কোভিড ও ইলিশ

ইলিশ নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই খিদে পেয়ে গেল। একটা বড় সাইজের ইলিশ নিয়ে এসেছি। দামের কথা আর নাই বললাম। দই ইলিশ না দুধ (নারকেলের) ইলিশ কোনটা খাবো এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। সবই অবশ্য গিন্নীর উপর নির্ভর। পেটের মোচড়কে আপাতত দাবিয়ে চলুন কাজের কথায় মন-দি।

দুধ (নারকেলের) ইলিশ

ইলিশের সাথে বাঙ্গালীদের প্রেম (আমার-ও) যুগ যুগ ধরে। ইলিশের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে। বাঙ্গালীর রসনা, ভালবাসা, আর্থিক উন্নতি সব বহুকাল ধরে ইলিশের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত। বাঙ্গালীদের দাবী এমন-ও যে ইলিশ মাছ নাকি নিরামিষ মাছ (পেঁয়াজ-রসুন ছাড়াই বানানো যায়)।

আশ্চর্যের কথা এই যে ইলিশ শুধু বাঙ্গালীদের মাছই নয়, আরও অনেকধরনের মানুষ আছেন বিশ্বজুড়ে যারা ইলিশ প্রেমী। আমরা সাধারণত গঙ্গা বা পদ্মার ইলিশের তুলনায় ধুন্ধুমার করি। বিশেষজ্ঞদের মতে সবচেয়ে সুস্বাদু নাকি টাইগ্রিসের ইলিশ। সিন্ধু নদের ইলিশও নাকি লা’জবাব। মধ্যপ্রাচ্যে টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস আর সাত-অল-আরব নদীতে মেলে ইলিশ। তেমনই মায়নমারের ইরাবতীর অববাহিকায় ওঠে অনেক ইলিশ। বিশ্বের বাজারে ইলিশের বাৎসরিক বাণিজ্যিক ব্যবসা প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২ হাজার কোটী ডলার)।  বাংলাদেশের জিডিপি-র প্রায় ২% নির্ভর করে ইলিশের উপর। সারা বিশ্বের ৬৫% ইলিশ ওঠে বাংলাদেশে পদ্মা, মেখনা, রুপনারায়ন, ধলেশ্বরী থেকে।ইরাবতীর অববাহিকা থেকে আসে ১৫%। বর্মা থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার টন ইলিশ আসে বাংলায়। জুন মাসের মধ্যেই এবার বর্মা থেকে আমদানি হয়েছে ১০০০ টন ইলিশ।

ভারতের আরও অনেক নদীতে – গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ও মহানদীতে মেলে ইলিশ। অন্ধ্রপ্রদেশেও ইলিশ খুবি আদৃত। পোলাসা নামে পরিচিত ইলিশ গোদাবরী থেকে ধরা সবচেয়ে দামী মাছ। তেলেগু ভাষায় কথা আছে “পোলাসা/ইলিশের জন্য গলার মঙ্গল সূত্রও বিক্রি করে দেওয়া যায়”। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ইলিশের উদাহরণ হল সিন্ধিদের। সিন্ধিদের ইষ্টদেবতা হলেন ঝুলেলাল (বরুণ দেব)। গৌরবর্ণ মুখে বুক-লুটোনো ধবধবে সাদা দাড়ি ঝুলেলালের বাহন হল রুপোলী ইলিশ। চিনতে পারলেন দেবতাটিকে? “দমা দম মস্ত কালান্দর” গানটি মনে পড়ছে? এই গানটি শুরু ঝুলেলালের প্রশস্তি গেয়ে – “অ্যায় লাল মেরি পত আঁখিয় ভালা ঝুলে-লালন”।

আবার ইলিশের কথায় ফিরে আসি। শিরোনামটি নিয়ে নিজের মনেই একটু খটকা ছিল। শিরোনামটি দেখে গুলিয়ে ফেলার সম্ভবনা প্রবল। ইলিশের সাথে কোভিডের সম্পর্কটা কি? ইলিশেরও কি কোভিড হচ্ছে নাকি? আরে না না, মিথ্যে ভয় পাবেন না। কোভিডের সাথে ইলিশের সম্বন্ধটা আমাদের জন্য লাভ জনক।ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলি। এমনিতেই কোভিডের বাজারে সব কিছু উল্টোপূরান চলছে। লকডাউনের চক্করে কলকাতায় বহুদিন বাদে গাড়ির হর্নের জায়গায় পাখির গান শোনা গেছে। দিল্লীর ইন্ডিয়া গেট সূর্যর আলোয় বহুযুগ বাদ ঝলমল করেছে। 

 

পলিউশন বিহীন ইণ্ডিয়া গেট – লকডাউনের আগে ও পরে


রাস্তা ঘাট যেমন ছিল সুনসান তেমনি জলপথেও নেমে এসেছিল শান্তি। ভেনিসের খাল  গুলো নাকি এখন এতো পরিষ্কার যে তলা দেখা যাছে। 

ভেনিস ক্যানাল লকডাউনের পর

শুধু ভেনিসের ক্যানাল স্বচ্ছ হয়নি, বে অফ বেঙ্গল – বঙ্গোপসাগরের জলও আগের থেকে এখন অনেক পরিষ্কার। শুধু সাগরের জলই নয় আশেপাশের নদী গুলিতেও জলের গুণগত মান আগের থেকে অনেক ভাল। মৎস্যজীবীরা অনেক আসায় বুক বেঁধেছে যে এবার ইলিশ উঠবে ভালো। কোভিডের সাথে যুক্ত হয়েছে আম্ফান পরবর্তি নিম্নচাপের ঝিরঝিরে বৃষ্টি, দিনভর মেঘলা আবহাওয়া ও পুবালি হাওয়া। তার সাথে আম্ফান আর কোভিডের তাণ্ডবে মৎস্যজীবীদের জাল এতদিন না পরায় খোকা ইলিশ গুলো বড় হবার সময় পেয়েছে। এবার তাই বড় সাইজের ইলিশ আসার সম্ভবনা প্রবল। 

মরশুমের প্রথম লক্ষণ খুব একটা খারাপ নয়। দিঘার সৈকতে দেখা মিলেছে মরশুমের প্রথম ইলিশের। সাইজ ১ থেক ১.৫ কিলো।  লকডাউন ও সমুদ্রে মাছ ধরার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা কেটে যাওয়ার পর ১ জুলাই থেকে সমুদ্রে মাছ শিকারের জন্য দিঘা উপকূল থেকে প্রায় হাজার খানেক ট্রলার ও নৌকা সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিল। সুখের কথা দিঘার মৎস্যজীবীদের জালে যে সামান্য কিছু ইলিশ ধরা  পড়েছে, তা ভালো সাইজের। আপাতত ২ টনের মত ইলিশ ধরা পড়েছে। মৎস্যজীবীদের আসা দ্রুত বেড়ে এই পরিমাণ দিনে ১০-১২ টন হবে। ডায়মন্ড হারবার এলাকার মৎস্যজীবীদের জালেও ভালো পরিমাণ ইলিশ উঠতে শুরু করেছে। 

এই সুযোগে একটু নদীর ইলিশ আর সাগরের ইলিশ নিয়ে কথা বলে-নি। নদীর ইলিশ একটু বেঁটেখাটো মোটা, আর সাগরের ইলিশ সরু ও লম্বা।নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, বেশি রুপালী হবে রং। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল। ইলিশ যখন ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে, মানে উজানে আসে তখন নদীর যে প্ল্যাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায় ইলিশ মাছ তার কারণে তার শরীর বেটে ও মোটা হয়।ইলিশ স্রোতের বিপরীতে চলার সময় এদের শরীরে ফ্যাট বা চর্বি জমা হয়। এই ফ্যাট বা তেলের জন্যই নদীর ইলিশের স্বাদ বেশী হয়।

কোভিডের বাজারে শরীর ঠিক রাখতে ইলিশ খাওয়া আবশ্যনীয়। ইলিশ মাছে আছে আয়োডিন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড সুস্থ রাখে আয়োডিন, সেলেনিয়াম উৎসেচক ক্ষরণে সাহায্য করে যা ক্যান্সারের মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় লাভ এই মাছে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। সামুদ্রিক মাছ হিসেবে ইলিশে সম্পৃক্ত চর্বিও কম। যার ফলে ইলিশ খেলে হার্ট থাকবে সুস্থ। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালনও বৃদ্ধি পায়। ফলে থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। ইলিশ কোভিডের ঔষধ নয়। কিন্তু ইলিশ আপনার শরীরের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি বাড়াবে কোভিডের সাথে লড়াই করার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *