমরা সাধারণ মানুষ অদ্দুর পৌছনো আমাদের কম্ম নয়, তাই যেখানেই আছি সেখান থেকেই আমরা আমাদের মতো করে মানে করে নেবো। নেবোই। নিজেরা বড়ো হতে না পারি, সে ক্ষমতা না হয় একটু কমই রইল কিন্তু নামিয়ে দেখার দেখার ক্ষমতা তো আছে। কারোর নাগাল না পেলে টেনে নিচে নামিয়ে দেখে নেবো ঐ লম্বা মানুষের মনে-মগজে এমনকি হৃদয়েও কি আছে। চিন্তায়, ভাবনায়, কাজে ও যাপনে বড়ো হওয়া ভারী ঝামেলার – অত হ্যাপা সইবে না। ওর চেয়ে যে বড়ো হবে, তাঁকে হিঁচড়ে নামিয়ে নিজেদের সারিতে আনা অনেক সোজা। তাই লক্ষ্য স্থির রেখে ক্রমাগত লেগে থাকার কঠিন পথে হাঁটার কষ্ট তাও আবার স্রোতের উল্টোপথে সে কেই আর করে বলুন। তার চে বরং কোন ‘ভালো’ মানুষকেই ছাড়াছাড়ি নেই। সবকটাকেই আমরা টেনে এক সারিতে নামাবোই নামাবো, এমনকি আপনাকেও মশাই…

#

বলি, জম্মে তো ছিলেন কুলীন ব্রাম্ভন ঘরে, খানকয়েক কুলীন ঘরণী নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে বসে হুঁকো টেনে এটা-সেটা নিয়ে গপ্পো করলেই তো হতো। নিদেন পক্ষে একটা টোল খুলে কিছু পণ্ডিতি আর পূজা করে চাল-কলা-মণ্ডা যা আসতো দিয়ে দিব্যি তো কেটে যেতো নিশ্চিন্ত জেবন। সে না করে এতো হাঙ্গামা করতে গেলে কেন বাপু? নিজে তো শান্তি তে থাকলেই না একগাদা মানুষকে খামকা ঝামেলায় ফেললে! কোন শয়তান মাথায় ভরে করেছিল বল দিকি? এক্কেরে গেঁয়ো-টুম্পা হয়েও আপনার বিধবা বিবাহে এতো আগ্রহ কিসের ? কিসের টান আর দরদ ওঁদের প্রতি, অ্যাঁ? আর সে টান এমনই যে নিজের ছেলেরই বিধবার সাথে বে দিলো যাকে বলে একেবারে দাঁড়িয়ে থেকে, এ কেমন বাপ গা! ছ্যাঃ ছ্যাঃ – বাঙালী হিন্দু তায় সদব্রাম্ভনের পো, সেই কিনা এমন বেজেতে কারবারে মাতল গা । এ সবই ঐ মেলেচ্ছ পাড়ার সাথে মেশার ফল। কে জানে কোন মেম-টেমের পাল্লায় পড়েছে কিনা, হয়তো ঐ দোহাই দিয়েই বিধবা বে চালুর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ… দেশকে একেবারে রসাতলে পাঠাল। কোথায় হিন্দু বেধবা সতী হওয়ার জন্যে চিতায় উঠবে আর আমরা কালেকালে রুপ-কানয়ারের মন্দির বানাব পোখরানের পাশেই, তা না বেধবা বে। আরে সতী না হয় না হলি তালে চাট্টি ভাতেভাত, ডাঁটা আর আতপ সেদ্ধ খেয়ে আমাদের নজরের তৃপ্তি দিয়ে বাড়ির কাজ কর গে যা। বয়স বাড়লে আমাদের ঘরের নাতিপুতিদের গপ্পো শোনা। না হয় আর একটু বুড়োলে কাশী গিয়ে ভিক্ষে করবি, সেও তো মোক্ষলাভ, স্বয়ং ভোলানাথ এসে ভিক্ষে দিয়ে মানবজীবন উদ্ধার করবে। তা না বেধবার আবার শখ-আলহাদ ? এক জীবনে এক সোয়ামী খেয়েও শখ মেটে নি, আরও খিদে! বেধবার যদি কিছু থাকা দরকার তা হল সংযম আর ঈশ্বর চিন্তা। আমাদের সনাতন ধম্মে তাই শিকিয়েচে। আর এ কিনা এলো বে দিতে। আর কিছু বাকি রইল কলিকালের?

কতো করে ডেকেছি ওসব অনাচার ছেড়ে আমাদের দলে এসো। যা চলছে, যেমন চলছে, যেভাবে চলছে চলতে দাও। মানেমানে দলে ভেড়ো নয়তো লাইফ হেল করে দেবো। বারেবারে বুঝেয়েচি, একে পাঠিয়ে ওকে পাঠিয়ে এমনকি শেষমেশ লেঠেলও – কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। বেশ, আমরাও কি ছাড়ার পাত্তর। ছাড়িও নি, পথে বেরুলেই টিটকিরি মেরেচি, ঘরের সামনে গিয়ে লোক পাঠিয়ে গাল দিয়েচি, বেধবার সাথে জুড়ে নিন্দে করেচি, যে যে সঙ্গে যেতে চেয়েছে তাদেরকেও ভয় দেখিয়েচি, একঘরে করেচি – আরও কতো কি… ! কে বলে এসব শুধু আজকের আমলেই হচ্ছে, সেই কবে থেকে আমরা এসবে হাত পাকিয়েছি। আমাদের বাপু সোজা কথা – হয় তুমি আমাদের দলে নয় তুমি শত্তুর। আর শত্তুর বধ করতে যতদূর যেতে হয় যাবো। আমরা তো সায়েবদের কানে অব্দি গিয়ে লাগিয়ে এয়েচি। একে মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে পোর।
শেষমেশ তো অকথা-কুকথা দিয়ে গান বাঁধিয়ে পথেপথে গাইয়েওছি – “ বেঁচে থাক বিদ্যেসাগর চিররুগী হয়ে”…

তবু কেমন গোঁয়ার দ্যাখো কিছুতেই পিছু হটে না, কিছুতেই দলে আসে না। বলে কিনা, বরং একলা হবে তবু পিছবে না। শুধু তাই না আবার বই লিকেচে। বন্নপরচিয়। বাঙালী কি কথা কোইতে জানে না, যে অ আ ই ঈ শেখাবে। উনি এয়েচেন যত অলুক্ষুনে কাণ্ড নিয়ে। বলে কিনা মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে। বই না পড়িয়ে যদি বেধবা গুলোকে চিতায় পুড়োত তো তাও বুঝতাম, তা না নারীশিক্ষা। বন্নপরচিয়। রোসো টের পাওয়াব বন্ন, অক্ষরে অক্ষরে। যখন বুড়ান্তিকালে দেবো নিব্বাসন বিহারের কর্মাটারে, তখন বুঝবে মেদিনীপুরে ভগবতী-দেবীর মতো মায়ের কোলে ঠাকুরদাস বারুজ্জের ব্যাটা হয়ে আজকে এই ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে জন্মানোর ফল।

হু হু বাবা! আমরা বাঙালী। আমরা এখনো বেঁচে আছি। আর এ বাংলা এখনো আমাদেরই। এখনো বাংলার কোটি-কোটি মানুষ আজো তোমার বন্নপরিচয় উল্টেও দ্যাখে নি। কেও কেও মাঝেসাঝে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে যদিও বলেছে – এই জেলা আজ থেকে সাক্ষর হ’ল, কিন্তু আমরাতো জানি সত্যি কি। হি হি… এমনকি তোমার জেলায়ও গো – বিদ্যেসাগর মশায়, ইংরেজ গেছে কিন্তু তবু ভেঙ্গে ২ টুকরো তোমার জেলায়ও তোমার বন্নপরিচয়ের অধিকার কায়েম করতে দিই নি। ওখানের অধিকারী – উঁহু তুমি নও, সেও আমাদেরই লোক।

আর তোমার ঐ – কদাচ কুবাক্য কহিও না। সদা সত্য কথা কহিবে।
খিক-খিক, এসব কথা বাংলা তো ছার যদি মুখবই-তে দিই তো, লোকে নির্ঘাত জিজ্ঞেস করবে – কোত্থেকে পেলে এ জোকস? শুধু কি এমনি লোক, তোমার গোপালও আজকাল জেনে গেচে খাঁটি সত্যি তে গয়না গড়া যায় না। কিন্তু জেনে আর কি হবে, এতো গোবেচারা যে ওকে দিয়ে কোন কাজ হয় না। একগাছা দড়ি নিয়ে একবার করে কড়িকাঠের দিকে চায় আর তোমার মুখ মনে করে ফিরেফিরে এসে ঘরে কজনকে পড়াতে থাকে – কারো মনে দুঃখ দিবে না।
তবে হ্যাঁ, হয়েছে বটে রাখাল। আমাদের সম্পদ। সে আজকাল বেওসা আর সমাজসেবায় ভারী ব্যস্ত। এতো বুদ্ধি যে সবসময়ই কি করে যেন শাসকদলেই থাকে। তখনো ইংরেজ সায়েবের সাথে ভাব ছিল এখনো পুলিশের সাথে দহরমমহরম। ব্যাগে শুধু শুধু লাল-কমলা-সবুজ-নীল-কালো পাঞ্জাবি নিয়ে ঘোরে। এখন অবিশ্যি সবুজ পাঞ্জাবিটা ওর ব্যাগে নাই।

তবে হ্যাঁ তোমার কোথা একেবারে ভুলিনি। ঐ নিব্বাসনের জায়গাটায় যে রেল ইস্টেশান টা আছে ওটা তোমার নামে করার বন্দোবস্ত হয়েচে। আর আজকের দিনটায় একটু মালা-টালা দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু সে তোমার বেধবা বে-র জন্যে ভেবে শান্তি পেও না, ঐ তোমার মুখপোড়া মধু কবি কে মেলেচ্ছ দেশ থেকে বাঁচিয়ে স্বদেশে নিয়ে আসার টাকার বন্দোবস্ত করার জন্যে। আর কেও জানুক না জানুক আমরা তো জানি, ঐ হ’ল দ্যাশের পথথম ‘ঘর ওয়াপসি’। তাই আর কি। তবে সব মিলিয়ে তুমি হেরেই আছো আজো, তোমার জম্মের এই প্রায় একশো বছর পরেও। আর এ বাংলায় তুমি ফিরেই কি করবে বরং ঐ নিব্বাসনেই থাকো।

আমি বরং যাই, গঙ্গাপাড়ের নীল বাড়িতে গিয়ে ছবিতে মালাটা দিয়ে সনমান জানিয়ে আসি …

  • লিখেছেন আশিস সিনহা, অ্যামেরিকা থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *