ভণ্ডামি সব..

সব জালিয়াত খেলছে জুয়া। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর থেকে জালিয়াতি গুলো আরও বেশী করে চোখে পরছে। এই মৃত্যুর সম্বন্ধে যত পড়ছি তত সন্দেহ দানা বাঁধছে যে ঘটনাটি সাজানো। তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে সাজানো হয়েছে। জালিয়াতির নতুন আখ্যান দেখছি প্রতিদিন। 

প্রথম আখ্যান – ন্যারেটিভ শুরু মৃত্যুর পরের দিন থেকে – মানসিক অবসাদ নিয়ে। রোহিণী আইয়ার নামে একটি তথাকথিত ঘনিস্ট বন্ধু সুশান্ত সিং রাজপুতের সম্বন্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন। আর সব কটি নিউজ চ্যানেল সেটি ব্রেকিং নিউজ বলে প্রচার করল। পোষ্টটি খুব মুনশিয়ানার সাথে লেখা। প্রথমে পড়লে মনে হবে সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য তথাকথিত ঘনিস্ট বন্ধুটির দুঃখ ঝরে পড়ছে। কিন্তু কয়েকবার পড়লে বুঝতে পারবেন কি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে লেখাটির রচয়িতা মৃত্যুর সব দোষ সুশান্ত সিং রাজপুতের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। রোহিণী আইয়ার বলিউডের নামকরা পাবলিসিস্ট। তিনি আদও সুশান্ত সিং রাজপুতের ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। তিনি নিজের পাবলিসিস্ট-এর কাজটি সূক্ষ্ম ভাবে করে ফেললেন। এই আখ্যানের এখন নতুন সংযোযন রিচা চাড্ডা। তিনি সম্প্রতি একটি রাগী পোস্ট করেছেন যে মৃত্যু রহস্যে চক্রান্ত না খুঁজে আমাদের আসল কারণটিকে ( মানসিক অবসাদ ) নিয়ে চর্চা করা উচিত। আবার সবকটি নিউজ চ্যানেল সেই খবর ছাপছে। মজার কথা এই যে এই খবরের চ্যানেলগুলি আগে কোনোদিন এই দ্বিতীয়সারির সেলিব্রিটিদের কথায় এত গুরুত্ব দিতনা। হঠাত আশ্চর্যজনক ভাবে তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে। 

দ্বিতীয় আখ্যান শুরু হল নেপোটিজিম নিয়ে। আরে বাবা মানসিক আবসাদের তো একটা কারণ থাকতে হবে। ন্যারেটিভটি এরকম – নেপোটীজিমের কারণে সুশান্ত সিং রাজপুত কাজ পাচ্ছিলেননা তাই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। প্রথমে কঙ্গনা রানায়ত এই নিয়ে ব্যাট ধরলেন। তিনি নেপোটীজিমের বিপক্ষে স্টার প্লেয়ার। সুশান্ত সিং রাজপুতের সম্বন্ধে দুটি কথা বলে বাকি দশ মিনিট তিনি নিজের ঢাক পেটালেন। এরপর এলেন সনু নিগম। বিছানা থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে সারাক্ষণ নিজের দুঃখের কথা আমাদের শুনিয়ে গেলেন। 

এই দুটো ন্যারেটিভ-ই আমাদের সত্যি ঘটনার থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আবেগে ভেসে আমিও এই দুটি ন্যারেটিভের ওপর পোস্ট করেছি। বাম বলছে মানসিক অবসাদ, ডান বলছে নেপোটীজিমের শিকার। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় দুদিক-ই একই কথা বলছে। 

এই ভণ্ডামি প্রমোট করছে দেশের তাবড় তাবড় মিডিয়া হাউস। এনডি টিভি বা টাইমস অফ ইন্ডিয়া খুলুন দেখবেন এক গাদা পোস্ট ‘fake celebrity’ সোনম কাপুরকে নিয়ে। তিনিই কি খাচ্ছেন, কি পরছেন, কেন এতবার হাসলেন প্রত্যেক দিন ছাপা হচ্ছে। কিছুদিন পড়তে থাকলে বুঝবেন এগুলো সব পয়সা দিয়ে ছাপানো হচ্ছে। ধনী স্বামী থাকলে যা হয়। একটার পর একটা ফ্লপ ছবি করেও তিনি – সোনম কাপুর প্রতিদিন খবরের শিরোনামে। 

বাকিরা কেউই কম যান না, এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। আমীর খান সত্যমেব জয়তে অনুষ্ঠানে প্রতি এপিসোডের জন্য তিন কোটী টাকা নিয়ে সামাজিক সমস্যার জন্য কুম্ভীর-অশ্রু বিসর্জন করেন। আবার তার ঠিক পরেই সলমন খান এক নিরাশ্রয় ব্যাক্তিকে হত্যা করার পর দুদিনের মাথায় জেল থেকে ছাড়া পেলে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। PK ছবিতে হিন্দু ধর্মের সমস্যা গুলি তুলে ধরেন, কিন্তু তিন তালাক আইন নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেন না। 

বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা আমিতাভ বচ্চন জানেন কি’করে প্রতি পদক্ষেপে ভণ্ডামি করে টাকা উপার্জন করা যায়। উনি বিতর্ক বিবাদ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। আশির দশকে কংগ্রেসের হয়ে ভোটের রাজনীতিতে নেমেছিলেন। উপার্জনের পথে বাধা পড়ায় রাজনীতি থেকে নিজে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে বচ্চনজীর সহধর্মীনী জয়া বচ্চন ২০০৪ সাল থেকে সমাজবাদী পার্টির হয়ে রাজ্যসভার সদস্যা হন। এখন আমিতাভ বচ্চনজী করোনা হয়েছে বলে টাকা উপার্জনের পথে নেমেছেন। বাড়িতে সব সুযোগ সুবিধা থাকতেও হোম কোয়ারেন্টিন না করে সোজা নানাবতী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তী হওয়ার সাথে সাথে নানাবতী হাসপাতালেল গুণগান গেয়ে একটি ভিডিও ভাইরাল করেছেন। আরে তিনি নানাবতী হাসপাতালের মালিকানার অংশদার, করোনার নামে দুটো পয়সা উপার্জন করবেন না! তাইকি হয়। কি বলেছেন? সাধারণ মানুষ হাসপাতালে বেড পাচ্ছেন না। আরে তাতে কি? সাধারণ মানুষ এমনিও নানাবতী হাসপাতালের চোহুদ্দুর মাড়াতে পারবেনা। 

বলিউডের ভণ্ডামির শ্রেষ্ঠ আসনটি অবশ্য নেবেন ভাইজান সলমন খান। সারা জীবন ধরে অনেক দুষ্কর্ম করে এসেছেন। রাজস্থানে কৃষ্ণসার হরিণ মারা থেকে শুরু। এরপর মদ্যপ অবস্থায় ফুটপাতে শুয়ে থাকা নিরাশ্রয় গৃহহীনদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেন। একজন গৃহহীন তাতে মারা পড়েন। তবু ভাইজান জেল খাটা থেকে বেঁচে যান। বান্ধবীর বাড়ি চড়াও হওয়া, খুন করার হুমকি, কত অভিনেত্রীরা তার সাথে শুয়েছেন তার ফিরিস্তি, এসব’ত ছেড়েই দিলাম। ভাইজান এই মুহূর্তে বলিউডের অন্যতম bully – সাদা বাংলায় আমরা যাকে বলি মস্তান। তিনি যাকে তুলবেন সে ফিল্মে কাজ পাবে। যাকে পচ্ছন্দ নয় সে, না খেতে পেয়ে মরবে। তার নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মুম্বাই-এর মাফিয়াদের সাথে তার ওঠা-বসা। কিন্তু আমাদের তাকে বাহবা দিতে হবে সমাজসেবক বলেন। তিনি “Being Human” নামের ব্র্যান্ড চালান আর দুঃস্থদের জন্য প্রচুর দান ক্ষয়রাত করেন বলে। দুদিন আগে তিনি জয় জওয়ান জয় কিষান বলে গায়ে হঠাত কাদা মেখে ফোটোশুট করেছেন। পরিষ্কার হাত নিয়ে মুখে কাদা লাগানো (??) বজরঙ্গী ভাইজানের মধ্যে বোধহয় মহারাষ্ট্র সরকার তাহাদের কৃষক সমস্যা সমাধানের ব্র্যান্ড আম্ব্যাসাডার পেয়ে গেছেন।  

— লিখেছেন ইলা সেন, দুর্গাপুর থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *