হিন্দু বিবাহ ও নারী মুক্তি ! ভা স্ক র জ্যো তি  দা স

 

 

আন্তর্জাতিক নারীদিবস আসে আর যায়, কথা নেমে আসে রাশি রাশি, ক্রমশ সে কথা বাসি হয়, আমরা ভুলে যাই পরবর্তী নারীদিবস অব্দি… মেয়েদের পুজোর ফ্যাশন হয়তো বদল হয়, ভাগ্য নয়। বছরে একটা দিন আমাদের মনে হয় মেয়েরা ভালো নেই… দৈনন্দিন জীবনে আমার হাতে যেটুকু প্রতিকার আছে আমি করি না… মাদার টেরেজা নিয়ে রচনা লিখি কিন্তু নিজের মেয়েটার মধ্যে তার সিকিভাগ লক্ষন দেখলে অভিভাবক সুলভ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ি তাকে নিরস্ত্র করি, না পেরে উঠলে শেষমেশ ভালো(!) একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিই।। বিবাহ— আমাদের ব্রম্ভ্রাস্ত্র। এর কোনও জবাব হয় না… যুগ যুগ ধ’রে মায়েরা এই অস্ত্রেই মেয়েদের সভ্য সামজিক রেখেছে… ঠিক শুনলেন, আমি বললাম মায়েরা, কারণ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্তত বলছে, এ জগতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের হাতেই মেয়েরা শোষিত হয় বেশি… এটাই সম্পূর্ণ নারী স্বাধীনতার শেষ পরিণতি, মেয়েরাই মেয়েদের সবচে বড়ো শত্রু। আমি হিন্দু অব্রাম্ভন বিবাহ রীতি দিয়ে এটা বোঝাতে চেষ্টা করবো। সেই ব্রম্ভাস্ত্রের শক্তিগুলো আমাদের পরীক্ষা করে দেখার সময় এসেছে বইকি…

আমি অব্রাম্ভন বিবাহ রীতি নিয়ে বলবো তার কারণ পৃথিবী চিরকাল অর্থ আর ধর্মের দাস, বর্তমানে রাজনীতি তার দোসর। ব্রাম্ভন বা জমিদার গৃহিনীর চেয়ে দলিত মহিলাকে আরও এক স্তর বেশি শোষিত হ’তে হয়, তাকে ব্রাম্ভন বা জমিদার গৃহিনীর দ্বারাও শোষিত হ’তে হয়েছে। হিন্দু বিবাহের তিনটি রীতি (বর্তমানে মোটামুটি যেগুলি প্রচলিত)— সামবেদ, যজুর্বেদ আর অথর্ববেদ অনুগত রীতি। যার মধ্যে বাঙালী অব্রাম্ভণ হিন্দুদের বিবাহ হয় এই যজুর্বেদ মেনে যার পরস্পর আচার পদ্ধতি কারোর-ই অজানা নয়, বিশেষ ক’রে মেয়েদের তো নয়-ই, তারা পান থেকে চুন খসলে আঁতকে ওঠেন! অথচ সেই আচারের পরতে পরতে শুধু মেয়েদেরই অপমান রয়েছে, এবং এই অপমান তারা শুধু সহ্য করেনি, তারা একে উপভোগ ক’রে এসেছে, ছোট্টবেলা থেকে পিসি বা মাসির বিয়ে দেখে স্বপ্নে লালন ক’রে এসেছে…

ধরা যাক আমরা একটা বিয়ে বাড়িতে এসে গেছি  আমরা কী দেখবো? আমরা কিন্তু আইবুড়ো ভাত থেকে নিমন্ত্রিতঃ

এতোদিন যে মেয়েকে মধ্যবিত্ত পরিবারের মা ছেলে/বাবা-র চেয়ে কম মিষ্টি ছোটো মাছ দিয়েছেন আজ চোখের জল ফেলতে ফেলতে পাঁচরকম তরকারি পাঁচরকম মিষ্টি মাছের মাথা সাজিয়ে খেতে দেন, জ্বালিয়ে দেন মোমবাতি, শাঁখ বাজান, এগুলো মেয়েটি ভাই বা দাদার জন্মদিনে দেখেছে, তার তো হয়নি, তার ভালো লাগে তারপর হঠাৎ-ই অজানা কারণে চোখে জল আসে, মা ও মেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, মাকে প্রণাম করতে গিয়ে সেই যে তার মাথা নিচু হয় আর তুলতে পারে না… আজ এই বাড়িতে আইবুড়ো অবস্থায় মেয়ের পূর্ণ অধিকার নিয়ে তার শেষ দিন, কাল থেকে এটা তার বাড়িই নয়… স্বামীর গোত্র তার গোত্র, স্বামীর পদবী তার পদবী, নিজেকে ডাকলে সে যে চকিতে সাড়া দিতে পারবে তার বিশ্বাস হয় না… তবু তার ভালো লাগে আজ তার বিয়ে, এই দিনটা তার স্বপ্ন, সে দৌড়ে মেহেন্দি করতে চ’লে যায়, এটা এখন ফ্যাশন, এটা না পড়লে ঠিক ক’নে ব’লে মানায় না… পাশের বাড়ির অসুস্থ জ্যাঠা মারা গেলে তার ‘ওষুধ’ হবে না কাল থেকে, ঘাটে উঠতে হবে না, অর্থাৎ যতোই তার ওই জ্যাঠার জন্য কষ্ট হোক ধর্ম তার এই কষ্টকে স্বীকৃতি দেবেনা… সে জানে এটাই বিয়ে, বিয়ে ছেলে মেয়ে দু’জনেরই হয়, কিন্তু ছেলেদের ওসব দোষ হয় না, আসলে ছেলেরা বিয়ে করে, মেয়েদের হয়, বিয়ে যেন এক শ্লেট, যাতে ডাস্টার দিয়ে আসতে আসতে পুরো পুরোনো জীবনটা মুছে ফেলতে হয়… পুরোনো জীবনের কষ্ট ভুলে সে নতুন জীবনের রোমাঞ্চে লাফাতে লাফাতে শাঁখা পড়তে চ’লে যায়… সবাই পড়ে তাই! শাঁখা না পড়লে বিয়ে হয়? কী যে বলেন… শাঁখা আর পলা পড়াতে নিয়ে যায় সঙ্গে ক’রে যে সে কিন্তু পুরুষ নয় মেয়ে… নতুন জীবনের প্রথম হাতকড়া এবং তা এতোই নরম যে মেয়েটি সতর্ক থাকে যেন ভেঙ্গে না যায়… এটা এতোই অমঙ্গল যে সে বলে শাঁখা বেড়ে গেছে, ভেঙ্গে গেছে বললে স্বামীর অমঙ্গল হয়… আমি ভাবি পলা কেন লাল হয়? অন্য রঙ হয়না কেন? আর তার গায়েই কেন একটা শ্বেত শুভ্র শাঁখা? এর উত্তর আমি পরে দেবো, কিন্তু দুঃখের কথা মেয়েটা এতসব ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না, সে জানে ওগুলো পড়তে হয়; না হ’লে অমঙ্গল…

এর পরের দিন সকাল সকাল হবে নান্বিমুখ… কনে বা বর তার চোদ্দ পুরুষকে জল দেবে… আমার প্রশ্ন কবে রাম রাজা হবে তবে সীতা বনে যাবে? আরে ভাই কবে বিয়ে হবে দশ বছরে একটা তবে চোদ্দ পুরুষ জল পাবে? জল ছাড়া যদি দিব্বি থাকে তারা তাহলে অহেতুক উৎপাত করার দরকার কি? আর জল যদি জরুরিই হয় রোজ জল দেবো না কেন? জল শুধু চোদ্দ পুরুষকে দেবো কেন? চোদ্দ মহিলাকে নয় কেন? শুধু পিতামহ প্রপিতামহ ইত্যাদি? তাহলে পিতামহী রা গেলো কোথায়? তাদের ভূমিকা কি কিছুই ছিলো না? এর উপর ভেবে দেখার ব্যাপার পিতামহের গুরুত্ব যতোটা মাতামহের গুরুত্ব কিন্তু ততোটা নয়! তার মানে এই নান্বি মুখে পূর্বপূরুষ ও নারীদের সম্মানের চেয়ে অপমানটাই বেশি করা হয়? দ্বিতীয়ত, আমরা বিবাহে সাতপাকে অর্থাৎ সাতজন্মে বাঁধা পড়ি। তার মানে আমরা পূনর্জন্মে বিশ্বাস করছি। অথচ আমরা চোদ্দ-পুরুষকে জল দিচ্ছি —তার মানে তেরো প্রজন্ম ধ’রে আমরা বিশ্বাস করছি আমাদের পূর্বপুরুষদের পূনর্জন্ম হয় নি, তাদের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। একই ধার্মিক আচরণ এই বিবাহ রীতিতে একই সঙ্গে আমরা পূনর্জন্মে বিশ্বাস করছি আবার করছি না! ধার্মিকরা একটু উত্তর দেবেন?

এরপর গায়ে হলুদ। একমাত্র এই জিনিসটা অতোটাও লজ্জাজনক নয়, তবে ছেলের গায়ে লাগানো হলুদ-ই মেয়েকে মাখতে হবে এটা অপমন জনক নয় কি? হলুদ টা তো আস’লে বিয়ের পূর্বে কনের একটু রঙ উজ্জ্বল করার প্রয়াস এর মধ্যে আবার বরের ছোঁয়াচ কেন? তাছাড়া নিজের রঙ কে অহেতুক ফরসা করার মধ্যে একটা ঔপনিবেশিক প্রভাব আছে, না ইংরেজদের প্রভাব নয়, এটা ভারতীয় কালো চামড়ার মানুষদের আর্যদের মতো হ’তে চাওয়ার প্রয়াস… এটা পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে লজ্জাজনক বই কি, তবে হলুদের কিছু রাসায়নিক ভালো গুন আছে আর হলুদ মাখামাখি খেলার মধ্যে একটা রঙ খেলার মিষ্টি আনন্দ আছে, তাও আবার প্রাকৃতিক রঙ, তাই এটা মেনে নেওয়া যেতে পারে… কিন্তু তারপর? যদিও এখন মেয়েরা বিউটি পার্লারে ফেসিয়াল ক’রে এসে গালে হলুদ লাগাতে চাইছে না কারন তাতে অতো টাকার ফেসিয়াল নষ্ট হয়ে যাবে! এরপর মেয়েটির সিঁথিতে মহিলা সকল যারা ‘এয়ো’ অর্থাৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বোউদি  স্থানীয় বিবাহিতা মহিলা, যাদের সঙ্গে যৌনমূলক কথাবার্তা মেয়েটি বলতে পারে সেরকম মহিলা, তারা মেয়েটিকে ঘিরে পান পাতায় সিঁথি ঢেকে সরষের তেল ঢালে, এটা গুরুজনেরা করে না কেন? জানার কথা যে সিঁথিটা কিন্তু যোনির প্রতীক। এর পর স্নান হয়, কোনও বিবাহিতা মহিলা পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় কনে কে, ঘট ডোবায়, অনেকটা অলিম্পিকের মশাল দৌড়ের মতো, ব্যাটন তুলে দেওয়া হাতে, কনের হাতে এক বিবাহিত মহিলা বিবাহিত জীবন যাপনের অধিকার তুলে দেয়, যা সমাজ দ্বারা স্বীকৃত, এতে অসুবিধা নেই, অসুবিধা এই পরবর্তী জীবনটার প্রকৃতি নিয়ে, নিজে পাঁকে থাকা একটা মেয়ে কেন আর একটা মেয়েকে একই রকম অমর্যাদার জীবনে টেনে আনে? এই নিয়ে আবার সম্মানের খেলা চলে। যে ঘট ডোবাবার সম্মান (!) পেলো না তার অভিমান হয়… মেয়েরা খাঁচায় এই ভাবেই সুখে থাকে। সঙ্গে থাকে একটা নিত কনে যে ওই রকম একটা বিয়ের স্বপ্ন দেখতে হয়তো ওই দিন থেকেই শুরু ক’রে দেয়। এই তো সবে শুরু…

প্রাচীন কাল থেকেই বিয়েতে মেয়েদের কোনও ইচ্ছা অনিচ্ছাকে যাতে পাত্তা না দেওয়া হয় তার কতোগুলো পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। সারাদিন মেয়েটা না খেয়ে থাকে, ক্রমশ সে দূর্বল হয়ে পরে, তার মত নেই এমন কারো সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হলে শারীরিক ভাবে বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতাটাই থাকে না। অন্য দিকে বর আসা মাত্র একে একে গুরুজন স্থানীয় মেয়েদের দল তাকে দুধ মিষ্টি খাওয়ায়… হ্যাঁ মেয়েরাই কনেকে দূর্বল ক’রে বরকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ায়, এতেই সমাজের মঙ্গল, যে সমাজ কনের ইচ্ছাকে পাত্তা দেয় না, কনে কিন্তু মঙ্গলের শেকল ভাংবার সাহস পায় না, ছোটো বেলা থেকে সে এভাবেই আত্মবিশ্বাসহীন ভাবে বেড়ে উঠেছে। এর পর কিছু পুরুষ যাদের সঙ্গে কনের এমন সম্পর্ক যে সামাজিক ভাবে কনে তাদের ভোগ্যা হ’তে পারে না, সেইরকম পুরুষেরা কনেকে পিঁড়েতে চাগিয়ে বরের চারপাশে গোড়ায়, মেয়েটা যদিও দূর্বল তবু যদি বিয়েতে যেতে না চায়! সেই রিস্কটাই নেওয়া হয় না, চাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ধার্মিকরা বলবেন এই খানে কানা খোঁড়া মেয়ের সঙ্গে ভালো মেয়ের আমরা তফাৎ করি না আমাদের মহত্ত্ব দেখুন! কিন্তু ধার্মিক মশাই সামান্য রঙ কালো হ’লেই আপনাদের সমাজে বিয়ে হওয়া মুশকিল তাও আবার কানা খোঁড়া… সাত পাকের সাতটা শেকলে জড়িয়ে, আগামি সাত জন্ম পর্যন্ত বুকিং ক’রে পানে ঢাকা মুখ খোলা হয় কনের, প্রাচীন কালে ওই সময়-ই প্রথম কনে বরকে দেখতো! সারপ্রাইজ! তাও তো বেশির ভাগ সময়, আমার নিজের দিদির বিয়েতেও আমি দেখলাম সারাদিন না খাওয়া কনে অজ্ঞান হয়ে গেলো… তা হলে দেখা হবে অন্য কোথাও!

যে মেয়েটা প্রেম ক’রে বা দেখে শুনে আগে থেকে বর পছন্দ ক’রে আজ বিয়ে করছে সে কেন পিঁড়েতে চেপে যাবে? পান দিয়ে মুখ ঢেকে রেখে নক্সা করবে? আর যে ছেলে তার হবু বউ এর ভালো চাইবে সে কেন সহ্য করবে যে সে ভালো মন্দ খাবে আর তার হবু বউ সারাদিন না খেয়ে থাকবে। এরকম বর কে সন্দেহ করো মেয়েরা, এরা যদি এটা পারে তবে পরে বউ এর খাবার আছে কি নেই না দেখেই নিশ্চিন্তে খেয়ে দেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবে। আর এই সাত পাক সম্পর্কে আমার একটা আপত্তি আছে মাই লর্ড। ধরা যাক রামের সঙ্গে এই জন্মে সীতা সাত পাকে বাঁধা পড়লো, আর পরের জন্মে রাম শ্যাম হ’ল, আর সীতা গীতা হয়ে সাত পাকের টানে টুকুর টুকুর প্রেম করছে। সমাজ মানলো না। সে ছাড়লো ব্রম্ভ্রাস্ত। গীতার বিয়ে দিলো বুড়ো একটা সরকারি চাকরি ওলা ভামের সঙ্গে, মেয়েটা সাত যোগ সাত চোদ্দ পাকে বাঁধা পড়লো! এখন শ্যামতো গলায় দড়ি দিয়েছে। পরের জন্মে রীতা এখন কাকে ছাড়ে? তাই ত্রিকোন প্রেম। এই ভাবে পাঁচ জন্মে পয়ত্রিশ পাকের পর ষষ্ট জন্মে সে হ’ল দ্রৌপদী। তার পাঁচ খানা বর! এই জটিল অঙ্ক আপনারা সৃষ্টি করছেন সামাজিক দাদাসাহেব। অঙ্কটা সহজ ক’রে এক পাকে রাখুন, তাতে পরকীয়াটা কমে।

এরপর হবে সেই মহান ঘটনা যা না হ’লে নাকি বিয়ে হয় না! সিঁদুর দান। মেয়েটার কুমারী সিঁথিতে লাল সিঁদুর। এর দুটো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় লৌকিক ভাবে। কোনও একসময় কোনও এক গোষ্ঠীতে একটি কুমারী মেয়ের জন্য তার দুই প্রার্থী যুদ্ধ করতো, বিজয়ী প্রার্থী পরাজিতকে মেরে তার রক্ত দিয়ে সিঁথি রাঙ্গাতো, এটা একটা জয়ী পুরুষের বিজয় পতাকা ছাড়া আর কিছুই নয়, কে জানে মেয়েটা হয়তো পরাজিতটাকেই চাইতো বা দু’জনের কাউকেই চাইতো না, থাক মেয়েদের আবার চাওয়া না চাওয়া… এখনও বেশ কিছু জন্তু এরকম করে সঙ্গম কালে, আমরাতো মানুষ আমরা নাহয় এরকম খুনো খুনির পতাকা নাই বহন করলাম। দ্বিতীয় মত, সিঁথি হ’ল যোনির প্রতীক। যোনিতে প্রথমবার সঙ্গমকালে রক্তপাত হয়, অর্থাৎ বর কনের যোনিতে প্রথম রক্ত পাত করলো। এতোগুলোর লোকের সামনে এসব করতে বাধ্য করা হচ্ছে ছেলে মেয়েটাকে এটা কি অশ্লীল নয়? কি সামাজিক বাবু? তাছাড়া ডাক্তাররা বলছেন আজ কালকার দৌড় ঝাঁপ সাইকেল বাইক চালাতে গিয়ে অনেক মেয়ের-ই প্রথম রক্তপাত অজান্তেই ঘ’টে যায়… তাহ’লে এটার যুক্তি আর কি থাকে? তাছাড়া সিঁদুর ঠিক থাকার চেয়ে সিঁদুর ঘেঁটে যাওয়াতেই তো যৌনতার বেশি প্রকাশ পায়! তাছাড়া যৌনতা বাদ দিন, বউ বা মা বা বোনের মাথায় নিতান্ত স্নেহের বশে চুমু খেতে গেলে ঠোঁটে সিঁদুর লেগে যায় ইসসস কী বিরক্তিকর ছ্যা!

কিন্তু এসব যদি অস্বীকারও করি সারমর্ম একটাই সিঁদুর আসলে চিহ্ন। ওই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য মেয়ের দিকে তাকাও ওর শরীর এখন সাতজন্মের জন্য বুক হয়ে গেছে। সিঁদুর কেন লাল? পলা কেন লাল? যে কারণে পথের সিগন্যাল লাল সেই একই কারনে। লাল সবচে বেশি চোখে পড়ে, তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচে কম। তার আকর্ষনী ক্ষমতা সবচে বেশি। পলার পাশে সাদা শাঁখা কারন তাতে শাড়ি কাপড়ের বিভিন্ন রঙের মধ্যেও সাদার পাশে লালটা খেলে ভালো। অনেকে বলেন শাঁখা আর সিঁদুর মাথা ঠান্ডা রাখে, তাহলে তো বরে দের-ই ওগুলো পড়া বেশী দরকার, তারাই তো দেখি চেঁচায় বেশি! তাছাড়া সিঁদুর নিশ্চয় মাথা ঠান্ডা রাখার সেরা ওষুধ নয়?

এ ছাড়াও কতোগুলো আচার আছে।

কনে কর্তা/ কর্তী বরকে আংটি দান করে। না হ’লে দান শুদ্ধ হয় না। আসলে আংটি যোনির প্রতীক। যোনিই যদি না দিই যৌনতা হবে কি ক’রে? অর্থাৎ আমি নিজে হাতে আমার মেয়ের যোনিটা দান করলাম, তাকে ভোগ করার সামাজিক অধিকার দিলাম। একটা মেয়ের শরীর নিয়ে হচ্ছেটা কী? খাট বিছানা থেকে শুরু ক’রে তার চাল আলু যাবতীয় জিনিস বাসন সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার বদলে বর কনেকে ভোগ ক’রে কৃতার্থ করে! এর থেকে কিন্তু বেশ্যারা স্বাধীন, পয়সা না পেলে খদ্দেরের তলপেটে লাথি মারে। লেখকের নাম ভুলে গেছি লেখক মাফ করবেন, আপনার একটা গল্প পড়েছিলাম, বর কনেকে বিছানায় ফেলছে আর বউ বলছে আমার কিন্তু এমাসে ওই শাড়ীটা চাই, বর বলছে আচ্ছা। কীরকম সামাজিক বেশ্যাখানা চলছে?

ইদানীং একটা বিজ্ঞাপন দেখা যায়, মেয়েটি একটা হীরের আংটি চায়, বরকে বলতে পারছে না, খালি বিভিন্ন আছিলায় হাতের ফাঁকা আঙ্গুলটা দেখাচ্ছে। ‘তুমকো চাহিয়ে আগার এক ডায়মন্ড রিং/ তো ইন্তেজার করো ফর দ্য পারফেক্ট টাইমিং’… উপহার একজিনিস আর এরকম হ্যালহেলে পনা আলাদা… শিক্ষিতা মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের চাহিদা নিজে মেটাবে, উপহার হয় অনাকাঙ্খিত, এভাবে নয়। আর ভালোবাসবে শরীর উপভোগ করবে দুজনেই, নিঃশর্ত, শুধু নিখাদ ভালোবাসার টানে। গহনার কথা যখন এলো তখন বলি, মেয়েরা বালা চায়, বালার দাম খুব, বালা না হ’লে নাকি ওই দান পুর্ণ হয় না, বাবা অসমর্থ হ’লে মেয়েরা দুঃখ পায়। কিন্তু শেকল কি শোনার হলে তা শেকল থাকে না? ওটা তো শেকল। নাম আর আকার টা দেখুন। ঠিক যুদ্ধ বন্দিদের মতো। হ্যাঁ ওটা স্বামী আর সংসারে কয়েদ হওয়ার সামাজিক পন্থা মাত্র এতে অপমান আছে। ওটা ছেড়ে অন্য অলংকার পড়ুক মেয়েরা যাতে তারা সুন্দর হবে, বন্দি নয়।

এর পর পরের দিন বিদায়। আঁচলে ক’রে কতোগুলো জিনিস ছুঁড়ে দিয়ে মেয়ে বলবে তোমার সব ঋণ শোধ ক’রে দিয়ে গেলাম। প্রথমত মেয়েকে মানুষ করা মা এর কর্তব্য, তাতে ঋন থাকার কথা নয়, দ্বিতীয়ত, যদি ঋন থেকেও থাকে মা এর ঋণ শোধ করা যায়? মা আর পতিতাপল্লীর মালকিন এক হয়ে যায় আমার কাছে এবং এটা সমাজ-ই ভাবতে বাধ্য করে।

ছেলে বিয়ে করতে যাবার সময় মাকে কি ব’লে যায়? ‘তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি’, এটা কোনও অসভ্য জাতির পক্ষেই সম্ভব। সে দাসী নিয়ে হাজির করে। একটা বিনা মাইনের কাজের লোক। তাই সে কলসী চাগাতে পারে কি না, কাঁটা ভর্তি মাছ ধরতে পারে কি না, কাদার মধ্যে থেকে কড়ি খুঁজে পায় কি না, এসবের মধ্যে শুধু খেলা নেই, খেলার অনেক নিয়ম থাকে, নিয়মের কোনও খেলা থাকে না। বিয়ের ঝামেলায় দূর্বল, ক্লান্ত একটি মেয়ে নতুন একটা অচেনা বাড়িতে অচেনা লোকের সঙ্গে এসে শুধু প্রতিকূলতা পায়, এটা সভ্যতা নয়। আর যদি আজকের দিনে পরীক্ষা দিতেই হয়,তবে কলসি কেন? সে জলের দশ লিটারের জার চাগাতে পারে কি না দেখতে হবে, আর মা বাবা পেতলের অচল বাসন না দিয়ে কাচের বাসন দিতে পারে, যদিও এটা যুগোপযোগী হ’লেও অপমাণ বিন্দু মাত্র কম হয়না । তারপর বরের মা-এর কোলে বর কনে বসে, এখনকার কমপক্ষে একুশ বছরের ছেলে আর আঠারো বছরের মেয়ের পক্ষে এটা শোভা পায় না। এটা প্রচলিত ছিলো বাল্যবিবাহের জন্য। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এতো অসঙ্গতির দিক দেখানো যায়, যে শেষ করা যাবে না। মেয়ের বউ ভাতে কিন্তু মা যেতে পারে না! গেলেও মেয়ের শ্বশুরবাড়ির অন্ন তাকে বরকর্তার হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে খেতে হয়। মেয়ের পয়সায় যে বরেদের সব ভরং তাদের কাছে এইভাবে কেন অপমানিত হ’তে হবে শুধু মেয়ের মা ব’লে?

কতো বই তো নিষিদ্ধ হয়, কিন্তু মনু সংহিতা হয় না। এখনও দু’রকম বেদের মতের বিবাহ আছে, ভিন্ন ধর্মের বিবাহ আছে সব ক্ষেত্রেই আমার বিশ্বাস মেয়েদের খাটো করা হয়েছে। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন, যে সম্পর্ক এতো অপমান দিয়ে শুরু হয়, তা থেকে সম্মান পাওয়ার আশা করাই বৃথা। আর আমি বুঝি না কেন ব্রাম্ভন নামক একটা পৈতে আছে ব’লে মানুষ, আমাদের বিয়ে দেবে তাও আবার পয়সা নিয়ে ? সে কে? আমার মা বাবা গুরুজন আছে, কিন্তু ধর্মের সমাজ সম্মত দালাল মানবো কেন? এক দল স্প্যানিশ না জানা লোকের সামনে আমি যদি শুধু স্প্যানিশ ভাষায় কথা ব’লে যাই, বুঝতে হবে আমি চাইনা তারা আমার কথা বুঝুক। আর তারা যদি আমার কথা শুনে আর না বুঝে আওড়ে যায় জানতে হবে তারা আহাম্মক। যেমন ব্রাম্ভনের কথা আওড়ে আমরা বিয়ে করি। জানিও না কি বলছি। আদেও সেটা বাংলায় বললে আমরা বলতাম কি? এমন অনেক ব্রাম্ভন আছে যারা স্রেফ মুখস্থ ক’রে চালিয় দিচ্ছে, নিজেরাও সংস্কৃত জানে না। আরে দরকার কি? সঙ্গম করার সময় শুধু যদি সংস্কৃত বলতে হয় ঠেলা বোঝা যাবে!

এখন ২০ শতাংশ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই কাজের জন্য হোক বা সময়ের অভাবে অনেক কিছুই মানছে না। কিন্তু সিঁদুর তারা আজো ছাড়তে পারে নি। মেয়েরাই মেয়েদের ছাড়তে দেয় নি। সিঁদুরে নাকি স্বামীর মঙ্গল। স্ত্রীর তবে কিসে মঙ্গল? একটা বিবাহিত পুরুষকে কেন দেখে বোঝা যাবে না সে বিবাহিত? সিন্দুর কিন্তু তার কাজ করতে ব্যর্থ। ট্রেনে এক মহিলাকে ‘আপনি কি বিবাহিত?’ জিজ্ঞেস করায় সে রেগে গিয়ে বললো ‘দেখতে পারছেন না, মাথায় কি সিঁদুর আছে?’। কিন্তু তাতে কি? বিধবাও তো হ’তে পারে? অর্থাৎ সিন্দুর ব্যর্থ। তাছাড়া সমাজের এই বর্জ্য আটুনির ফাঁস উল্টোই হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই অবিবাহিতরা, সিন্দুর প’ড়ে হোটেলে রাত কাটায়, এক জনের বউ আর একজনের বউ পরিচয়ে থাকে… সিঁদুরেতো আর স্বামীর ছবি দেওয়া থাকে না, আবার সিঁদুর থাকলে সার্টিফিকেট চাওয়া যায় না। কিন্তু একজন প্রকৃত আত্মবিশ্বাসী শিক্ষিত পুরুষ চাইবে না তার স্ত্রী একটা ফালতু চিহ্ন বহন করুক। আমিও করি না। যা তার এমনিই নিজের তাকে বেঁধে রাখবে কেন? কিন্তু যে পাখির খাঁচায় জন্ম তারা খাঁচার পাখিকে বনে ছেড়ে দিলে হে হে ক’রে ওঠে। আমাদের সমাজ বস্তুত একটা বিরাট খাঁচা। প্রাপ্ত বয়স্ক দু’জন মানুষ স্বেচ্ছায় শরীর দেওয়া নেওয়া করার অধিকার তাদের আছে, কিন্তু সমাজের হোতারা একটু ভাবুন আপনাদের অস্ত্রই, আপনাদের বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে।

এর চেয়ে আমি একটা তথ্য দিই। ভারত সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা আইন আছে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪। এই আইন মতে ২১ বছরের ছেলে আর ১৮ বছরের মেয়ে হ’লেই তারা বিয়ে করতে পারে যদি তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রক্তের সম্পর্ক না থাকে। এবং তা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। সমাজ মানতে হ’লে আগে আইন মানতে হবে। এ এমন এক আইন যা শুধু মানুষকে মানুষ হিসাবেই ব্যাখ্যা করছে। প্রকৃত শিক্ষিত নারী পুরুষের এই আইন মতেই বিয়ে করা উচিৎ। আর চিহ্ন টিহ্ন দিয়ে কী হবে? বিবাহের সার্টিফিকেট আছে না? আসুন মেয়েদেরও বিবাহিতা, অবিবাহিতা, বিধবা, এরকম আলাদা জগতের জীবনে ছুঁড়ে না ফেলে এক সামগ্রিক নারী জীবনে তাদের বাঁচতে আমরা পুরুষরা সাহায্য করি।

আর এতোক্ষণ বিবাহ নিয়ে কথা ব’লে শেষ করার আগে ডিভোর্স নিয়ে একটা কথা বলি। যিনি যতো ধার্মিক-ই হন না কেন আমি দেখিনা বিবাহ বিচ্ছদের বেলায় আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বিবাহে নিমন্ত্রিতদের আবার আমন্ত্রণ জানিয়ে আগুনকে সাক্ষী রেখে সাত পাক উলটো দিকে ঘুরে, অর্থাৎ সাত জন্মে বাঁধন খুলে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। তার বেলা অত্যন্ত ধার্মিকটিও আদালতের দ্বারস্ত হন। একটা সই! আর সাত সাতটা দড়ি কেটে যায় এতো ধার। তার মানে ধর্মের চেয়ে আইনের ক্ষমতা বেশি! ধর্ম তো বহুবিবাহ দেয় খোরপোশ দেয় না। তাই কিনবো যখন বেশি ওয়ারেন্টি থাকা শক্ত পোক্ত জিনিসটাই কিনবো। আসলে পুরোটাই তো বর কেনা বেচার প্রায়াস। একটা বড়ো সংখ্যক মানুষের পেট চলে এতে। বাজারে যদি নামতেই হয়, পচা দড়ি সাতবার না জড়িয়ে আইনের শক্ত বাঁধন দেবো। যদি ভবিষ্যতে বিচ্ছেদ করতেই হয়, তখন অন্তত লজ্জায় পরতে হবে না। বিবাহের বেলা ধার্মিক আর বিচ্ছেদের বেলা আইনবিদ তাও কি হয়?

আমি আগেই বলেছি আসলে মেয়েরাই মেয়েদের প্রতিবন্ধক। বিবাহের এই বাজারটাকে আরাই বাঁচিয়ে রেখেছে। কেনা বেচার কাঁচামাল তারাই, অথচ তারাই তাতে উৎসব করেছে! সম্প্রতী আমার নিজের প্রেমিকাকে বিবাহ করার কথা হচ্ছে। আমি আইন মেনে, ধার্মিকতা ও ব্রাম্ভনকে অগ্রাহ্য ক’রে, সিঁদুরকে উপেক্ষা ক’রে বিয়ে করতে চাওয়ায় দুই পক্ষের মেয়েরাই বেঁকে বসেছে। ছেলেদের ব্যাপারটা এমন তারা আমাকে সমর্থন করে না কিন্তু অতো তর্কাতর্কির সময় নেই। আমার বিয়ে নিয়ে তাই তুমুল গন্ডগোল। আমার প্রেমিকা কিন্তু মেনে নিয়েছে আমার কথা, আর আশ্চর্য জনকভাবে মেনে নিয়েছে আমার মামার ছেলে আর প্রেমিকার মামাতো দাদা — এবং দু’জনেই মহিলা নয়! বাকি সমস্ত মেয়েরা সব ব্যাখ্যা করা সত্ত্বেও রনং দেহী মূর্তী নিয়ে উদ্যত। বাঙালী শিক্ষিত সমাজের কাছে আর সংবেদনশীল সমাজের কাছে আমি সমর্থন চাই না, শুধু তারা প্রাত্যহিক জীবনে মেয়েদের আরও সম্মান করুক এই চাই। এতো অসম্মান যাকে আমি ভালোবাসি তাকে কীভাবে করবো? এটা পারছি না ব’লে হয়তো এতো জবাব দিহি করতে হচ্ছে সামাজিক আত্মীয়দের কাছে। কিন্তু আমি দেখেছি মানুষ যতো সামাজিক হয় ততো অমানবিক হয়ে পড়ে। সামাজিকতা থাক। মানবিকতাই আমার প্রাণ হোক। একটা দিন আসুক যেদিন আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালনে মেয়েরা অস্মমানিত হয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলবে, মেয়েরাও মানুষের মর্যাদা পাবে, না, পুরুষের কাছ থেকে তাদের আদায় করতে হবে না, তা তাদের নিজেদের কাছ থেকেই আদায় ক’রে নিতে হবে। যে নিজেকে সম্মান করে না তাকে কেউ সম্মান করে না।

০৭।০৩।১৩  রাত ১১ টা ৫৬

দশগ্রাম

 

 

One comment on “হিন্দু বিবাহ ও নারী মুক্তি ! ভা স্ক র জ্যো তি  দা স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *