যাত্রার শুরু

আমি তখন ক্লাস নাইন, কলা শাখার ছাত্র। মানবিক শাখায় হাতেখড়ির শুরু সবে মাত্র। ন-লেজ  সে জাতীয় গজায় নি বটে তবে এক জাতীয় ক্যারেজ গজিয়েছিল, কিছুটা। সেটা অনেকটা অজ্ঞানতার আনন্দে ভেসে চলা, অবিমৃষ্যকারীদের যেমনটা হয়ে থাকে।-আদপে, যা ‘ফুলস্‌ রাস—হোয়ার এ্যঞ্জেলস্‌ ডেয়ার’ গোছের ব্যাপার। হিন্দু স্কুলের নাইন-এ তে ছাত্র ছিল মাত্র ন-জন। শিক্ষকের টেবিলের চারপাশে ঘিরে প্রাইভেট টিউশন পড়ার মতো ক্লাস হয়। অন্য স্ট্রীমের ছাত্ররা অফ্‌ পিরিয়ড পায়না, সপ্তাহে আমাদের চারটে করে অফ্‌ পিরিয়ড বরাদ্দ। তার ওপর সংস্কৃত শিখে গেছি বলে ভাবি। বাড়িতে স্বদেশী সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি ছিল অনুকূল একটা মনোভাব, আর তা চর্চার জন্যে  কিছুটা মুক্ত পরিসর। সেই বলে বলীয়ান হয়ে মনের ভাব যেন ভারতীয় সভ্যতার মর্ম মূল অব্দি অবাধ গতি অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনীর কবিতা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতিস্মর ইত্যাদি গল্প, ঐতিহাসিক উপন্যাস, বারীন্দ্রনাথ দাসের শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব, মীরা ও মল্লার প্রভৃতির রচনায় যে বেগবান প্রানবন্ত জগতের আভাস মেলে তাকে আত্নসাৎ করে নিই আপন উত্তরাধিকারের অঙ্গ বলে। একটা সম্পূর্নাঙ্গ জীবন বোধ আভাসে ছায়া ফেলে যায় মনের আঙ্গিনায়। নিজেদের মনে করি ঘোর সংস্কৃতি মনস্ক। ইংরেজীটা জানিনা। বাড়িতে তিন চারটে কম্‌প্লিমেন্ট্রি ইংরেজী কাগজ আসে। সেগুলো ভালো করে পড়তেও পারিনা—তাই ধারও ধারি না। আর ধার ধারবার আছেটা কি ? কিছু দিন পরই তো আর ইংরেজীর দরকার হবেনা। তাই মহাভারত খুব একটা অশুদ্ধ হবে না।

      কেমন করে জানি এমনই একটা ভাবনা বদ্ধমূল হয়েছিল সে সময়। ভারি অদ্ভুত ধারণা। আর তা মনের মধ্যে ধারণা পুষে রাখলে-ঠেকায় কে ? এরকম অবস্থায় এক দিন ‘দান্তে’ (ইতিহাসের শিশির হাজরার ডাকনাম) মন্তব্য করেছিলেন, “এখন যে সুখের সময় পার হয়ে যাচ্ছ, তা আর কোন দিনই ফিরে আসবে না, বুঝেছ হে বাঞ্চ অফ্‌ ইডিয়েটস”-। ভাবলাম সুখ কোথায় দেখতে পেলেন, স্যার ? ‘ভালো ছেলেরা’ স্যায়েন্স পেয়েছে—আর্টস্‌ পড়ে চাকরী জুটবে কিনা কে জানে ? তাতে অবশ্য পরোয়া নেই? যদি দুঃখ সহিতে হয় তবু নাহি ভয় নাহি ভয়।” দারিদ্রের মধ্যেই তো উচ্চ আদর্শের পরীক্ষা। (তবে আজ পিছন ফিরে সুনিশ্চিত ভাবে মানতে বাধ্য যে সে দিনের ‘দারিদ্র’ আর উচ্চ আদর্শ’ সম্পর্কে ধারণার অনেকটাই ছিল তাত্ত্বিক, তাতে অবশ্য আন্তরিকতার কোনোও ঘাটতি ছিল না।) সে দিন ঘরে বাইরে নিজেদের ভাবনার অনুরূপ স্বীকৃতি নেই। অথচ বাইরে অবিচলিত ভাব দেখালেও—ভেতরে ভেতরে অস্বস্তির চোরাস্রোত—এই নিয়ে ‘ভালো সময়’ ! ভালো সময় তো বাকি পড়ে আছে, সামনেই আসছে—যখন খবরদারি করার থাকবেনা কেউ,থাকবে না— ওরে পড়, পড়; ওরে করিস না, এটা বলিস না, ওটা করতে নেই বলতে আসবেনা কেউ। তখনই না আসল মজা। এর পর একে একে আসতে শুরু করল সেই সব মজাগুলো।

       ১৯৬৯ সালের গরম কালে পৈতে হলো।  বয়েস পেরিয়ে যাওয়ার দরুণ প্রায়ঃশ্চিত্ত করতে হয়েছিল। ঢলঢলে হাফ প্যান্টে মোড়া সিড়িঙ্গে শরীর, লিগ্‌লিগে হাত-পা, হাড়্‌গিলে মুখ,ন্যাড়া মাথা নিয়ে বয়ঃসন্ধির রূপ খোলতাই হয়ে বেরিয়ে পড়েছে এই সময়কার একটা ফোটোগ্রাফে। কলকাতায় আমাদের সেই আধা সহুরে পরিবারে দন্ডি ঘরের পর্বটা হয়নি। কারণ আগের প্রজন্মের সকলেরই পৈতে হয়েছিল লাভপুরে মহাপীঠের অধিষ্ঠাত্রী মা ফুল্লরার সামনে। উপনয়ন হোম শেষ হবার পর দেবীর মুখদর্শনের মধ্যে দিয়ে পূর্বপুরুষদের দন্ডি ঘরে আবদ্ধ থাকার আর প্রয়োজন পড়েনি। এবার আগের পরম্পরা আর শহুরে প্রয়োজন (তিন দিন ধরে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে সদ্য উপনীতকে ঘরে বন্ধ রাখার সমস্যা) সামাল দিতে দক্ষিণেশ্বরে মা-কালীর মুখ দর্শন করিয়ে দন্ডি ভাসিয়ে গঙ্গা স্নান করে ব্রহ্মচর্যের অবসান হল। কিন্তু ঐ সময়টুকুই কি কম বিড়ম্বনার ? গেরুয়া কাপড়ে ন্যাড়া মাথা ঢাকতে গিয়ে সদ্য কাটা চুলের গোড়াতে কাপড় আটকে যায়। গাড়ি থেকে নেমে জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদে তপ্ত দক্ষিনেশ্বরের পাথরের চাতালের ওপর দিয়ে খড়ম পরে হাঁটতে গিয়ে দুটো আ ঙুল দিয়ে খড়মটাকে আয়ত্বে রাখার জন্যে যে কাঠটা থেকে সেটা গেল খুলে। এক হাতে দন্ডি অন্য হাতে খড়ম ধরে, ঘোমটা সামলে দন্ডি বিসর্জন দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমিই এক দর্শনীয় বস্তুতে পরিনত হয়েছি। দু-চার জনকে  প্রণামও করতেও দেখলাম। এরপর বাধ্যতামূলক ভাবে ত্রি-সন্ধ্যা গায়িত্রী জপ—রীতিমত নজরদারীর অধীনে—যা দু-চক্ষের বিষ। পরের দিন পরের ভাইটির পৈতে হলো, আর তার পরের দিন বাড়ির পেছনে বাণীমার নব-নির্মিয়মান বাড়িতে নেমন্তনের খাওয়াদাওয়া। কিন্তু পারিবারিক প্রথা মতো কোনো নেমন্তন্ন পত্রের ব্যাবস্থা হয় নি। আর পৈতের নিট লাভ হয়েছিল অর্থ বোধ সহ গায়ত্রী মন্ত্রটি। জল স্থল অন্তরিক্ষের প্রসবকারী জ্যোর্তিময় দেবতার বরেণ্য’র কাছে শূভবুদ্ধির প্রেরণা যোগান চাওয়ার এমন সর্ব সমন্বিত প্রত্যাশা—নিজের সামনে একটা সুউচ্চ সুউন্নত বোধ ধরে দিল।

   

   ওদিকে বিগত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশ অস্থির, ঘন-ঘটনা বহুল হয়ে পড়ছিল। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে বারোটা দলের যে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল তাতে দক্ষিণ থেকে বাম সব পন্থীরাই যোগ দিয়েছিল কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মত ও পথের বহু অমিল থাকায় জোট বেশি দিন টিকলো না। নভেম্বর মাসে ডাঃ প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিধায়ক (এই শব্দটাই তখন চালু হয় নি) কংগ্রেসের সহযোগিতায় মন্ত্রী সভা তৈরি করতে অগ্রসর হলে পূর্ব্ববর্তী স্পীকার বিজয় ব্যানার্জী সুবিখ্যাত রুলিং দিয়ে  বিধান সভার অধিবেশন বসাই অসম্ভব করে দিলেন। ফলে ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে দু দফায় ছ-মাস করে এক বছর রাষ্ট্রপতির শাসন জারী থাকার পর ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আবার নির্বাচন হলে তাতে কংগ্রেসের হয় ভরাডুবি,যুক্তফ্রন্টের বিপুল জয়। কিন্তু শিল্প ও কৃষি নীতি অর্থাৎ শ্রমিক কৃষকদের প্রতি সরকারে দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক রীতি-রেওয়াজ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম থেকেই বিভিন্ন বাম দলগুলির মতপার্থক্য নিরুচ্চার ছিলনা। ফলে ১৯৭০ সালে মার্চ মাসে মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। আবার এক বছর রাষ্ট্রপতির শাসনের পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ভোট হল। ব্যাপক কারচুপি করে বরানগর কেন্দ্র থেকে জ্যোতি বসুকে হারানো গেলেও যুক্তফ্রন্টকে একেবারে মুছে দেওয়া গেল না। কংগ্রেসের সমর্থনে অজয় মুখোপাধ্যায় এপ্রিল মাসে আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জুন মাসে পদত্যাগ করলেন। চার জন উপদেষ্টার সাহায্যে রাজ্যপালের নেতৃত্বে আবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারী হলো। রাজ্য রাজনীতির এই পট পরিবর্তনে আমাদের কোন ভূমিকাই ছিল না, কারণ ভোটাধিকারই তো নেই। তবে  ওগুলো শুধু ঘটনাই ছিল না,অনেকটা ছিল জীবনের চলমান পাঠ্যক্রমে শিক্ষানবিশীর মহড়া। বে-আইনি জমি জবর দখল, ধান কাটা, ঘেরাও (সম্পূর্ণ নতুন বিষয়), কল কারখানায় লক আউট, মিছিল, মিটিং, হরতাল (বনধ্—শব্দটা তখন সবেমাত্র উঠছে), যানজট, পথ –অবরোধ, বিক্ষোভ প্রদর্শন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক আদান প্রদানের অঙ্গ হয়ে ঊঠতে লাগল। পরিবারের কেউ প্রত্যক্ষ ভাবে ঐ ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে যুক্ত না থাকায় বিশেষ সমস্যার সামনে পড়তে হয়নি। কেবল ঘন ঘন স্ট্রাইক ইত্যাদির কারণে দাদু স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলে আমাদের থেকে থেকে ছুটির বন্দোবস্ত হয়ে যেত।

ইতিপূর্বে ১৯৬৭ সালের মে-জুন মাসে শিলিগুড়িতে গরমের ছুটি কাটানোর অবসরে শুনে আসা নকশালবাড়ির হাটুরে গন্ডগোলের ফল এই সময় ধূমায়মান ঘটনার আকারে সেজে উঠতে শুরু করল। ১৯৬৯ সালের মাসে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সি পি আই (এম-এল)। শুনলাম তাদের স্লোগান, “দিকে দিকে ডাক পাঠাই, মাঠ পাথার বন্দরে—ক্ষেতে কিষাণ, কলে মজুর–তৈরি হও জোট বাঁধ।”—খুব শীঘ্রই তারা নকশাল পন্থী বলে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করলো। 

       ওদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রবেশ করছে নতুন এক পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক ঠান্ডা যুদ্ধে পশ্চিমী দুনিয়া যত ঘৃণিত, ধিকৃত আর নিন্দিত; এর পাশে পাশে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ভূমিকা তত উচ্চ প্রশংশিত ও সুউচ্চ রশ্মিতে আলোকিত। কিছু পরে অবশ্য বাহবা কুড়িয়ে ছিল ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে গড়ে তোলা জেমস বন্ডের বই আর সিনেমাগুলো। কিন্তু ভিয়তনামে  মার্কিনী বর্বর অত্যাচার আর সেখানকার অধিবাসীর আত্মত্যাগ,স্বার্থক প্রতিরোধ আর তাতে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার গৌরবোজ্জল পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহায়তার কাহিনী মন টানে। ভিক্ষে করে এনে রুদ্ধশ্বাসে রাতারাতি পড়ে শেষ করেছি এডগার স্নো’-র লেখা ‘রেডস্টার ওভার চায়না’, লিউ বোছেং-এর লংমার্চের কাহিনী, নিকোলাই অস্ত্রভিচের ‘ইস্পাত’, জন রীডের ’দুনিয়া কাঁপানো দশটি দিন’, জুলিয়াস ফ্যুচিকের, ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’, চিন্‌চিঙ মাঈ-এর ‘বিপ্লবের গান,’ক্যাপ্টেন বলাই দাসের

‘বোম্বে নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া বাড়িতে পেয়েছিলাম ‘কফির স্বাদ তেঁতো, লবঙ্গ বনে ঝড়, বিক্ষুব্ধ রোডেশিয়া’র মতো বহু বই।

      নিত্যকার লেখাপড়া, খেলাধুলো, গল্পের বই পড়া, দেওয়া নেওয়া করা, ঠাট্টা-ইয়ার্কি, মজা করার সুত্রে বা তার বাইরে স্কুলে বা পাড়াতে যাদের সঙ্গে আদান প্রদান চলত—তারা একাংশ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের মতো হলেও দেখতাম কথাবার্তায় কেমন যেন আক্রমনাত্মক—সর্বদাই যেন আদৃশ্য কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাগ্‌যুদ্ধে জেতার জন্যে যুক্তিজাল সাজিয়ে চলেছে, সারাক্ষণ। বক্তব্যের ঝোঁকটা বামপন্থীদের দিকে, সোজা কথায় ক্যমুনিষ্ট ভাবাপন্ন; আর এই দিকে আমার চেয়ে অনেক বেশী তথ্যে সম্বৃদ্ধ। স্তম্ভিত বিষ্ময়ে শুনে যাই তাদের আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা। ঐ সব তথ্য অভিজ্ঞদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে যে এ দুনিয়ার শ্রেণী আছে দুটো—শ্রমিক আর মালিক। শ্রমিকদের ঘামে রক্তে কষ্টার্জিত সম্পদে ধনীরা কেবলই স্ফীত হয়ে চলেছে-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম অনিবার্য। শ্রমিকদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছুই নেই—জয় করার জন্যে আছে সারা দুনিয়া। ইতিমধ্যে রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবাতে সাফল্যের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর রাজ কায়েম হয়েছে। অন্যান্য দেশেও সংগ্রাম আসন্ন। ভারতের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সমস্যা হলো আমদের বেদ উপনিষদ গীতা শেখায় সংসার বিমুখ হতে; আমাদের জাতপাতের রাজনীতি শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্রতর হয়ে উঠতে বাধা দিচ্ছে; ইতিপূর্বে অনুসৃত স্বাধীনতা সংগ্রাম বিপুলাংশে সমঝোতা, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র ও ভ্রষ্ট পুঁজিবাদের পাওয়ার শেয়ারিং; জোড়াতালি দেওয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করে সম্পদ আত্মসাৎ করার কাহিনী। আমাদের সশস্ত্র বিপ্লববাদ সার্থক না হওয়ার জন্যে দায়ী সুচিন্তিত কর্মপন্থা বিহীন,জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন, আবেগ সর্বস্ব হটকারী চিন্তাধারা। জাতীর জনক বলে পরিচিত গান্ধীজি আদতে ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল, অহিংসার রাজনীতিতে আপোষ করে ইংরেজদের জায়গায় ক্ষমতায় বসিয়েছে পুঁজিবাদীদের দালালদের। । এ সবের কারণ দেশটা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া দ্বারা শাসিত, যারা দেশটাকে বিক্রি করে চলেছে। —আর তাদের ধরিয়ে দেওয়া ক্যলিডোস্কোপে চোখ রেখে শুনতে ভালো লাগে যে যুদ্ধ শেষ হয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হলে বিচার করা হবে বলে নিজেরা আধপেটা খেয়ে শ্রেণীশত্রুদের ভরপেট খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার ভিয়েতনামী কাহিনী। বিপ্লবোত্তর চীনে প্রত্যেক মানুষকে গাড়ি দিতে না পারলেও সাইকেল দেবার উদ্যোগের কথা শুনে—শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নত হয়ে আসে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়ে যাবার কুড়ি বছর পরেও চীনে মূল্যস্তর অপরিবর্তিত রয়েছে। মস্কোতে দশ কোপেক দিয়ে গোটা শহর ঘোরা যায়।  সে দেশে বেকার ভাতা ও কাজের অধিকার সুরক্ষিত থাকায় কাউকে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিঘ্ন হতে হয় না। কিউবাতে সকলের বিশ্বমানের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত। আর সে তুলনায় ভারতবর্ষে চালে কাঁকড়, দুধে জল, ঘি-তে চর্বি; সরকারী দপ্তরে ঘুষ; স্কুল কলেজে কেরানী বানানোর মহড়া; আর হয় কথায় নয় কথায় মার্কিনি কানমলা।

     নিজের  ভেতরে চলে উথাল পাথাল।  ও পারের সব কিছুই তো ‘মহান।’কিন্তু এপারে আমাদের সঠিক অবস্থানটা কোথায় ? শেষমেশ আমারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি ? আর তার ভবিষ্যৎটা কি ? যেন দেখতে পাই—তাদের জ্বলে বাতি, তাদের ঘরে সাথী—আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা ? পুঞ্জীভূত বুদ্‌বুদের মতো প্রশ্ন উঠে আসে—এরাতের শেষ কোথায়। এ রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ? মুক্তি তাহলে কোন পথে ?  উত্তর ভেসে আসে, “চীনের পথ মুক্তির পথ, বিপ্লবের পথ আমাদের পথ। সব সমস্যর সমাধান একটাই—সমাজতন্ত্র কায়েম করা। সমাজতন্ত্র মানে সাধ্যমত খাটো আর প্রয়োজন মতো পাও। আর তা যেহেতু এখনি করে ফেলা যাচ্ছে না, তাই সর্বোতভাবে দেশী বিদেশী পুঁজীর প্রতিরোধ করা। যেহেতু ‘নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ এ্যান্ড পলিটিক্স্‌ ‘—তাই অবক্ষয়গ্রস্ত ক্ষমতা আঁকড়ে পরে থাকা লোকদের হাটাবার জন্যে সৎঅসৎ যেকোনো রাস্তাই গ্রহন করা বৈধ। তার জন্যে দরকার হলে এক পয়সা বাস ভাড়া বাড়াবার বিরোধিতায় বারো ঘণ্টার মধ্যে চোদ্দটা ট্রাম পোড়ানো চলে; উর্দ্ধতন কর্মচারীর স্বৈরাচার রুখতে কি কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা করতে কাজের সময়ে প্রয়োজন হলে মিটিং মিছিল সমাবেশ ডেপুটেশন দেওয়া বাধ্যতামূলক; পাড়া ঘরে, অফিসে আদালতে নিয়মের ওজুহাতে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পথে বাগড়া দেবার জন্যে আছে যারা তাদের নিস্ক্রিয়  করার জন্যে সকলকে নিয়ে তার বিরুদ্ধে একটার পর একটা  প্রতিরোধ সৃষ্টি করে চলা। আর একটু বড় লেভেলের লোক—বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত, যাদের সিআই-এ ইতিমধ্যেই কিনে নিয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে—তাদের মুখোস খুলে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

      ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে হিন্দু স্কুলে  এগজিবিশনের আয়োজন হল। আমাদের মানুষ হবার সিঁড়ির আরেকটা ধাপে পা রাখলাম যেন। এগজিবিশনের কাজের অজুহাতে স্কুল থেকে বাইরে যাওয়া আবার ঢোকার বিধি নিষেধে একটু যেন ঢিল পড়ল। সরকারী স্কুলে কোনো কিছু করতে গেলেই নানা নিয়ম কানুন আমলাতান্ত্রিক, পিছুটান খাড়া হয়ে যায়। তাতে আবার চাঁদা তুলে, ক্লাস রুমের চেয়ার টেবিল উল্‌ঢাল করে, ল্যাবোটারী থেকে যন্ত্রপাতি অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে অচলায়তনের ভিত্তিমূল ধরে প্রায় নাড়া দেওয়া হলো। স্বাভাবিক ভাবেই  নিয়মানুগ প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ প্রামাণিকের পক্ষে এতো বেনিয়ম করতে দেওয়া কঠিন ছিল। ফলে দিন দশেক চলার পরেই উঁনি অনুষ্ঠান শেষ করতে বললেন। কিন্তু উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা যে হট্টমেলা সাজিয়ে বসেছিল এতো তাড়াতাড়ি সেই মিলন মেলা ভাঙতে রাজি হচ্ছিল না। এর পিছনে হেড স্যারের বিরুদ্ধবাদী কিছু শিক্ষকের মদত ছিল। ফলে যে সংঘাত লাগলো তাতে গান্ধীবাদী সত্যানন্দবাবু গান্ধীগিরি শুরু করলেন—ছুটি নিয়ে বাড়িতে থেকে স্কুলের কাজকর্মে অচলাবস্থা এনে দিলেন। শোনা গেল ছাত্ররা নিজেদের আচরনের জন্যে ক্ষমা না চাইলে উঁনি কাজে যোগ দেবেন না। ছাত্রদের মিটিং বসল, ক্লাস নাইন-এ’র পক্ষ থেকে আমরা হেডস্যারের কাছে ক্ষমা চাইবার পক্ষে মত দিয়ে বিপক্ষীয়দের হাতে কিছুটা অপদস্থ হলাম। অন্তরালে কি বন্দোবস্ত হল জানা নেই। দেখলাম স্যার আবার আসতে শুরু করেছেন, আবার দৈনন্দিন ক্লাসের চক্র শুরু হতে চলল। কিন্তু অল্প অল্প করে  জমে উঠতে লাগল কলেজ স্ট্রিটের রাজনীতি; নকশালবাড়ির রঙ্গমঞ্চ।

    বেশ কিছু দিন ধরেই সি-পি-আই (এম-এল) এর রাজনৈতিক ধ্যান ধারনা বিকশিত হতে চলেছিল। সি-পি-এম ছেড়ে যেমন কিছু লোক এতে যোগ দিচ্ছিলেন, তেমনিই আবার অদর্শ-তাড়িত ছাত্র যুবকরাও এসে সমবেত হতে শুরু করেছিলেন শুনছিলাম। চারু মজুমদার ও তাঁর বাবা শিলিগুড়িতে মামার বাড়ির সঙ্গে ভালো রকম পরিচিত ছিলেন। চারুবাবুর বাবা  বীরেশ্বর মজুমদার মানুষ হিসেবে বেশ ঠোঁটকাটা ছিলেন; যেখানে সেখানে দুম করে অস্বস্তিকর মন্তব্য, কি আলটপকা কথা বলে দিতে দ্বিধা করতেন না। আমাদের মা ও মাসীর এক বাড়ির দুই ভায়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় উঁনি নাকি দাদামশাইকে জিজ্ঞাসা করে বসেন যে নিজের দুই মেয়ে ভবিষ্যতে যখন পরষ্পরের জা হয়ে ঝগড়া বিবাদ করবে—তখন বাবা হয়ে উঁনি কোন পক্ষ নেবেন ? চারু মজুমদারের পড়াশুনোর গণ্ডি ছিল বিশাল পরিব্যাপ্ত—ছাত্রাবস্থাতেই যা গল্পকথায় পরিণত হয়েছিল।  কিন্তু পরীক্ষার নম্বরে তা প্রতিফলিত হতো না।। সেটা কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার আটঘাট মানিয়ে চলতে না পারার জন্যে নয়—যেমনটা বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর পায়ে বলিপ্রদত্ত অনেক প্রতিভাবানদের হতে দেখেছি।সমস্যাটা ওঁর চিন্তাপদ্ধতি সমুদ্ভূত। পরীক্ষা দিতে বসে উঁনি নাকি পাস করার মতো নম্বরের উত্তরই শুধু লিখতেন—বেশী নয়। ওঁনার প্রতিভার এইরকম অনেক গল্পই মা ও মামারবাড়ির লোকজনের কাছে শুনেছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক কাজকর্ম ও ততোই নিবিড় পড়াশুনোর মধ্যে দিয়ে চারু মজুমদার সমকালীন কম্যুনিষ্ট রাজনৈতিক কর্ম পদ্ধতিতে আস্থা হারান। এরপর তিনি ক্রমেই চীন দেশে মাও-সে-তুং প্রদর্শিত মত ও পথের সমর্থক হয়ে ওঠেন। এরা কৃষকদের নিয়ে গেরিলা সৈন্য বাহিনী তৈরি করে, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।যেখানে জমির প্রকৃত ব্যবহারকারী কৃষকদের মধ্যে সমস্ত জমি বন্টন করে, কৃষকদের কমিউন গঠন করার মাধ্যমে সমবায় পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করে এক একটি সমাজতন্ত্রের আঁতুর ঘর গড়ে তোলার কথা প্রচার করেন। জোতাদারদের (ক্ষতি পুরণ না দিয়ে) জমি থেকে উচ্ছেদ করে (দরকার হলে খতম করে) কৃষি বিপ্লব সম্পন্ন করার কথা তোলেন। এখানে বিপ্লবপূর্ব জগতের রীতিনীতি, আইন-কানুন, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ—সবকিছুই নিঃশেষে পরিত্যাগ করে বিপ্লবোত্তর প্রকৃত শোষণ-মুক্ত সমাজ স্থাপন করার মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে। খুব শীঘ্রই সেই জীবন দর্শন আমাদের জীবনের মধ্যে বড় একটা আবর্ত ঘনিয়ে তুলল। স্লোগান উঠেছিল “চীনের চ্যেয়ারম্যান আমাদের চ্যেয়ারম্যান; চীনের পথ আমাদের পথ।পার্লামেন্ট শুয়োরদের খোঁয়াড়; নির্বাচন ব্যবস্থা শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা জনগনের চোখে ধূলো দেবার প্রহসন। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা যে ঔপনিবেশিক আমলে কেরানি তৈরি করার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল সে তো দেখাই যাচ্ছিল। আনন্দের সঙ্গে বিদ্যার্জনের সুযোগ সেখানে কোথায় ? কোথায়, “দুর্জয় শক্তিসম্পদ মুক্তবন্ধ সমাজ?  সেখানে  কোথায় চিত্তের ভয় শূন্যতা, কোথায় জ্ঞানের মুক্তি ? সর্বকালে সব দেশে যা হয়েছে এখানেও ঐ চিন্তায় প্রভাবিত হলো একদল সত্যি করে মেধাবী ছাত্র। মেধাবীদের নিয়ে সমস্যা হচ্ছে যে তাদের লেলিহান চিন্তা বহ্নিতে অগ্নিমান্দ্য এলেই মুস্কিল। তারা যখনই যে কাজ করে তাতে প্রাণ লড়িয়ে দেয়। আর সেই কর্মোদ্যমে বাধা এলেই কুঁকড়ে যায়। ঐ যুগের ওপর অনেক পরে লেখা বাণী বসুর ‘অন্তর্ঘাত’ বইটি-এর সার্থক নিদর্শন।তাদের চেতনা প্রভাবিত করলো অন্যান্য বন্ধুদের। ঐ ‘বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা’ অবসান ঘটানোর জন্যে লাইব্রেরী, ল্যবরেটারী,ক্লাসরুম, অপিস ঘর সব কিছু পুড়িয়ে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেই পথ নির্দেশ কাজে লাগতে গিয়ে হিন্দু-হেয়ার-সংস্কৃত’র মতো স্কুল আর প্রেসিডেন্সির  কলেজের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ্যাকশন চালালো (এই স্কুলের ছাত্ররা অন্য স্কুলে, অন্য স্কুলের ছাত্ররা এই স্কুলে)। যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে, কিছু কাগজপত্রে আগুন লাগিয়ে দু-তিনটে বোম ফাটিয়ে লাল পতাকা তুলে এই এলাকাটাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে স্লোগান দিতে দিতে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বালা হলো। ঐ রকম টালমাটাল এক দিন বাংলার শিক্ষক প্রফুল্ল সমাদ্দার মশাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সরকারী স্কুলে ভাঙচুর  করে কি কোনো সুবিধা হবে ? কালই আবার  দেখবে ল্যবরেটারী সারিয়ে, ভাঙা বেঞ্চি চেয়ার পালটে দেবে। যাও, দেখো গিয়ে তাদের, যারা তোমাদের ওপর হুকুম চালাবে তারা কেমন একনিষ্ঠ ভাবে নিজেদের তৈরি করে চলেছে।”  সত্যিই লক্ষ্য করার বিষয়, কলকাতার একটিও ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে সে আমালে কোনো গণ্ডগোল হয়নি।

     মাত্র আড়াই দশক আগে অর্জিত স্বাধীনতা অনেকরই অনেক স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারেনি। স্বাধীনতা উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যখন নব নির্মানের জোয়ার শুরু হচ্ছে, সেখানে বাঙালীদের বরাতে জুটেছে দেশ বিভাগ, উদ্বাস্তু ও তাদের পুনর্বাসনের সমস্যা, যাতে গোটা জাতিটা ‘গত গৌরবহৃত আসন নত মস্তক লাজে’ দিশেহারা বিহ্বল। নিজেদের প্রদেশের অর্থনীতির ওপর বাঙালীদের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিনই হাতছাড়া। আর স্বাধীনতা উত্তরকালে সরকারী উদ্যোগে যে কটাই ভারী শিল্প হয়েছিল—সেসব ইটপহেভি, ক্যপিটাল ইনটেন্সিভ ও অস্তাচলমুখী (sunset industry) মোটকথা সেগুলো থেকে বৃহৎ হারে চাকরি বাজার গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বাঙলার অর্থনিতিতে গ্রহণ আসন্ন করে তুলেছিল। সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা কিছুটা সেই ঝোড়ো দিনের অবর্তে পড়ে, কিছুটা বয়েস কালের আবেগ আর কিছুটা শিক্ষান্তে রোজগারের সুনিশ্চিত পথ না পাবার সম্ভাবনায় লেখাপড়া করতে করতেই নকশালপন্থী বিপ্লবের পথে সমাধান খুঁজতে বেরিয়েছিল। আর কফিনের শেষ পেরেকগুলো ঠুকে দিচ্ছিল শ্রমিক বিক্ষোভ, ঘেরাও  আর লক আউট। ১৯৬৯-৭১ সালে কলকাতার উত্তরে সিথি বরানগর থেকে দক্ষিণে বৌবাজার, পশ্চিমে গঙ্গা থেকে পূর্বে দমদম শেয়ালদা লাইন আর সংলগ্ন কিছু অঞ্চলে (যথা এঁড়েদা, দমদম, পাতিপুকুর,বেলেঘাটা, হাওড়া, শিবপুর, যাদবপুরে) বাঙালী ভদ্রলোক (মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, তবে মূলত বুদ্ধিজীবী) পরিবারের সন্তানরা। কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু এই‘ বালখিল্য বিপ্লব বিপ্লব খেলা’ আর খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না।‘বালখিল্য বিপ্লব’বলছি কারণ আমাদের যেসব ক্লাসফ্রেন্ড বা এক বা দু বছরের সিনিয়ার ঐ সব ‘এ্যাকশন’-এ যোগ দিয়েছিল—তাদের সকলেরই ভেতরে  কৌতুহল ছিল প্রচুর; বিপুল আন্তরিকতা থাকলেও, লক্ষ্য সম্পর্কে ছিল ধারণা শুধু অস্পষ্টই ছিল না নয়, কোনই ধারণা ছিলনা; আর অধিকাংশই গিয়েছিল উত্তেজনার আগুন পোয়াতে।; কিন্তু পথটা পরীক্ষিত ছিল না, আর পরিনতি সম্পর্কে ছিল না কোনোই আন্দাজ।আইনগত বৈধতার পৃষ্ঠবল নিয়ে অর্থবলে বলীয়ান, অত্যাধুনিক যোগাযোগের যন্ত্র আর আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সুশৃঙখল পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পাইপ গান আর স্কুলের ল্যাবোরেটারী থেকে চোরাই ক্যেমিকাল দিয়ে কি বিপ্লব হয় ? তবে  প্রাণের উৎসাহ তো মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে শেখায়। তাই সর্বশক্তি মৃত্যুর সম্মুখে দাড়িয়ে সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা ‘মৃত্যু তুমি নাই’ বলে অকাতরে প্রাণটা ছুড়ে দিতে দ্বিধা করেনি। ইস্কুলে বিপ্লব সাধনের ঘণ্টা খানেকর মধ্যে ‘প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের অত্যাচারী পুলিসবাহিনী’ এসে সেই মুক্তাঞ্চল পুনর্দখল করে নিত। ইস্কুলে একদিন দেখলাম এমন অনেকেই নকশালবাড়ির সমর্থন বলে আত্নপ্রকাশ করতে, যাদের কোনো দিনই দেশ বা বিদেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি।আমাদের ক্লাস নাইন-এ সেকসনের যে দু-জন পোস্টার লিখেছিল তাদের লক্ষ্য ছিল স্কুল পালিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখতে যাবার ঢালাও সুযোগ পাওয়া। অথচ মোটামুটি ভাবে ১৯৬৭ সাল থেকেই আমরা রাজ্যের রাজনীতি সম্পর্কে খুব কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম।  প্রকৃত পক্ষে এই সব দেখেই আমার কেমন যেন একটা অনীহা এসে গিয়েছিল। হতেই পারে সেটা এক ধরনের আত্মস্বাতন্ত্রবোধ সঞ্জাত সুক্ষ্ম অহমিকা। মনে হয়েছিল যে আমি,  ক্ষদ্র স্ফুলিঙ্গের আকারে নকশালবাড়ির যাত্রা শুরু হতে থেকে তার বিভিন্ন পথ পরিক্রমা দেখেছি, (চারু মজুমদারের হাড়ির খবর থেকে, বাড়িতে থেকে থেকে এম-এ উত্তীর্ণ দাদা দিদিদের সুত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতবিদ্য ছাত্র নেতাদের উড়ে আসা বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত), সেই আমি কি করে এদের মধ্যে মিশে যাব ?  মহৎ কোনো  কাজের এই কি সুত্রপাত ? সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা প্রগলভতা দেখতে পেয়েছিলাম।

    প্রতিষ্ঠিত আধিকারিক (যথা শিক্ষক বা অভিভাবক) ও প্রচলিত বিধি বিধানগুলোকে ডোন্ট কেয়ার করে কোন কাজ করতে আমার খুব সঙ্কোচ লাগত। ও সবের মধ্যে উদগ্র আত্মপ্রদর্শনের ছায়া দেখেছিলাম। তাছাড়া সেই সময়ে কখনোই মনে হয়নি যে রাষ্ট্র  (সোজা কথায় পুলিশি) ব্যবস্থা এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে ঐ রকম ভাঙচুর করে পার পেয়ে যাবার মতো অবস্থা এসে গেছে। সেটা যে দুর্বল হয়ে পড়েনি খুব শীঘ্রই তার প্রমান মিলতে লাগল। তাছাড়া শুধু আমি নই অনেকেই দেখেছে—যেসব সহপাঠী বিপ্লবের আগুনে হাত সেঁকেছিল তাদের অনেককেই পরে বলতে শুনেছি যে “সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, তার থেকে আর বেরোতে পারিনি। তাছাড়া পুলিশের থার্ড ডিগ্রি ট্রিটমেন্টের প্রত্যাশাই কারোর ছিল না। কারণ হিন্দু স্কুলের ছাত্ররা (কদাচিৎ এক দুজন বাদে) কেউই পরিবারের অনাদৃত সন্তান ছিল না।

     সে দিন নিজেদের যৌবন আর প্রাণের বিনিময়ে আগুন নিয়ে যে খেলা করতে নেমেছিল–তা এখনও ইতিহাসের লাশকাটা ঠান্ডা ঘরে এসে হাজির হয়নি। কুশীলবদের অনেকেই এখনও জীবিত,অনেকের অনেক ক্ষতই এখনও উন্মুক্ত, নাড়াচাড়া করলেই রক্ত ঝরে—মূল্যয়নও তাই বিপুল পার্থক্য যুক্ত।স্কুল কলেজে পড়া সেই প্রজন্মকে নিয়ে আজও সার্থক গল্প, মর্মস্পর্শী উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে চলেছে। আমাদের বর্তমান যাত্রাপথে প্রতিনিয়ত সেই দিনগুলোর প্রলম্বিত প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছি, চলেছি মোকাবিলা করতে করতে। ঐ যুগের প্রভাব আমাদের যাত্রাপথের স্থায়ী লেগেসি।  জাতির ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশের সেই মহাযজ্ঞে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল, যার কিছু উত্তর মিলেছে, কিছু এখনও বিবেচনাধীন। এর একটি দিক ছিল জগৎ ও জীবনের কিছু বৌদ্ধিক মূল্যায়ন—যা পশ্চিমবাংলার চিন্তা জগতকে জড়িয়ে দিয়ে ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বেড়া আগুন। বিপ্লবপূর্ব পিছনে-টানা পুরোনো সমস্ত ধ্যান ধারণা যাতে বিপ্লবোত্তর জগতে বাহিত হয়ে না যায়, তাই সর্ব স্তরে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে (ঘানিতে পিষে যেমন তিল থেকে তেল বার করা হয় তেমনি সমাজের পরশ্রমজীবিদের মধ্যে থেকে) সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া সমাজের কু-ব্যবস্থা, প্রথা ও চিন্তা তাড়িয়ে সর্বহারা শ্রেণীর মূল্যবোধে দীক্ষিত হবার ডাক দেওয়া হয়েছিল। স্লোগান ছিল ‘সদর দপ্তরে কামান দাগো’, ‘বস্তাপচা প্রতিক্রিয়াশীল জ্ঞানের আস্তাকুড় স্কুল কলেজের লাইব্রেরী, গান্ধী সাহিত্য পোড়ানো, বুঁর্জোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (সে সরস্বতী পূজো বা রবীন্দ্রজয়ন্তী যাই হোক না কেন) বন্ধ করে দেওয়া, সিনেমা হলে হামলা চালানো বলা হয়েছিল যে সর্বহারা শ্রমিকরাই প্রকৃত প্রগতিশীল; ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া শিক্ষায় দীক্ষিত জাতীয় নেতারা কেউ প্রগতিশীল হতেই পারেন না। কারণ তাঁরা আপোষকামী, সংগ্রাম বিমুখ, দোলাচল মনোভাবাপন্ন। প্রগতিশীলতার এই সংজ্ঞা এই গোষ্ঠীর নেতা, মুখপাত্র, সদস্য ও অনুসরণকারীদের আজও অর্থাৎ এই ২০১৬ সালেও পর্যন্ত প্রভাবিত করে রেখেছে। অনেক দিন পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে রেখে, দেখেও না দেখার একটা ভাব করে থাকা গিয়েছিল। কিন্তু (ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে মদত করার জন্যে) বিদ্যাসাগরের মুন্ডু ভাঙ্গা, বিবেকানন্দর মুখে কালি মাখানো ( সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ খেতরি আলোয়ারের রাজার টাকায় আমেরিকা ভ্রমন করার অপরাধে), আর ভবানী সেনের নেতৃত্বে প্রগতিশীল সাহিত্য নির্ণয় ও সমালোচনার পর্যায় থেকে সর্ব প্রকার রিগ্রেসিভ সাহিত্যের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ (যিনি দু বিঘা জমি’র মতো কবিতায় জমিটির প্রকৃত ব্যাবহারকারী, উপেনকে জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে উৎসাহ দিয়েছেন ) -এর সমস্ত রচনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হয়।  ‘নবযুগের উদ্গাতা বলে পরিচিত রাজা রামমোহন রায়ের জন্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করা, এদেশে শেতাঙ্গদের বসবাস সমর্থন, ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি বিনিয়োগ চাওয়া, ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে মদত দেওয়ার জন্যে ইংরেজী শিক্ষাপ্রচারও প্রসার করতে চাওয়ার অপরাধে হাঁকা হয় নরকের আগুনে দগ্ধ করার নিদান । শুরু হয়ে যায় এক প্রানবন্ত বিতর্ক। এতে আমরা যে যার সাধ্য মতো যোগদান করতাম। আর তার জন্যে সুযোগ সুবিধা মতো পড়াশুনো করে, বড় বা তথ্যভিজ্ঞদের মতামত পাওয়ার চেষ্টা করতাম।  ও দিকে ১৯৬৯-৭০ সালে কলেজ স্ট্রীট প্রতিদিন একটু একটু করে স্থায়ী রণক্ষেত্রের চেহারা নিতে থাকল। আর তার সঙ্গে যুক্ত হলো ‘খতমের রাজনীতি। শ্রেণীশত্রু বিবেচনায় পুলিশের ‘খোঁচড়’ অর্থাৎ খবর সরবরাহকারী, সাধারণ পুলিশ কনস্টেবল, সহপাঠীবন্ধু, পাড়ার ছেলে—কে যে কাকে খুন করতে লাগল অথবা খুন হতে লাগল পুলিশ অথবা নিজের বা অন্য দলের সদস্যদের হাতে—বোঝার পথ রইল না। গোপন সংগঠনের এইটাই নিয়তি; কে, কাকে, কখন, কি ভাবে নির্দেশ পাঠাচ্ছে ? কে, কি ভাবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ? সে নির্দেশ ঠিক কি ভুল–কিছুই বোঝার উপায় নেই, ঊপায় নেই প্রশ্ন করার। প্রশ্ন করলেই মহা বিপদ। দলের লোকে মারে নয় মারে পুলিশে, মারে প্রাণভয়ে। বন্ধু বান্ধব, স্কুলের সিনিয়ার দাদা কি পাড়ার ছেলে কেউ না কেউ ধরা পড়ছে মারধোর খাচ্ছে—ছাড়া পাচ্ছে—আবার ধরা পড়ছে–পাড়াছাড়া, শহরছাড়া, রাজ্যছাড়া হচ্ছে—তারপর কোন একদিন তার দেহ মিলছে বেপাড়ায়—রেললাইনের পাশে, নির্জনমাঠের মধ্যে, গঙ্গার ধারে—কিন্তু যা শোনা যাচ্ছে সবটাই তার অস্পষ্ট, আধিকারিকদের পক্ষে বিশেষ কিছু বলা হচ্ছে না; আর যা বলা হচ্ছে তা অধিকাংশক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

     এই রকম অস্হির পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৬৯ সালের ২রা অক্টোবর পার হয়ে গেল গান্ধী শত বার্ষিকী। মিত্র ঘোষ প্রকাশ করেছিল ছয় খন্ডে গান্ধীর নির্বাচিত রচনার  একটা সেট। মাঝে মাঝেই বঙ্কিম চ্যাটার্জ্জী স্ট্রীটের দিকে স্কুলের জানলা থেকে দেখতে পেতাম দোকানের শোকেস থেকে নিয়ে রাস্তায় ফেলে গান্ধী সাহিত্যের বহ্ন্যুসৎব করা হচ্ছে। স্লোগান শুনেছিলাম, “গান্ধীজি নয় মহাত্মা মীর জাফরের প্রেতাত্মা। পড়া, জানা আর শোনা ইতিহাসের সুত্রে মন আন্দোলিত হতো হিংসা বনাম অহিংসা, অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার, বিভিন্ন সশস্ত্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মতামত, সুভাষ বোসের প্রতি তাঁর নীতি ইত্যাদি নানা প্রশ্নে।

     থেকে থেকে সপ্তাহে এক দু দিন করে করে ছুটি হয়ে স্কুল বন্ধ থাকতে থাকতে অবশেষে ১৯৭০ সালের গরমের ছুটির পরেই স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এর আগে অবশ্য এপ্রিল মাসে লেনিনের শত বার্ষিকী উদযাপন করা হলো। যত দূর মনে হচ্ছে গান্ধীবাদী হেডস্যার সত্যানন্দ প্রমানিক মশাই পদাধিকার বলে অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করতে উপস্থিত ছিলেন না। ১৯৬৮ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির শতবার্ষিকীর সময় থেকেই রাশিয়ার বিপ্লবের ওপরে কিছু কিছু খবর কানে এসেছিল খবরের কাগজ আর পত্র পত্রিকা মারফৎ। গোর্কির ‘মা’ পড়েছিলাম, খারাপ লাগেনি। তবে আরোও ভালো লেগেছিল ইন্দিরাদেবীর অনুবাদ করা ‘চাষ করি আনন্দে’ বইটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে স্টেজহরকা বলে ছোট্ট একটা নদীর তীরে স্টেজহরি গ্রামের একটা সাধারণ ছেলের গল্প—যে খেলাধুলো আনন্দ ফুর্তি করে বেড়ে উঠছিল। যুদ্ধ শুরু হলে তার খাটিয়ে চাষি হিসেবে সুপরিচিত বাবা সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়ে সীমান্তে যাত্রা করলে ছেলেটা ভেতরে ভেতরে পালটে যেতে শুরু করল। যে টেলিগ্রাম যুদ্ধে তার বাবার মৃত্যু সংবাদ বয়ে এনেছিল,সে সেটা নিজের মায়ের কাছে গোপন করে পরিবারের কর্তার মতো হয়ে উঠল। আরোও ছোট বেলায় পড়া রাশিয়া থেকে প্রকাশিত ছবি দেওয়া গল্পের বইগুলো বালক কিশোরদের সুস্থ্ জীবনবোধ তৈরির জন্যে আদর্শ পাঠ্য বলে মানতে হয়।ও গুলোতে মারামারি,খুনোখুনি,ষড়যন্ত্র পাকানো, গোলাগুলি চালানোর ব্যাপার থাকতো না; বরং থাকতো পারষ্পরিক সাহায্য সহযোগিতার বার্তা।

     ইস্কুল বন্ধ হয়ে আমাদের ভালোই  হলো। প্রচুর পাড়া বেড়ানো, গল্পের বই পড়া, পাড়াতে বাড়িতে নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা,তর্ক বিতর্ক করে সময় কাটতে লাগল। অবশ্য তার আগে সকাল সন্ধ্যে  দশটা অব্দি বই, পাঠ্য বই নিয়ে রোজকার ঘণ্টা পেটানোর কাজ সারতেই হতো। এই সময় বাড়িতে ইংরেজী আর সংস্কৃত পড়াতেন অমূল্যধন ভট্টাচার্য। বয়স্ক মানুষ, শিক্ষক হিসেবে উচ্চ মানের। আর ঐ সময় নাগাদ আমাদের মধ্যে  নিজেদের দায়িত্ব নিজেদের বহন করতে চাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়ে যাওয়ায় আমরাও পড়তে শুরু করেছিলাম সঠিক ভাবেই। টালা পার্কের চৌহদ্দিতে নকশাল আন্দোলন আঁচ তখনো এসে পৌছয় নি। এমনি এক দিন সকালের কাগজে বরানগরে কিছু যুবকের লাশ পাওয়া যাওয়ার খবর পড়লাম। এরও কিছু দিন আগে বারাসাতে যশোর রোডের ওপরেও এমনি কিছু যুবকের লাশ মেলার খবর পড়েছিলাম। খবরগুলো রহস্যময়, অস্বস্তিকর; কিন্তু শুনে বা পড়ে বেশ কিছুটা অস্বস্তি লেগেছিল। কারণ চারপাশের পরিবেশ পরিস্তিতির মধ্যে থেকে  নানা ধরনের খবর ভেসে আসছিল। রাজনৈতিক ত্রাস চুড়ান্ত একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছিল। এ পাড়ার অল্প বয়েসি ছেলেপিলেরা অন্য পাড়ায় ঢুকলে অনেক সময় প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা নিয়ে সংশয় ছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে দমদম ষ্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে চেহারার মিল পেয়ে কাকে নাকি একদল ছেলে প্রায় খুন করতে বসে ছিল। নেহাৎ ভাগ্যক্রমে ট্রেনের মান্থলী দেখিয়ে তিনি ঐ যাত্রা ছাড়া  পেয়ে যান। রেশনের দোকান থেকে গম্‌ নিয়ে বড়ি ফেরার পথে একজন বয়স্ক ব্যক্তি নাকি সি-আর-পি’র সামনে পড়ে যায়। সেই থেকে কি নিয়ে যাচ্ছে জানতে চাইলে লোকটি জানায় যে সে গম নিয়ে যাচ্ছে; আর গমকে বম্ব শুনে সি-আর-পি তাকে এই মারে কি সেই মারে। অনুরূপ ভাবে সি-আর-পি’র লোকজন বাড়িতে কে আছে জানতে চাইলে বৃদ্ধশ্বশুর ‘বৌমা’ বললে—তারও অনুরূপ দশা হয়।এ কথা গুলোর কতটা সত্যি কতটা মিথ্যা যাচাই করার উপায় তখন ছিল না। নিজেদের ক্যাডারদের বাঁচাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের রক্ষী বাহিনী বানিয়েছিল। তাদের একটি শাখা থেকে থেকে আমাদের বাড়ির সামনে বাঁ দিকে লাইট পোস্টের তলায় সন্ধ্যের ঝোঁকে কখনো বা ধোঁয়াশার আলো আঁধারিতে পার্টির লালা ঝান্ডা লাগানো লাঠিকে হাতিয়ার করে লেফট রাইট লেফট রাইট করে কুচকাওয়াজ করতে শুরু করল। ক্রমে ক্রমে আশপাশের প্রচুর গাছপালা রাজনৈতিক অস্হিরতার সুবাদে অন্তর্হিত হতে চলেছিল। কখনো বা রথ সাজাবার কখনো বা ভোলে বোম এর বাঁক সাজাতে আশ পাশের বস্তি থেকে ডাল কেটে পাতা ছিঁড়ে গাছগুলোকে মুড়িয়ে দিয়ে যেতে লাগল। সামনের লেডিস পার্ক ছেড়ে ক্ষেত্র মালীর দলবল গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ঝিল পার্কে; কর্পোরেশনের গার্ডেনিং ডির্পাট্‌মেন্টের অপেক্ষাকৃত বড় আর নিরাপদ আশ্রয়ে। দেখতে দেখতে লেডিস পার্কটা দৈত্য তাড়িত তপোবন হয়ে গেল। শীতকালে মরশুমি ফুলে জায়গাটা ঝলমল করতো—সেসবই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সামনের মাঠ,বাগান আর পার্কগুলোতে নতুন পাড়ার খাটাল থেকে দলে দলে মোষ এনে চরানো হতে লাগল। সামনের পুকুরটায় শুরু হয়েছিল মোষ চান করানো; শীঘ্রই জল ঘুলিয়ে থকথকে হয়ে দুঃর্গন্ধ ভরে গেল, তবু মোষ নামানো বন্ধ হলো না। করপোরেশনকে বলে কয়ে পুকুরের ধারে বাঁশের বেড়া বাঁধা হলো। এক সন্ধ্যে বেলায় ঐ গোয়ালা আর নেপালিপাড়ার মাস্তানরা গালি গালাজ করতে করতে, বোম ফাটাতে ফাটাতে মশাল জ্বালিয়ে এসে সেই বেড়া ভেঙে পুড়িয়ে দিয়ে গেল। কোনো পুলিশই আসেনি ডাকা সত্ত্বেও। সে দিন দাদুর লজ্জা অপমানে বিবর্ণ মুখটা বেশ মনে করতে পারি। শুধু আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাওয়ার অপরাধে এই শাস্তি। সত্যিই তো—সংখ্যা গরিষ্ঠ ‘গরিবগুর্বোদের’ দেশে ‘ভদ্দরনোক’ হয়ে কোঠা বাড়িতে বাস করেও বায়নার শেষ হয় না, তার ওপর আবার বাগান পুকুর ফুলের গাছের জন্যে আবদার করলে ‘কুঁজো হয়ে যারা ফুলের মুর্ছা দ্যাখে, পৌছয় নাকি হাতুড়ি পিঠে ? ’ঝিলপার্কের লতাপাতা ছাওয়া কুঞ্জবনগুলো একটু একটু করে টেনে ছিড়ে কেটে হাওয়া হয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভালো যে বড় বড় গাছগুলোকে মুড়িয়ে কেটে দেওয়া সম্ভব হয়নি। মণিমালার দিন তখন দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল। কিছুটা উপযুক্ত কর্মকর্তার অভাব আর বাকিটা পরিবেশ পরিস্থিতিগত, যা তখন এমন ভাবেই পালটে যাচ্ছিল যেখানে ঐ জাতীয় সংস্থাগুলোর প্রয়োজনই ফুরিয়ে গিয়েছিল।

ফলে আগে বাড়ির সামনে কেউ উঁচু গলায় কথা বললে বা কাউকে সামনে মারামারি করতে দেখলে বড়রা দেখতাম এগিয়ে গিয়ে বাঁধা দিত—মানে সত্যি করেই সেন্সার অফ্‌ পাবলিক মরালস্‌ হয়ে বারন করতো। তাতেও না থামলে কড়া ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে যেত বিনা দ্বিধায়। থানাতে খবর দিলে সেখান থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হতো। বোমের আওয়াজ তখন জলভাত হয়ে গেছে। কেন জানিনা এই সময় সুযোগ পেলেই লোহার কোনো কিছু অরক্ষিত থাকলেই সেগুলো হাওয়া হয়ে যেত। বিপ্লবের অস্ত্র বানানোর জন্যে নয়, নেশার খরচ তোলার তাগিদে হাইড্রেনের কভার, রাস্তার ধারের সোক্‌ পিটের ঢাকনা, পার্কের রেলিং, বাড়ীর লোহার কল, গেট, জানলার রড—যেখানে যা পাওয়া যায় সব কিছু মুড়িয়ে ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া চলছিল। নেপালি পাড়া থেকে এক দল ছেলে এসে বাড়ীর কর্পোরেশনের ঘেরা গোডাউনে রাখা লোহার পাইপগুলো প্রথমে পাথর দিয়ে হাতে হাতে, তারপর বড় বড় হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে ছোট ছোট ম্যাটাডোরে চাপিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। সত্যিই তো দেশের সরকার যদি সাধারণ মানুষের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা করে উঠতে না পারে তবে তাদের নিজেদের বাঁচার চেষ্টাতে বাধাও দিতে পারে না। রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে ভেসে আসতে লাগল ক্রমাগত বোমের আওয়াজ। ‘দুর্বৃত্তায়ন’ শব্দটা তখনো পরিচিতি লাভ করেনি। কিন্তু পরিস্থিতি যে পাল্টে যাছিল বোঝা যাচ্ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর কাজকর্মে।  ১৯৬৭ সালে বয়স্ক কামরাজ, নিজ্‌লিঙ্গাপ্পা, মোরারজি দেশাইরা  জহরলালের ‘গুঙ্গিগুড়িয়া’ কন্যা, ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করলেন, যাঁর  উপস্থিতি আকর্ষণীয় কিন্তু ব্যক্তিত্ব নেই বলেই ভাবা গিয়েছিল। প্রায় প্রথম থেকেই ওল্ড গার্ডদের কাছ থাকে বাধার পর বাধা এসেই চলল। শ্রীমতি গান্ধী জাতীয়করণ করার চেষ্টা দিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল। আমরা ভাবলাম বুঝি বা জাতীয়করনের স্বার্থে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে নব কংগ্রেস গঠন করলেন। রক্ষণশীল বয়স্কদের আদি কংগ্রেস ইন্দিরার জাতীয়করণের বিভিন্ন  কর্মকান্ডে আপত্তি জানিয়ে চিহ্নিত হয়ে গেল উন্নয়ন ও প্রগতি বিরোধী, ধনীদের ধামা ধরা ষড়যন্ত্রকারীদের দল হিসেবে। ‘প্রগতিশীল কর্মকান্ডের’ স্বার্থে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ভি-ভি-গিরিকে মনোনয়ন করলেন। ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণয়ন’এর এই বন্দোবস্তটা আমাদের সহ আরো অনেকের কাছেই বেশ গ্রহযোগ্য বলে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল। নেত্রী অর্জন করছিলেন একটা বামপন্থী মোড়ক। সত্যিই সে দিন যেন দেশের মানুষের মুক্তি আনতে ‘এশিয়ার মুক্তি সূর্য’ শ্রীমতি গান্ধী উদিত হচ্ছিলেন। তৈরি হচ্ছিল ব্যক্তি পূজার অনুকূল পরিবেশ। পরিষদীয় রাজনীতি থেকে পুরোনো সৌজন্য, সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, শালীনতা বোধ বিদায় নিচ্ছিল। রাজনীতি অজ্ঞাত কূলশীল, আগন্তুক, সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাবলম্বীদের শয্যা সঙ্গী বানাতে দ্বিধা করেনা—কথাটার যাথার্থ প্রমান করে দিলেন ইন্দিরাগান্ধী। প্রয়োজন মতো ডান বাঁ যে কোন দিকে রাজনৈতিক বোঝাপড়া করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছিলেন। দলটার নাম হয়ে গেল নব কংগ্রেস। তারপর কংগ্রেস (আই) অর্থাৎ ইন্দিরা কংগ্রেস। সমস্ত ব্যাপারটার অন্তর্নিহিত গভীর তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতা সে দিন হয় নি। ক্যারিস্‌মাটিক একজন নেতা দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে চলেছে—সেদিন এটাই বড় হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়লেন আরেক প্রগতিশীল কর্মোদ্যোমে—পূর্ব পাকিস্থানের বাংলা ভাষাভাষীদের সমর্থন করার কাজে।

      ও দিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্থানে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তীব্র  দ্বন্দ্ব সঞ্চিত হতে শুরু করেছিল। নিজেরা বাঙাল না হওয়ায় জীবনের এই পর্যায় পর্যন্ত রিফিউজি সমস্যাকে দূর থেকে দেখতে পাওয়ার দরুণ, ঐ দেশটার সম্বন্ধে যা কিছু জানা হয়েছিল তা সবই বই এর মধ্যে দিয়ে। আমাদেরই দেশটা আগে কত বড় ছিল এই জাতীয় অস্পষ্ট ধারণা ছাড়া ও নিয়ে মাথা ব্যাথা বিশেষ ছিল না। মায়ের মুখে নাম শুনেছিলাম সারা ব্রীজ, শান্তাহার, পার্বতীপুর ইত্যাদির নাম—যেগুলো তিনি নিজের কৈশোর যৌবনকালে কলকাতা থেকে বাপের বাড়ি যাবার পথে আধো অন্ধকারের মধ্যে ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে পার হয়ে যেতেন। সে দেশে নাকি বন্যার  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাট গাছ জলের ওপরে মাথা তোলে; আর পাট চাষিরা কুড়ি ফুট জলে ডুব দিয়ে সেই পাট কাটে। সেখানে নাকি নদীর এক কূলে দাঁডিয়ে অন্য কূল চোখে পড়ে না। সেই আকুল দরিয়ার মাঝিদের গানে বাতাসে উড়ে যাওয়া আবার হাওয়ায় ফিরে আসা সুরের নাম ভাটিয়ালি। সে দেশে মানুষের সমান রুই-কাতলা পাওয়া যায় আকছাড়—এমনই কত গল্প শোনাছিল। শোনা ছিল কচিৎ কাদাচিৎ কোনো বাস্তুচ্যুত মানুষের মুখে অভিমান ক্ষোভ আর হতাশা আর প্রায় কান্না মেশা প্রায় দুর্বোধ্য ভাষায় অবিশ্বাস্য সব বিষয় সম্পত্তির বিবরণ, যার কিছু কিছু যে মিথ্যা ছিল না–তা পরবর্তী কালের পড়াশুনো আর অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি। মতিছন্ন ভ্রাতৃবিরোধের জেরে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও মনুষত্ব যে ধর্মের ওপরে তা দু পাশের কিছু কিছু মানুষ তখন একটু একটু করে টের পেতে শুরু হয়েছে। গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে পূর্বেকার গুরুত্ব বিরহীত পোকায় খাওয়া পশ্চিমবঙ্গ, আর নিজ ভূমে কন্ঠরুদ্ধ মাতৃভাষা নিয়ে পূর্ব পাকিস্থানের তখন নিজেদের দুর্দশার জন্যে অন্যদের দায়ী করে লজ্জা ঢাকারও পথ খোলা নেই। প্রায় সর্ববিধ দিক থেকে ভিন্ন পশ্চিম পাকিস্থানের সঙ্গে পূর্ব দিকের বিরোধ ছিল অবধারিত; আর সেই বিরোধে প্রতিনিয়ত ঘৃতাহুতি দিতে নামলেন ইন্দিরা গান্ধী। সাধারণ যোগসুত্র ছিড়ে যাবার বেশ কিছুকাল পর ভারত সরকারের যেন হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠে কলকাতাকে সামনে রেখে ঢাকার সঙ্গে পুরোনো আত্নীয়তা ঝালিয়ে দিতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠলেন। সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের বন্যা বইতে লাগল। আকাশবাণী হয়ে উঠল এর অন্যতম বাহন। এ পাড়ের সাধারণ মানূষ কিন্তু ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকত অবিশ্বাস আর ঘৃণা নিয়ে, ওদিকের মানুষ এ পারকে দেখত দ্বিধা আর অপছন্দের দৃষ্টিতে।

      ১৯৬৯ সাল শেষ হল বড়মার মৃত্যু দিয়ে। তিথির দিক দিয়ে পূর্ণ নব্বই বছর বয়সে দীর্ঘ অসুস্থ্তার পর আমাদের উর্দ্ধতর চতুর্থ প্রজন্মের অবসান ঘটল। পরিণত বয়সে মৃত্য যেন গাছ থেকে জীর্ণ পাতা খসে পড়ার মত। পরিবারের এক চরম দুর্যোগের পর্যায়ে দোর্দন্ড প্রতাপ ননদের পরামর্শ সাহচর্যে তিনটি নাবালক সন্তান নিয়ে যৎসামান্য বিষয় সম্পত্তি রক্ষা করে সংসার তরণীকে বায়, মান রাখার কৃতিত্ব তাঁকেই বর্তায়। কিন্তু তার থেকেও বড় কৃতিত্ব ছিল লাভপুরের গ্রাম্য পরিমণ্ডলে পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতির বাতাবরণে সন্তানদের সমনে নৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ধরে দেওয়া। রক্তের স্রোতে সামন্ত যুগের প্রায় অনপনেয় যে পরম্পরা প্রবাহিত তা এই সংযোজনের মধ্যে দিয়ে বিপুল পরিমাণে পরিশোধিত হয়ে গিয়েছে। অসুস্থ্তার খবর পেয়ে দাদু দিদির সঙ্গে আমি লাভপুরে গিয়ে ক’টাদিন কাটানোর মধ্যে   প্রাসঙ্গি্কতা কমে আসে। নিয়ম ভঙ্গের দিন বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞাতির অনুমোদন নিয়ে অগ্রসর হবার সময় দেখা গেল যে আশেপাশে দাদুর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ্য কেউ নেই। আর দ্বিতীয়টি হাল ‘ঘটিবামুন’দের কথা। তখনই দাদুর মুখেই শুনেছিলাম যে আগেকার কালে শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে এই ‘ঘটিবামুন’দের আগমন হত। এঁরা ঘটি বাজিয়ে কথকথার ভঙ্গিতে মৃতব্যক্তির নশ্বর দেহত্যাগ করে বৈতরণী নদী অতিক্রম করে নতুন রূপে বিভিন্ন অতিলৌকিক স্তর পার হতে হতে স্বর্গারোহনের চিত্র বিবৃত করে অন্তে যজমান বা শ্রাদ্ধাধিকারীর কাছে অর্থদানের আহ্বান করতেন। মনোমত দাবি পূরণ না হলে সভাস্থলেই আত্মাহুতি দিয়ে গৃহকর্তাকে ব্রহ্ম হত্যার পাপ লাগার হুমকি দিতেন। প্রয়োজন পড়লে বাড়ীর ছাদে অথবা তাল গাছেও চড়তেন। অগ্রদানী, ঘটক কি দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আরেকটি উপগোষ্ঠীর কথা তখনই শুনলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *