রৌদ্রকরোজ্জ্বল পথের যাত্রা

       প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পরেও ইস্কুল আবার আজ খুলবে,কাল খুলবে এই রকম শোনা যেতে লাগল। বিজ্ঞান শাখার সহপাঠী বন্ধুদের মুখে পরে শুনেছি যে এই সময়টা তারা নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম করে লেখাপড়ার অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছিল। ওদের সামনে ছিল সুস্পষ্ট লক্ষ্য, যাকে এক,দুই,তিন করে ধরে দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্য অনুসরণ করে তারা অনেক যত্নে নিজেদের তৈরি করে চলে ছিল।। আর আমি? আমার সামনে লক্ষ্য একটা ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু সে লক্ষ্য দিগন্তলীল রামধনুর প্রায়।মায়ের মুখে শোনা একটা কবিতার লাইনের মত, ‘আই স্লেপ্ট এ্যান্ড ড্রেমট্‌ দ্যাট লাইফ ইস্‌ বিউটি। ’লাইফ সত্যিই যেন বিউটি ছিল সে দিন। আমি ছিলাম দিবা স্বপ্নে বিভোর। দিন কাটাচ্ছিলাম কিছুটা পড়াশুনো,কিছুটা তর্ক বিতর্ক আলাপ আলোচনা করে,  কবিতা পড়ে–লিখে, গল্পের বই পড়ে, স্বকপোল পরিকল্পিত খেয়াল মেটাতে, পড়া পড়া খেলায়। এই সময় নিজেদের লেখাপড়াটা নিজের হয়ে গিয়েছিল। ফলে পড়তে বসতে বলাবলির ব্যাপারটা আর ছিল না। পাঠ্য বিষয়টা তখন আগ্রহ সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। ফলে তরুণ গরুড়ের ক্ষুধা নিয়ে তখন তথ্য সগ্রহ করে ফিরছিলাম। সত্যিই প্রায় প্রতিটি লোকের মুখের দিকে নজর রাখতাম, আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বিষয় নজরে এলেই সাগ্রহে তা তুলে নিতাম ‘ডুম্‌সডে-বুক’এ। তিল তিল কুড়িয়ে তাল করতে করতে—কিছুটা তথ্যগুলোর নিজস্বধারায়, কিছুটা বা পারিবারিক প্রবণতা অনুসারে আর কিছুটা তর্কবিদ্যার বইতে সদ্য শেখা সামান্যীকরণের ঝোঁকে সেগুলোকে নিয়ে প্রকল্প ফাঁদার অভ্যেস গড়ে উঠছিল। ঐ সময়ে পড়া বইগুলোর মধ্যে ছিল বেশ কয়েক জন মহাজনের পদাবলী। ভানুসিংহ ঠাকুরের অনুকরণে আমি সৃষ্টি করেছিলাম ‘রাধাকান্তদাস’কে, যাঁর ভণিতায় খান কুড়ি পদাবলী প্রণয়ন করানো সম্ভব হয়েছিল। ইস্কুলের পত্রিকাতেও একটা লেখা বেড়িয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে যে পরিকল্পনাটা ফাঁদা হয়ে ছিল বেশ বড় মাপে। এরজন্যে ভাগ্যক্রমে চড় থাপ্পড় (যে সম্ভাবনাও তখন অপ্রত্যাশিত ছিলনা) এর বদলে অবিভাবকদের উদাসীন মুখ বা নিরুৎসাহ ব্যাঞ্জক দু চারটে মন্তব্য ছাড়া বিশেষ কিছু শুনতে জোটেনি। পড়াশুনোর সময়ে এই সবের পিছনে সময় নষ্ট করার জন্যে সতর্ক বাণীর ওপর দিয়ে সে যাত্রাটা পার হয়ে ছিল। উষর এই প্রেক্ষাপটে কি ফসলই বা আর ফলতে পারে ? তবে হ্যা, আজ বুঝতে পেরেছি যে ফাঁকটা ছিল নিজের অন্তরে। কাজটাকে যদি ঠিক বলে মনে হয়েই থাকে তবে হাজার বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও সেটাতেই লেগে থাকা উচিত ছিল। সহজে হাল ছাড়া উচিত হয়নি। এই ছিল সেই জীবনের ট্রাজিডি।

     পিছন ফিরে বিলীয়মান কৈশোর ও প্রথম যৌবনের  দিনগুলোতে আমাদের এই পাড়াটাকে মনে করতে গিয়ে দেখছি যে এ অঞ্চলটা তখন আজকের মতো সাজানো-গোছানো ছিল না। এতো গাছপালাও ছিলনা। এখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের দৌলতে চারপাশে পাখপাখালি যতোটা দেখা যাছে, যতটুকু শোনা যাচ্ছে তাদের শিষ বা ডাক—সেদিন তা ছিলনা। নকশাল আমলের অস্থিরতার দরুন পৌর প্রশাসন প্রায় অবলুপ্ত হতে বসেছিল। রাস্তাঘাট দীর্ঘ কাল মেরামত হয়নি, ফুটপাথ ভাঙ্গাচোরা, নিয়ামিত জঞ্জাল সাফ হয়না,রাস্তায় জল জমা স্বতঃসিদ্ধ। আগে কেবল শীতকালেই আমাদের মশারী টাঙাতে হত, এই সময় থেকেই সারা বছর মশারী টাঙানো প্রয়োজন হয়ে পড়তে থাকল। মশার ওষুধ স্প্রে করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পৌর সুযোগ সুবিধা লক্ষ্যনীয় ভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এমন কি ‘ময়লা ছুঁইলে শাস্তি পাইবে’ লেখা ডাস্টিপিন (ডাস্টনিন) গুলোও উধাও হয়ে গিয়েছিল। সে দিন কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হত না। নিজের চার পাশে একটা জগত বানিয়ে নিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল দিনগুলো।

     ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে দাদু নৃপেন্দ্রচন্দ্র স্মৃতি বক্তৃতা উপলক্ষ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী’ শীর্ষক ভাষণ দিতে গেলে দিন সাতেকের জন্যে শান্তিনিকেতন বেড়ানো হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সন্মান সমাদরের কমতি ছিলনা। রতনকুঠিতে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। তখন সম্ভবত ওটাই ছিল বিশ্বভারতীর ভি-আই-পি গেস্ট হাউস। বিশাল এলাকা নিয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির একতলা বাগান ঘেরা বাড়ি, ছটি মাত্র ডবল বেডের ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজান ঘর। রতনকুঠীর খাবার ঘরের টেবিলটার ডিসাইন ছিল অবনীন্দ্রনাথের মস্তিক উদ্ভূত। পিঁড়ির চেয়ে উঁচু আবার চেয়ারের চেয়ে নিচু (ড্রেসিং টেবিলের প্রসাধন করার জন্যে যে জাতীয় টুল থাকে সেই রকম) পা তুলে আরাম করে বসার মত কাষ্ঠাসন—যার চারটে সরু সরু পায়ার জায়গায় দু দিকে আনুপাতিক দৈর্ঘ প্রস্থের কাঠের তক্তা ছিল; আর টেবিলটাও সেই অনুপাতে নিচু। লক্ষ্য করে দেখলাম কবির আবাস গৃহ উত্তরায়ণের স্থাপত্যও বেশ অদ্ভুত, অনেকটা্ ওঁদের জোড়াসাঁকো বাড়ীর অনুসঙ্গবহ। কোন একটি ছাদ বা বারান্দা পাশেরটির সমতলে নেই। ওখানকার আসবাব পত্রগুলিও রতনকুঠির অনুরূপ, নাতিউচ্চ কাঠের আসনগুলিতে  পা মুড়ে বা তুলে আরাম করে বসার জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে বানানো হয়েছ। উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত মশাই স্বয়ং বার বার এসে খোঁজ খবর নিতেন। একটা গাড়ি দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে সকালের দিকে দাদূ ওখানকার অনেক পুর্ব পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করছিল, আমি আর  বাবা তার সঙ্গী  হতাম। এই ভাবেই গিয়েছিলাম শান্তিদেব ঘোষ, অশোকবিজয় রাহা, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, সুধীর কর, সুদীন বসু, ইত্যাদি অনেকের বাড়িতে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিনয়েন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং ঐ বক্তৃতামালার প্রবর্তক। উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি অতি মার্জিত। কলকাতা বিশ্বদ্যালয়ের অর্থনীতি ও লোক-প্রশাসনের কৃতি ছাত্র। এক সময় অধ্যাপনা করতেন বিদ্যাসাগর কলেজে; স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব হিসেবে কাজ করা পর ইউনেস্কোর অনুন্নত দেশ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে অফ্রিকার কয়েকটি দেশে নিযুক্ত ছিলেন। খানিকটা সাহেবি কেতার  পরিবার, ছেলেমেয়দের শিক্ষাদীক্ষা বিয়ে-সাদি বিদেশে। ওনার স্ত্রী  খুবই সমাদর করে নিজের সঙ্কলিত আফ্রিকার উপকথা উপহার দিয়েছিলেন। বাড়িতে গিয়ে কিন্তু কেন জানিনা একটু আড়ষ্ট আড়ষ্ট লেগেছিল। ফিরে এসে দাদু আর বাবার কথপোকথন থেকে বুঝেছিলাম যে বড় পিস্‌তুতো দিদির বিয়ের সম্বন্ধ করতে গিয়ে ওঁরা পিছিয়ে আসেন। পরবর্তী কালে অদৃষ্টের বিচিত্র যোগাযোগে ওনাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়। এক বিকেলে উপাচার্যের আবাসে চায়ের আমন্ত্রণ ছিল। সেখানে নীলিমা সেন ও ওঁর স্বামী রেজিস্ট্রার অমিয় সেন উপস্থিত ছিলেন। উপাচার্যের অনুরোধে নীলিমা সেন গেয়েছিলেন, “ওগো আমার চির অচেনা পরদেশী।”

      লাভপুর যাবার পথে বোলপুরের ওপর দিয়েই গিয়েছি। শান্তিনিকেতনের সম্বন্ধে অনেক গালগল্প শোনা ছিল। মহাকবির সাধনপীঠের সঙ্গে পরিচয় হল সেবার। সিংহ সদনের সামনের চত্তরে বক্তৃতার আয়োজন হয়েছিল। আশ্রমিকদের বক্তব্য অনুযায়ী চার দিনই শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রত্যাশার অনেক বেশি। ছাত্র ছাত্রীদের অনুরোধে ওখানে আমাদের থাকা একদিন বাড়ে। শেষ দিন বিকেলে তারা দাদূর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করে—প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে জমজমাট আদানপ্রদান চলে প্রায় তিনঘন্টা ধরে। একদিন সকালে রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নোব্‌ল প্রাইজটা দেখতে পাইনি। অশান্ত বাতাবরণে ক্ষতিগ্রস্ত হবার ভয়ে অগেই ওটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অদৃষ্টের কি বিচিত্র পরিহাস যে শান্তির বাতাবরণেই ওটি চুরি হয়ে গেল। অতসী সহ আরোও অনেক ধরনের ফুল চিনেছিলাম সে বার। মনে পড়ছে রতন কুঠির সামনের বাগনে ভোরের আলো আঁধারের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নাকে এসে লাগছিল সুইট পি, গোবর মাটি আর আমের মুকুলের মিশ্র গন্ধ। খর্বাকৃতির আম গাছের কাছে গিয়ে চোখ সার্থক হল সবুজ আর নানা শেডের লাল লাল গুটিতে মোড়া সুপুষ্ট আমের বোলের রসে চটচটে পাতাগুলোতে মৌমাছির আনাগোনা দেখে। বিশ্বভারতী কর্ম পরিষদের এক সদস্য তখন নিজের ঘরে স্নান করতে করতে ভরাট উদাত্ত কণ্ঠে গাইছিলেন, “এখনো গেল না আঁধার এখনো রহিল বাধা। এখনো মরণ ব্রত জীবনে হল না সাধা”

      কলকাতাতে ইতিমধ্যে আমরা নিকটে দূরে বোমের অওয়াজ আর হল্লা, মারামারি, একশো চুয়াল্লিশ ধারা, কারফিউ, মৃত্যু আর মৃতদেহের খবরে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শান্তিনিকেতন কিন্তু তখনও পর্যন্ত সত্যিই শান্তিনিকেতন হয়েই রয়ে গিয়েছিল। রতনকুঠীর তত্ত্বাবধায়ক ছিল বাবুলাল বলে এক ব্যক্তি। সে নাকি অবনীন্দ্রনাথের কাছে ফাই ফরমাস খাটার কাজ করত। প্রথম যে দিন শান্তিনিকেতনে বোমটি ফাটল, সে দিন সিংহ সদনের ঘন্টা ঘর থেকে বিপদ সঙ্কেত সূচক পাঁচ পাঁচটি করে ঘন্টা বাজানো হতে থাকল—আর বেচারা বাবুলালের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এরপরে বোলপুর শান্তিনিকেতন নকশাল আন্দোলনের বেশ বড় একটা কেন্দ্র হয়ে পড়েছিল। ওদিকে সকালে ট্রেন ধরে হাওড়ায় নেমে বড়ি ফেরার পথে বেশ বিপত্তি হল। হেমন্ত বসু খুন হয়েছেন টাউন স্কুলের পাশের রাস্তায়—জানজট—গাড়ি ঘুরয়ে দিচ্ছিল পুলিশ।

    শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পরেই লালাবাজার থেকে জানান হয় যে নকশালরা দাদু সহ পাড়ার আরও কয়েক জনকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে মারার পরিকল্পনা করেছে। দাদুর নিরাপত্তার জন্যে আই বি’র তরফে সূর্য মুর্মু বলে একজনকে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করল। আমাদের শিখিয় দেওয়া হল যে যদি কেউ সুর্য’র পরিচয় জানতে চায় তবে বলতে হবে যে ও লাভপুর থেকে এসেছে—কাজের খোঁজে। সূর্যকে দোতলার সিঁড়ির পাশে তখন ‘পড়ার ঘর’ বলে পরিচিত ঘরটায় থাকতে দেওয়া হল। সে  বাড়ীর লোকের মতোই চান খাওয়া ঘুম সারতে। মাসে মাসে আধ বেলার জন্যে যেত মাইনে আনতে। দাদু সকালে যখন শৈলদাদুর বাড়ি যেত তখন পেছনে পেছনে যেত। রাত্রে সে ঘুমত তার জায়গায়, দাদু দাদুর ঘরে, যেখানে রাস্তার দিকের জনলাগুলো খোলা থাকত হাট  করে। অতর্কিত আক্রমন ও হত্যা লীলা চালাবার কোন সমস্যাই ছিল না।  অল্প বয়সে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কিছু আশ্চর্য জনক নয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ক্লেঁমেশ্‌’র ছেলে কম্যুনিস্ট হয়েছে শুনে পিতা মন্তব্য করেন যে, “ছেলে যদি এখনও কম্যুনিস্ট নাহয়ে থাকে তবে তিনি নিজেই তাকে উৎসাহিত করতেন কমুনিস্ট হতে। তবে হ্যাঁ; সে যদি চল্লিশ বছর বয়সেও কম্যুনিস্ট থেকে থাকে, তবে তাকে উত্তরাধিকার চ্যুত করার কথা ভাবতে হবে। বাড়িতে বড়দের বলতে শুনতাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন, তারা প্রচুর পড়াশুনো করে থাকে, তাদের কোন চারিত্রিক দোষ নেই, নিজেদের ভুল স্বীকার করে প্রতিপ্রক্ষের যুক্তিযুক্ত বক্তব্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহন করতে প্রস্তুত থাকে। এদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করার নানান গল্প শোনা ছিল। তখনকার বাতাবরণে একটা ব্যাপার খুব ঘটত; কোনও উতপ্ত আলোচানয় প্রতিপক্ষের মুখে তুরুপের তাসের মত একটা কথা থেকে থেকেই শুনতে হত তুমি কি ওমুক বইটা পড়েছ’, বা‘তুমি কি ওমুক তথ্যটা জান’ ?  বলাইবাহুল্য পৃথিবীর বহু অপঠিত গ্রন্থের মত সেই বইটি অবশ্যই পড়া বা সেই বিশেষ তথ্যটি জানা আমার থাকত না।ফলে প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই চুপ করে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। শুধু কি তাই,নকশালদের মধ্যে অনেক ভাল ছাত্র আছে জানা ছিল। মানুষের ভাল করা জন্যে তাদের যাত্রা—চোখের ওপর তাদের আত্ম্যত্যাগের অনেক দৃষ্টান্ত চোখে পড়ছিল। কিন্তু সংক্রামক রোগের মত যাকে তাকে শ্রেণী শত্রু বানিয়ে নিয়ে তার নিদান হাঁকার ব্যাপার মোটেই সুবিধা জনক মনে হয়নি।  আর শ্রেণীশত্রু হিসেবে দাদুকে ভাবতে মন সায় দিত না।       

      ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। কলকাতা জমে উঠল এ-পার ওপারের মধ্যে আদান প্রদানের বিস্তৃত মঞ্চ হয়ে। ইতিমধ্যে অওয়ামী লীগের প্রধান মুজিবর রহমনের সুপরিচিত বজ্রকন্ঠের ভাষণ ‘—–আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার মানুষকে হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, যার যা আছে তাই দিয়ে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব। তোমরা আমার ভাই, কেউ তোমাদের দাবায়ে রাখতে পরবা না। ইনসাল্লা”—প্রদান করা হয়ে গেছে। কিছু দিন পরেই এই ভাষণের সঙ্গে একটি গান (“শোন একটি মুজিবরে থেকে লক্ষ মুজিবরে কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ”—এর রেকর্ড চারিদিকে শোনা ঘুরে ফিরে শোনা যেতে থাকে। আরেকটা গান, “বিশ্বকবির সোনারবাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনান্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নাইকো শেষ।”—বহুলপ্রচার পেয়েছিল তখন। যতদূর মনে পড়ছে ২৫ শে ফেব্রুয়ারী ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন কুষ্ঠিয়া জেলার কোন আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত হয়। সেখানে কিন্তু মুজিবর উপস্থিত ছিলেন না। কারণ ইতিমধ্যেই তিনি পাক সেনার হাতে বন্দি হয়ে পশ্চিমাংশে পাচার হয়ে যান। পাকিস্থানী সেনাদের হাতে নিগৃহীত ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ হাজারে হাজারে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পূণর্বাসনের ব্যাপারে ভারত সরকার দক্ষতাপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়েছিল–তাতে অবশ্য দুর্দশা, নিরাশ্বাস ও মৃত্যু আটকানো যায়নি। তবে প্রাত্যহিক জীবনের আশেপাশে প্রায় এক কোটি মানুষের আকস্মিক উপস্থিতি কিন্তু স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেনি। উদ্বাস্তু ত্রাণে বেশ কিছু অস্থায়ী ট্যাক্স বসেছিল। আকাশবাণী হয়ে উঠেছিল রেডিয়ো বাংলাদেশের আরেক নাম, আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলে এক ঘোষক হন এর মুখ্য প্রচারক। এ পার বাংলায় বুদ্ধিজীবীদের বাম ও অ-বাম গোষ্ঠী তৈরি করেছিল নিজের নিজের আলাদা আলাদা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি। এর দুটিরই সভাপতি করা হয়েছিল দাদুকে। এঁরা বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের এ পার বাংলায় আশ্রয় দান ও বৈষয়িক ভাবে সাহায্য সহায়তা করতেন। এই উপলক্ষ্য করে বাড়িতেও আসতেন কেউ কেউ। একবার এলেন এক ব্যাঙ্ক অফিসার, যার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ ভর্তি পাকিস্থানের করেন্সি নোট। এর মধ্যে এক দিন বাড়ীর সামনের বগেনভেলিয়া লতায় ঢাকা বসার জায়গাটায় দেখলাম নাতিদীর্ঘ কিন্তু শক্ত কাঠামোর শ্যামলা রঙের বছর পঞ্চন্ন-ষাটের এক ব্যক্তিকে। দাদুই পরিচয় করিয়ে বলেছিল, “এই দেখ ভাই, আমার গণদেবতার যতীন।” ওনার আসল নাম অতীন রায়, কুমিল্লা জেলার মানুষ। অগ্নিযুগের বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরে লাভপুরে অন্তরীন হন; বৃহত্তর জগতের বার্তা বয়ে আসে গন্ডিবদ্ধ গ্রাম জীবনের মধ্যে।  তখনই কেন জানিনা মনে হয়েছিল ওঁর শান্ত মুখশ্রীর অন্তরালে বয়ে যাচ্ছে ইস্পাত কঠিন মানসিক বল। অনেক পরে নিজের বিবাহোত্তর জীবনে বাংলাদেশ ভ্রমনে গিয়ে এঁর পরিবারটিকে শ্বশুর বাড়ির প্রতিবেশী হিসেবে আবিস্কার করলাম।  বরাবরই বিকেলের দিকে দাদুর ডাক পড়তো বিভিন্ন সভা সমিতির সভাপতিত্ব করতে বা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্হিত থাকতে। জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাবার পর থেকে এই ব্যাপারটা খুব বেড়ে গিয়েছিল। আর আনেক ক্ষেত্রেই দাদুর (আপ্ত)সহায়ক জাতীয় কিছু হিসেবে বাড়ীর কাউকে কাউকে সঙ্গে  যাবার একটা প্রথা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সভা সমিতির মিটিংএ সাধারণত বাবা বা বড় দাদারা কেউ সঙ্গী হত, অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন জায়গায় আমাদের ডাক পড়ত। এর জন্যে আমাদের ছোড়দার ওপর কিছুটা বীতরাগ ছিল, কারণ এগুলো সে’ই নিয়ন্ত্রণ করতো। ইতিমধ্যে আমরা (পরীক্ষা না দিয়েই) ইলেভেন ক্লাসে উঠে গেছি। তাই আমাদের ও দাদুর সহযাত্রী হতে হত। এখন ভাবি সে দিন দাদুর শরীরের দিকে নজর রাখার জন্যে আমাদের পাঠানো কত অর্থহীন ছিল। কারণ দাদু কোন কারণে অসুস্থ্ হয়ে পড়লে উদ্যোগ নিয়ে কোন পদক্ষেপ নেবার মত দক্ষতা আমাদের ছোটদের মধ্যে কারুরই গড়ে ওঠেনি। আর বক্তৃতা দিতে দিতে আত্মবিস্মৃত দাদুকে মাঝপথে নিরস্ত করার মত যোগ্যতাই  বা ব্যক্তিত্ব আমাদের কারুরই ছিলনা। সৌভাগ্যের বিষয় যে সেই জাতীয় কোনও সমস্যা কখন দেখা দেয়নি। তবে কৌতুক (না কি অপদস্থকর—জানিনা কি বলব ?) ঘটনা কিছু ঘটতে কসুর করেনি। ঐ রকম একটা মিটিংএ যেতে হয়েছিল মধ্য কলকাতার সুপরিচিত গার্লস্‌ স্কুল সাখাওয়াত মেমেরিয়ালে। পাজামা-পাঞ্জাবী আর একটি মাত্র ফ্যাসানেবল পোষাক জহর কোটে সজ্জিত হয়ে সহযাত্রী হয়েছি। সভার কাজ তো সম্মান জনক ভাবে সম্পন্ন হলেও—বেইজ্জত হয়ে গেলাম খাবার যায়গায় পৌছে। দাদুর খাদ্য বড়জোড় এককাপ চা—আমি কিছু খাবার উদ্যোগ করতেই সমবয়সী সব ছাত্রীদের সামনেই দাদু উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘‘ও ভাই, তুমি বিশেষ কিছু খেয়ো না, তোমার আবার ডিস্‌পেপশিয়া আছে।” সেদিন এর পরেও ধরণী আমার ওপর করুণা করে দ্বিধা হয়নি বলেই আজও বেঁচে থেকে এই বিবরণ লিখতে হচ্ছে।

      যাই হোক কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে। আমরা পুর্ববঙ্গীয় না হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি হিসেবে একটা অদ্ভুত আবেগ তখন আমাদের সকলকে ছেয়ে দিয়েছিল। আর পূর্বতন ওপার বাংলার বর্তমান পশ্চিম বঙ্গে্র অধিবাসীদের মধ্যে দেখেছিলাম বেশ চাঞ্চল্য—যেন নিজেদের পূর্বতন বাসস্থানগুলিকে আবার ছুঁতে পারার আশা। ফিরে গিয়ে নতুন করে আবার জাঁকিয়ে বসার বাসনা কারো কারো যে ছিল না এমন নয়। কিন্তু অধিকাংশেরই ওই জাতীয় দুর্মতি হয়নি। এত দিন যা দূরাধিগম্য বলে মনে হচ্ছিল—এখন যেন তা নিকট সম্ভাবনার পর্যায়ে এসে লাগছিল বলে মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। আট দশটা মাস বেশ আশা-আকাঙ্খার দোলায় দুলেছিল আমাদের মত অনেকে। ভারত সরকারের কাছে থেকে থেকেই দাবী উঠছিল বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে। প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যিনি উদ্যোগ নিয়ে এত বড় কর্মকান্ডটির সূত্রপাত ঘটালেন তিনি কিন্তু নির্বিকার। পরে বুঝেছিলাম যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি তো দেওয়া হয়েই গিয়েছিল ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে। আর তার ভেতর দিয়ে পরোক্ষ ভাবে সরকারের স্বীকৃতিও দেওয়া হলেও আর্ন্তজাতিক আইন অনুসারে তখনি প্রকাশ্য ভাবে কিছু করা ঠিক হত না।

       ১৯৭১ সালে গরমের ছুটিতে শেষ বারের জন্যে স্টিমারে গঙ্গা পার হয়ে শিলিগুড়ি যাওয়া ঘটেছিল। আমরা ছোট তিন ভাই যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি সেই ভরসায় মাকে নিয়ে আমাদের প্রথম যাত্রা। সে বার উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু ঘটেনি। কেবল দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে মেশোমশাই দুপুরে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন সাংগ্রিলা বলে একটা হোটেলে। খাবার মেন্যু ছিল চাইনিজ, সম্ভবত নুডুল্‌স আর চিলি চিকেন। তখনও পর্যন্ত ওই জাতীয় খাদ্যের সঙ্গে আমাদের কোন পরিচয়ই ছিল না। তার ওপর আনাড়ির মত এক গাদা চিলি সস্‌ ঢেলে সবটাই অখাদ্যে পরিণত করে ফেলেছিলাম। তার ওপর খাবার সময় ওখানে তারস্বরে ঝাঁই ঝপ্পর আর উচ্চস্বরে গান শুরু হলে আমাদের খাওয়াটাই মাটি হয়ে গেল। কার পেটে যেন কি সহ্য হয় না ? আর মেশোমশাই বাড়িতে এক দিন বানিয়েছিলেন—মির্চি গোস্ত—এক কিলো মাংস (অবশ্যই পাঁঠার)-তে পাঁচশ লঙ্কা—সে আমলে হাইব্রিড লঙ্কা ছিল না। ফলটা সহজেই অনুমেয়। যাবার পথে রাত্রে গঙ্গা পেরিয়েছিলাম তাই যা দেখতে পাইনি ফেরার পথে দেখলাম নির্মিয়মান ফারাক্কা ব্যারাজের কাজকর্ম। বিশাল এলাকা জুড়ে অসংখ্য রেল লাইন আর লোহা লক্কড়ের স্তূপ। আর চোখে পড়েছিল রেল লাইনের ধারেই চার পাশ উন্মুক্ত বড় বড় সেডের মধ্যে রোয়িং বোটের মত থাকবন্দি অসংখ্য রবারের নৌকা। অনেকেরই জানা ছিল যে ডিসেম্বর নাগাদ যুদ্ধ হবে।

      শিলিগুড়িতে থাকতেই খবর পেলাম যে আমাদের টালাপার্ক রাজনৈতিক অস্থিরতায় টলমলে। আমাদের সঙ্গিসাথী বন্ধুদের কেউ কেউ নকশাল হয়ে হিমানী বাড়ীর বাগানে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে গেরিলা সংগ্রামের মহড়া সুরু করেছিল। এই অঞ্চলেরই পরিচিত অর্ধ-পরিচিত দশ-পনেরো জন তরুণ ওখানে থানা গেড়েছিল। ওরা পারতপক্ষে বাড়ীর লোকদের সংশ্রব এড়িয়ে চলত। এমন কি ওদের দ্বারা চিহ্নিত অন্যতম শ্রেণীশত্রু হিমানী বাড়ীর শিশিররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অহরাত্র হাতের নাগলে পেয়েও কিছুই করেনি। এছাড়া ইলোরা বাড়ি বলে পরিচিত ‘রত্নমালা’ নামাঙ্কিত বাড়ির পাশের ফাঁকা জমিটিতে ওরা পড়াশুনা করত।মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের এই সব সন্তানরা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যের পড়াশুনো আর তা নিয়ে আলোচনা করা ছাড়া  বিপ্লবের আর কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এরা তখন ছিল পনেরো কুড়ি বছরের ছেলেপিলে—নিজেদের কাজের গুরুত্ব আর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনাই ছিল না। গরম কাল হওয়ায় বাগানে, গাছের ছায়ায় কি পুকুর পাড়ে কাটিয়ে দেওয়া চলত। কিন্তু খাবার দাবার যোগাড় করা তত সহজ ছিল না। ওরা কিন্তু খাবর সরবরাহ করা নিয়ে হিমানী বাড়ীর লোকদের বিব্রত করত না। কেবল মাঝে মাঝে একটু আধটু নুন চাইতো আবার কখন কখন আশেপাশের বাড়ীর থেকে গুড় আর রুটি চেয়েচিন্তে খেত। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে প্রশাসন নিজের পলিসি প্যারালিসিস কাটিয়ে উঠে পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসে। শুরু হয়ে যায় ব্যাপক হারে ধরপাকড়, মারধোর; অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনকদের  জেল-বন্দি করা আর বেশী বিপজ্জনকদের মিসায় পাচার করা বা একেবারেই উধাও করে দেওয়া। আমাদের অঞ্চলে এর জের পড়ে গরমের ছুটির মধ্যে, আমারা তখন শিলিগুড়িতে ছিলাম। পরের ভাইটিকে কবিতায় লেখা দাদুর একটা চিঠি থেকে জানলাম,—-পাড়ায় পুলিস হানা দিয়ে ধরলে ছেলে গোটা কতক। পুলিসি এ্যাকশনে হিমানী বাড়ীর মুক্তাঞ্চল থেকে সব বিপ্লবীরাই বন্দি হয়। আর এদের স্থানীয় নেতা ও তত্ত্বিক, মেজদা (হিমানী বাড়ীর পাঁচিল ঘেঁষা প্রাক্তন এক অধ্যক্ষ্ কানাইলাল মুখুজ্জের সন্তান) পরবর্তী কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পান।

     গরমের ছুটির পর স্কুল খুলল। কিছু দিন ক্লাস চলতে চলতে সকলের কাছেই টনক নড়ল যে তিন তিনটে পরীক্ষা (ক্লাস টেনের হাফ ইয়ার্লি, এ্যানুয়াল আর ইলেভেনের হাফ ইয়ার্লি) না দেবার জন্যে যে খামতি ঘটে গেছে তার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে। সরকার চাইছিল পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে দেখাতে, আমরাও চাইছিলাম পরীক্ষা দিতে। ফলে তখনও পর্যন্ত অবশিষ্ট নকশালদের অপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রি-টেস্টের ব্যবস্থা হল। একেবারে শেষ দিন পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখে চলে আসতে হল বাড়ি থেকে পাঠান দাদুর দ্বিতীয় বারের অসুস্থ্তার খবর পেয়ে। সে তথ্য অধ্যায়ে দিয়েছি। পুনরুক্তির ভয়ে সে কথা আর উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। কেবল জানাই যে ১৪ই সেপ্টেম্বর আমাদের জগতের ইন্দ্র পতন ঘটে গেল।

      সে দিন সকাল থেকে মানুষ জনের পদপাতে এক বেলাতেই বর্ষার জলে বেড়ে থাকা বাড়ীর সামনের ঘাস দলে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন বাড়ি ঝাঁট দিয়ে সরাতে হয়েছিল বিপুলধুলোর আস্তরণ। মরদেহ নিয়ে স্বতস্ফূর্ত শোক মিছিল বেরিয়ে ছিল। আকাশবাণী বাড়ি আর শ্মশান থেকে দু দফায় বীরেন ভদ্রের কণ্ঠে ধারা ভাষ্য প্রচার করেছিল। ভাদ্র মাসের রোদের মধ্যে সারাটা দিন নাওয়া-খাওয়া ছাড়া লরিতে করে ঘুরতে ঘুরতে শ্মশানে পৌঁছে যেন কড়াই থেকে উনুনে গিয়ে পড়া গেল। আমার সেই প্রথম শ্মশান দর্শন। কাঠের চিতায় শবদাহ হচ্ছে চারিদিকে, চিতার ওপরে আধপোড়া দেহ; আত্মীয় স্বজনের বিলাপ; বিজাতীয় গন্ধ, পাগল, কুকুর গেঁজেল, মাতাল—সবার ওপর বিপুল ধাক্কা ধাক্কি।  রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি সৌধের উল্টোদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের শবদাহের ঘেরা স্থানটির পাশে কলকাতার মেয়র চিতা প্রস্তুত করে অপেক্ষা করছিলেন। মুখাগ্নির অন্তে চিতা প্রজ্জলিত হবার পর  খুড়তুতো ভাই গোরা আর পারিবারিক ভাবে পরিচিত একটি বালককে দু হাতে ধরে কোনও মতে এসে বসলাম রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি সৌধের সামনে। চোখে পড়ল কেউ চিতার কাঠকয়লা দিয়ে লিখে রেখে গিয়েছে, “আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে।” খিদে তেষ্টার কথা ভুলেই ছিলাম একরকম। এই সময় ত্রানকর্তার মত আর্বিভূত হলেন পরিবারের তখন সদ্য কুটুম্ব, গৌতমকাকার শ্বশুর,ধানবাদের কাছে কাতরাসগড়ের সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার শিশির মুখোপাধ্যায় মশাই। প্রচুর পরিমানে মিষ্টি আর অফুরন্ত ডাবের জলে সেদিন যেন উনি প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন। খানিকটা যন্ত্র চালিতের মত রবীন্দ্র স্মৃতি সৌধের সামনে কখনো বসছিলাম কখনো হাঁটছিলাম, কখনো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম অন্ধকার গঙ্গার পানে । এমন সময় পাশ থেকে কে যেন আপন মনেই গুনগুনস্বরে গাইছিল, “যেদিন ভবের মেয়াদ ফুরবে ভাই আগল যাবে সরে, সেদিন হাতের দড়ি পায়ের বেড়ি দিবিরে ছাই করে। সে দিন আমার অঙ্গ তোমার অঙ্গে, ওই নাচনে নাচবে রঙ্গে, সকল দাহ মিটবে দাহে, ঘুচবে সব বলাই। চেয়ে দেখি কার্তিকদা বা শ্যামলকুমার রায়—মণিমালার এক কর্মকর্তা—বয়সে একটু বড় হলেও তখন মনের সঙ্গী—পরবর্তীকালে ভগ্নীপতি হন। স্বভাব সিদ্ধ টিউব-লাইট আমার কানে সে দিন শব্দটুকুই ভেসে এসেছিল—অর্থভেদ হয়েছিল আরও কিছুদি নবাদে। সেদিন এই সব কিছুর সঙ্গে আরও একটা গান প্রাণের সংলগ্ন হয়ে গিয়েছিল, যা কিন্তু আমার তখন কানে আসেনি। দাদুর মরদেহ বাহিত ট্রাকটায় আমরা ছিলাম না, ছিলাম পরের আরেকটা ট্রাকে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ঐ ট্রাকটাই গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মহর্ষি ভবনের প্রেক্ষিতে কবির আবক্ষ মূর্তির সামনে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকারা দাদুকে বিদায় জানিয়েছিল এই গানেঃ-

“যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে

তারে ডাক দিলে আজ কোন খেয়ালে

আবার তোমার ওপার হতে।।

শ্রাবণ-রাতে বাদল-ধারে উদাস ক’রে কাঁদাও যারে

আবার তারে ফিরিয়ে আনো ফুল-ফোটানো ফাগুন-রাতে।।

এ পার হতে ও পার ক’রে বাটেবাটে ঘোরাও মোরে।

কুড়িয়ে আনা, ছড়িয়ে ফেলা,   এই কি তোমার একই খেলা—

লাগাও ধাঁধা বারে বারে এই আঁধারে এই আলোতে।।

 রাত্রে রেডিয়োতে সারা দিনের সংগৃহীত সমচারের মধ্যে এইটি সম্প্রচারিত হয়েছিল।

      এরপরে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। দিন গড়িয়ে মাস পেরিয়ে বছর ছাড়িয়ে আজ প্রায় পয়তাল্লিশটা সূর্যাবর্তন সেরে এসে পিছন ফিরে ভাবছি যে দাদুর মৃত্যুতে আমাদের ঠিক কি হয়েছিল ? অত্যন্ত মামুলি যে কথাটা প্রথমেই মুখে আসে তা হল মাথার ওপর থেকে বটবৃক্ষের আশ্রয় সরে যাওয়ার ব্যাপারটা। পিতামহ কারোর চিরকাল বেঁচে থেকে নাতিপুতির মাথায় ছাতা ধরবে আশা করাটাই অন্যায়।।বক্তব্য তাই নিরর্থক। অর্থযুক্ত কথাটা হচ্ছে একে স্থান শূন্য (ভেকেন্সি) হওয়া না শূন্যতা(ভয়েড) সৃষ্টি হওয়া—কি বলব ? আজ ভেবে দেখছি যে ১৪ই সেপ্টেম্বর সকাল থেকে নিজেকে যেন একটা নদীর স্রোতে মধ্যে ভেসে যেতে দেখলাম। কোন কাজ নেই, কোথাও যাবার নেই, কেউ কিছু বলছে না, করতে হচ্ছে না। যুগান্তর আর আনন্দবজার পত্রিকা সহ অন্যান্য গণ মাধ্যমের কর্তাব্যর্ক্তি, পুলিশের লোকজন, নানা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা আসছেন বাড়ির ভেতরে বাবা কাকাদের সঙ্গে আসন্ন শেষ যাত্রা সহ নানা বিষয়ে কথা বলছেন আবার চলে যাচ্ছেন। থেকে থেকেই সাহিত্য সস্কৃতি জগতের গণ্যমান্য লোকের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসছেন—সেইভাবে কোনকিছুই আমাকে স্পর্শ করছিল না। আমি যে শোকে দুঃখে পাথর বনে গিয়েছিলাম এমনও নয়। কখন বাড়ীর ভেতরে কখন বাইরে উদ্দেশ্যহীনের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। মনে পড়ছে নিজেদের অবস্থার তুলনা খুঁজে পেলাম ক্লাস ইলেভেনের সংস্কৃতের পাঠ্য বইটিতে, ছান্দগ্য উপনিষদের থেকে ‘প্রাণানাম শ্রেষ্ঠত্বনী রূপনম্‌’ বলে একটা অংশের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গুলি এক এক করে শরীর ছেড়ে চলে যায়, যাতে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা ব্যাহত হয় বটে কিন্তু অচল হয়নি—ফলে তারা আবার ফিরে আসতে বাধ্য হয়। মূল প্রাণ যেই যাবার উদ্যোগ নিল অমনি ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। আপনিই হয়ে গেল শ্রেষ্টত্বের প্রমান। কথাটা পরের ভাই আর দাদাকে বললাম—ওরা সহমত হলো। জন্ম থেকে যে ব্যক্তিটির সর্বাত্মক পরিচালনে গোটা পরিবারটা এত দিন পর্যন্ত শহরে শিবির বাস করছিল—তার অনুপস্থিতি আমাদের পরিবারকে নতুন পথের দ্বারপ্রান্তে এনে ছেড়ে দিল। এর প্রভাব এক এক জনের ওপর পড়েছিল এক এক ভাবে। সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল বাবার, দিদি বা ঠাকুমার নয়। কারণ যৌবনকালে জীবন যুদ্ধে নিরত স্বামীর‌ পর্যাপ্ত মনযোগ না পাবার ফলে উপেক্ষিত পত্নী বহু আগেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল আধ্যাত্মিকতার মধ্যে। অন্যদিকে নিজের জন্যে কিছু না রেখে নিজের বাবাকে ধ্যানজ্ঞান গুরু ইষ্ট বানিয়ে তাতেই সর্বস্ব সমর্পন করে বাবা দাদুময় হয়ে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে বাবার নিজস্ব সাহিত্যচর্চা ছিল নিয়মিত। পরবর্তী কালের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আনন্দ বাজারের সন্তোষ কুমার ঘোষ ও নিজের ভগ্নীপতি ও আবাল্যের সঙ্গী শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবা সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিল। আমি জন্ম থেকেই বাবাকে দাদুর একটা পরিত্যক্ত ডেস্কের সামনে ঝুঁকে বসে পাতার পর পাতা লিখে যেতে দেখতাম। কিছু অধুনালুপ্ত পত্র পত্রিকাতেও নিয়মিত লেখা বের হত। বইও ছাপা হয়েছিল খান পনের-কুড়িটা। পরিচিতিও হয়েছিল কিছু। কিন্তু ১৯৫০ এর দশক থেকে শুধুমাত্র সাহিত্যের জগত ছেড়ে দাদু যতই বাইরের জগতে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকল ততোই একজন ব্যক্তিগত সচিবের প্রয়োজন বেশি থেকে বেশি করে বোধ হতে থাকে। গোবিন্দ বিশ্বাস এবং তারও আগে আরো দু-তিন জনকে বহাল করা হয়, একবার তো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে। কিন্তু দাদুর মেজাজ মর্জির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আর আমাদের সে কালের আধা-সহুরে পরিবারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার দরুন সে চেষ্টা সফল হয়নি। তারাশঙ্করের সর্ববিধ প্রকাশ্য যোগাযোগ রক্ষা সংক্রান্ত আপ্ত সহায়কের যাবতীয় কাজ বাবা মাথায় তুলে নিয়েছিল—সে দায়িত্ব পালন করত দেবসেবা জ্ঞানে। এর জন্যে বাবার সাহিত্য সাধনা একান্ত ক্ষীণ হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাবার ভাষায় এটা ছিল শালগ্রাম শিলার সেবা অর্থাৎ সর্ব জ্যেষ্ঠের সন্মান আর সর্ব কনিষ্ঠের সমাদর দেওয়া। বাবা যে নিজের বাবার ব্যাপারে কতটা তদ্‌ভাব ভাবিত ছিল সেটা বোঝা যায় দু জনের হাতের লেখা থেকে। দাদুর লেখা ছিল ঈষৎ কোনাচে, আর বাবার লেখা ছিল গোলালো; নইলে হুবহু এক। ওগুলো দেখে তফাৎটা ধরতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা আর পারি আমরা—অন্যদের পক্ষে হঠাৎ ধরে ফেলা অসম্ভব। দাদুর লেখার প্রথম পাঠক, প্রথম ও প্রধান মূল্যায়নকারী; সে মূল্যায়ন মনঃপুত না হলে ক্ষুব্ধ লেখকের বিরাগ হজম করার দায় ছিল বাবার।দাদুর মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে কোন কারণে রেগে গিয়ে দাদু বাবাকে এক চড় মেরে বসে। ব্যাথিত বিস্ময়ে বাবা জানতে চায়, “বাবা, আপনি আমাকে মারলেন !” দাদু অনুতাপহীন দৃপ্তকণ্ঠে বলে চলে, “হ্যাঁ মেরেছি, দরকার হলে আবার মারব। সন্তানের ওপর কি বিপুলদাবী, আর পুত্রের কি বিপুল আত্মসমর্পন ।দাদুর ছোটখাট লেখা আর্শীবাদ, শুভেচ্ছাবাণী, চিঠিপত্র দাদুর জবানীতে বাবাকেই লিখতে হত। দাদুর মৃত্যুর পর নিজের বাবার সেবা করতে করতে বাবা নিজের সন্তানদের দিকে নজর দেবার অবকাশ পায়নি। বাবার বক্তব্য ছিল যে নিজের বাবার জন্যে যে প্রাণ দিতে পারে তার ছেলেরাও নিজের বাবার জন্যে প্রাণ না দিতে পারলেও মন দিতে পাড়বে। প্রত্যাশাটা খুব অন্যায্য ছিল এমন নয়। কিন্তু পৃথিবীটা বড্ড দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। আমাদের ন জনের ক্লাস নাইন এ-সেকসনে সবাই ছিল বড় ছেলে; কেউ কেউ আবার এক মাত্র সন্তান—আমরা দু জন ব্যতিক্রম। দাদুর প্রয়ানে বাবা প্রথমে পড়ে ছিল একটা ভরশূণ্য অবস্থায়। তারপর প্রাকৃতিক নিয়মেই শূন্যতা ভরাট হয়ে নতুন সঙ্গ গড়ে ওঠে, শুরু হয় নতুন করে লেখার চেষ্টা। কিন্তু তত দিনে বাইরের জগতে অনেক অদল বদল ঘটে গেছে, দেরিও হয়ে গেছে প্রচুর।। বাবা আর কোন দিনই কাঙ্খিত জমিতে ফিরে আসতে পারেনি। ক্রমাগতই নতুন করে বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

          এছাড়া দূরত্ব রচিত হয়েছিল স্বজন অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে। আমাদের ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবার জন্যে ছিল মা। ছয়টি পুত্রের জননী একজন নন্‌ ম্যাট্রিকুলেট এবং সম্পূর্ণ ভাবে পরমুখাপেক্ষী গৃহবধূকে সন্তানদের ভবিষ্যতের স্বার্থে হাল ধরতে এগিয়ে আসতে হয়েছিল। এর জন্যে আমাদের কাছে মা’র ভূমিকা শাসনের–সোহাগের নয়, সুকঠিন কর্তব্যে নিয়োজিত করার—আলস্যে নিয়োজিত হতে না দেবার; সদা জাগ্রত সতর্কতায় আমাদের এগিয়ে দেবার। আমাদের মায়ের এই ভূমিকা বিস্তৃত হয়ে রয়েছিল আরও দু জনের ওপর—কাকুর বড়মেয়ে মঞ্জু (যাকে বলে থাকি দিদিভাই) আর বড়ছেলে রঞ্জনের ওপর। নকশাল আমলের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে কাকু চেষ্টা চরিত্র করে ডেপুটেশনে যায় দণ্ডকারণ্যে চাকরি নিয়ে। ওখানে যাওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যে দাদু অসুস্থ্ হয়ে পড়ে ও মারা যায়। ওদিকে  রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসে। ফলে কাকু কলকাতায় ফিরে আসার জন্যে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এই চাকরী ছিল চুক্তিবদ্ধ সময়ের জন্যে। তাই তখনই ফেরার সম্ভাবানা ছিল না। তাই কলকাতাতে রেখে যাওয়া বোনের দুই সন্তানকে আমাদের সঙ্গে এক পর্যায়ে ফেলে পালন করে। বহু বিষয়ে ঐ দু জ নআমাদের একই চেতনা বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত। ওদের ধ্যান ধরণা ভাবনা চিন্তার ধারাটা আমাদেরই মত। যেখান থেকে প্রাপ্য যা হয় সব টাকা এনে বাবা ধরিয়ে দিত মায়ের হাতে নিজের জন্যে কিছু না রেখেই। বেশ কষ্ট করেই মাকে সংসার চালাতে হত। সব মিলিয়ে আমাদের সমর্থনের ভারটা ছিল মায়ের দিকে। বাবা এটা জানত, আর নিজের স্বভাব সিদ্ধ মৃদু মধুরতা দিয়ে ব্যাপারটাকে সহজ করে নিয়েছিল। অনেক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও শেষ দিন পর্যন্ত বাবার কথা ছিল অলঙ্‌ঘ্য।

      আমাদের সেই পরিবারের অনেক কিছুই দাদুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল—জন্ম থেকেই সেটা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। আধা শহুরে পরিবারের সেই মানুষটা গ্রাম থেকে এসে শহরে বাড়ি বানিয়ে ছিল, ছিল নিজের গাড়ি। দেশের প্রথম শ্রেণীর মানুষজনদের সঙ্গে ওঠাবসা করা,বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে দেশ বিদেশ ঘোরা মানুষটি আপন পরিমণ্ডলে অভ্রভেদী এক মহিমায় আসীন ছিল। যদি১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে পশ্চিম বাংলার প্রধান ব্যক্তিত্ব বিধান রায় হয়ে থাকেন, মধ্যবর্তী সময়ে যদি অতুল্য ঘোষকে সেই স্থান দেওয়া যায়, আর ১৯৭৭ সাল উত্তর পর্যায়ে জ্যোতি বসু ও কিছু সত্যজিৎ রায়কে ধরা যায়, তবে ১৯৭০-৭১ সালে খুব স্বল্প কালের জন্যে দাদু সেই স্থানে পৌছে ছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে পরিবারের মধ্যে সমান্তরাল ব্যক্তিত্বের অভাব হেতু প্রায় সকলেরই তাৎক্ষনিক বাস্তব অনেক সমস্যা এবং কারো কারো দীর্ঘ মেয়াদি ভাবনা চিন্তাগত কিছু অসুবিধা হয়েছিল নিঃসন্দেহে। মোটামুটি একটা ভদ্রপরিবারে                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   গৃহকর্তার  মৃত্যু  কিছু  বাস্তব  সমস্যা  সৃষ্টি  করলেও সেটা কাটিয়ে ওঠাটা কঠিন হয়না। আমাদের পরিবারেও তাই হয়েছিল। আমাদের ছোটদের সামনে তখন সম্প্রসারণশীল জীবন; জীবনের পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হয়ে রয়ে গেল দাদুর স্মৃতি। কিন্তু দাদূর দিয়ে যাওয়া যে সংস্কার কখনও পিছন ছাড়েনি—সেগুলি বলার চেষ্টা করেছি ‘তারাশঙ্করের উত্তরাধীকার’ শীর্ষক অধ্যায়ে। দাদুর মৃত্যুতে কিন্তু আমাদের দিশেহারা অবস্থা হয়নি। কারণ বাবার মত কেউই দাদুকে ভিত্তি করে বাঁচেনি। অন্যান্য পরিবারে যেহেতু এই জাতীয় ব্যক্তিত্বের কমই দেখা মেলে তাই বয়স্ক মানুষের অপসরণ নিয়ে এত বক্তব্য ফাঁদার দরকার পড়েনা।  যে সম্প্রসারিত ব্যক্তিত্ব আমাদের শীতাতপ থেকে দূরে রেখেছিল চলে যাওয়ার পর সেটা সরে যাওয়াতে আমরা রৌদ্র করোজ্জল আকাশের মুখোমুখি হয়ে পড়লাম। তারাশঙ্করের জীবিত কালে তাঁর পাদপ্রদীপের অলোতে জ্যেষ্ঠ পুত্রটি যদি আলোকিত হয়ে থাকেন তবে অপর পুত্র সরিৎকুমার কিন্তু অন্তরালেই থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুটা তাঁর পেষার জগতের ভিন্নতা আর কিছুটা তাঁর চারিত্রিক প্রবণতার দরুন। এখন থেকে ঘটতে থাকল তাঁর অভ্যুদয়।  আমাদের অনেকই সাবালক হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *