আনাতোল ফ্রাঁয়ের একটি গল্প শোনাব আজ। ভাল নাম বা আসল নাম জ্যাকুইস আনাতোল তিবো। এটি ছদ্মনাম। এই নামেই বিখ্যাত। ১৯২১ নোবেল পেয়েছিলেন সাহিত্যে। আদর্শে সমাজতন্ত্রী। রুশ বিপ্লবের খোলাখুলি সমর্থক। ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টিকেও জন্মলগ্নেই পক্ষপাতে সোচ্চার। নোবেলের বিশ্বাসে টলানো যায়নি তাঁকে। জন্ম প্যারিসে। কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, জীবনীকার, সাংবাদিক, গল্পকার । আনাতোল শুধু ফরাসী সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যের ঊজ্জ্বল নক্ষত্র। পুঁজিবাদের দর্শন আর শাসনকাঠামো তার রচনায় বার বার তীব্র, তীক্ষ্ণ, তির্যক ব্যাঙ্গে ও শানিত বিদ্রুপে জর্জর হয়েছে। এই গল্পটিও সেরকম।
পড়েছিলাম ‘ বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প’ এই নামের এক সংকলনে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পটি হারায় নি। মনে গেঁথে গেছিল। দীর্ঘ গল্প । অনেক তাত্ত্বিক বিশ্লেষন ছিল। সংক্ষেপে নির্যাসটুকু।
গল্পটি প্রথম যখন শোনাই তারও একটি গল্প আছে। ছিয়াত্তরের কথা। তখন দুর্গাপুরে আছি। চাকরিসূত্রে। ফিলিপস কারবন থেকে ভিড়িঙ্গী আসতাম মিনিবাসে। মিনিট কুড়ির রাস্তা বড় জোর। ওই সময় জুড়ে গল্পটা শুনিয়েছিলাম পাশে বসা সহযাত্রীকে। আমার অফিসের কলিগ। রোজ একসাথে আসতাম, যেতাম।
বসেছিলাম গেটের পাশের আসনে। কন্ডাক্টার টিকিট না কেটে বেহুঁস কান পেতেছিল। নামবার সময় টিকিট নিল না। বলল—রোজ এরকম গল্প শোনাবেন দাদা, ভাড়া লাগবে না।
তো ঠিক যেভাবে শুনিয়েছিলাম সে আদলেই বলছি। গল্পটি প্রাসঙ্গিক আজও। দেশকাল নির্বিশেষে।
প্যারী শহরে এক ফেরিওয়ালা থাকত। রোজ টানা ভ্যান গাড়ীতে চিনেমাটির বাসনকোশন বেচত প্যারীর রাস্তায়। ভ্যানগাড়ী বড় রাস্তায় বৈধ নয়। কিন্তু গলিতে কি বিক্রিবাট্টা জমে? খদ্দের কই? বড় রাস্তায় পুলিশ আছে। কিন্তু ফেরিওয়ালা যে দেবতার যেমন পুজো দিতে কখনো না করে নি। কিন্তু সেদিন কিনা তার ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হয়ে গিয়েছিল, সেদিন কিনা তখনো তার বউনি হয়নি, সেদিন কিনা তার মেজাজ কেমন যেন বিগড়ে ছিল। রাস্তায় পুলিশ যখন হাত পাতল সে বলল বিক্রি হয়নি।
বটে ! আস্পর্দা ! তর্ক করতে সম্মানে বাধল পুলিশের। নগদ না দিস বাসন তো দে। দেবতা একটি চিনামাটির পাত্র নিলেন। গাড়ির থেকে নিজের হাতে।
বলছিলাম না সেদিন কিনা মেজাজটাও বিগড়ে ছিল। ফেরিওয়ালা ঝগড়া শুরু করল। রীতিমতন হল্লা। নেহাত অফিসটাইম। সবাই ব্যস্ত। দাঁড়িয়ে যাওয়ার ফুরসৎ নেই –
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলেন এক ডাক্তারবাকবু। তাঁর তাড়া নেই। প্যারী শহরে এইসব ডাক্তার, উকিল আর গন্যমান্য ব্যক্তিজনের একটি সংগঠন হয়েছে আজকাল। নাগরিক অধিকার নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি নামে। নেই কাজ ত খই ভাজ। এঁরা সবসময় তক্কে তক্কে থাকেন কোথায় কোথায় বেচাল হচ্ছে। পুলিশ ঘুষ খায় জানা কথা। হাতে হাতে পাকড়ানোর এই সুযোগ। তিনি এসে নাক গলালেন এই ঝগড়ায়।
গোলমালটা কিসের? ডাক্তার বাবু দেখেছেন শুরু থেকেই। তবু পুলিশের মুখে শুনতে চাইলেন। কি আবার। লোকটা আমায় বেজন্মা বলে গাল দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু রুখে দাঁড়ালেন।
–মোটেই না। লোকটা গাল দেয় নি। আমি সারাক্ষন হাজির আছি।
— তাহলে? গাল তো কেউ দিয়েছেই। নিজের কানে শুনেছি। আপনি বলছেন ফেরিওয়ালা গাল দেয়নি। সেক্ষেত্রে আপনাকেই সন্দেহ করছি। আপনিই গাল দিয়েছেন। আপনিও চলুন থানায়। এই মওকাই চাইছিলেন ডাক্তারবাবু। থানায় হাজির হল তাহলে তিনজন।
দারোগাবাবু ডাক্তারবাবুকে চিনতেন। এঁরা সুশীল জন। বোঝালে বোঝেন। বললেন আপনাকে চিনি। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিচ্ছিনা। কিন্তু ফেরিওয়ালাকে আটক করছি। কালকে আদালতে দাখিল করব। আপনাদের তো কিসব মানবাধিকার সংগঠন আছে শুনেছি। আইন তো আছে। লড়ুন আইনমাফিক ।
থানায়/ গারদে
প্রথমে ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে ছিল ফেরিওয়ালা। দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি কখনো তাকে গরাদে রাত কাটাতে হতে পারে। মনমরা ভাবটা কেটে গেল যখন দুপুরের ভোজন এল। নিখরচায়। এই প্রথম সে কামাইয়ের পয়সায় খাচ্ছে না। রাতেও তাই।তবে আরাম ঠাহর হল আরো রাতে। সে থাকে বস্তিতে। গরীবের ছাউনি, ভাঙ্গাচোরা। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে শীতের বাতাস ঢোকে। এখানে পাকাপাকি প্রাচীর। বেশ গরম কিন্তু। তারপর সে এটাও লক্ষ্য করল তাকে পাহারা দিচ্ছে একজন সেপাই। সে কি তাহলে কেউকেটা কিছু? এই যে তাকে এত যত্ন করে রাখছে, খাওয়াচ্ছে, তার ওপর পাহারা দিচ্ছে একজন। আহা, ওই সেপাই তাকে পাহারা দিচ্ছে বলেই না মাইনে পাচ্ছে। মাইনে পাচ্ছে বলেই না খেতে পাচ্ছে। সে একা না, তার পরিবার। ভাবতে ভাবতে সুখের ঘুম নামল চোখে।
আদালতে
আদালতে যখন কাঠগড়ায় দাঁড়াল ফেরিওয়ালা সে তখন যাকে বলে অভিভূত। শুধু সেপাই না, ওই কালো গাউনের জজসাহেব, উকিলবাবু, এত অফিসবাবু। মুনসেফ আর রক্ষীরা এঁরা সবাই, এঁরা সব্বাই, সে বুঝে গেছে তাকে বিচার করেই মাইনে পাবেন। মানে জজসাহেব খেতে পাবেন। তাঁর পরিবার খেতে পাবেন।
জজসাহেব যখন প্রশ্ন করলেন—তুমি কি পুলিশকে গালি দিয়েছিলে? বেজন্মা বলেছিলে?
এত মানী মানুষ কথা বলছেন তার সাথে। তার সাতপুরুষের ভাগ্যি। সে বিনয়ে গলে গেল। বলল – হ্যাঁ, হুজুর।
ডাক্তারবাবু বাধা দিলেন – আনপড় মানুষ হুজুর। ঘাবড়ে গিয়ে ভুল বকছে।
জজসাহেব বললেন – আপনার বয়ান নেওয়া হবে।
রায়
জজসাহেব রায় দিলেন। প্রথমে বললেন মামলাটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ। গালিগালাজের মামলা। কিন্তু সহজ নয়।কারণ মামলা পুলিশ বনাম এক ফেরিওয়ালার। পুলিশ কার প্রতিনিধি? রাষ্ট্রের। তাহলে মামলাটি আসলে রাষ্ট্র বনাম এক সাধারন নাগরিকের। পুলিশ যখন ব্যক্তি, সে ভুল-ত্রুটির অধীন। কিন্তু পুলিশ যখন উর্দি পরিহিত, যদি প্রমান হয় সে অন্যায় করেছে, আমাদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার রাষ্ট্রীয় পিলার ধ্বসে পড়ে। ফেরিওয়ালা দোষ স্বীকার করে আমাদের স্বস্তি দিয়েছে। ডাক্তারবাবুর বয়ান নিচ্ছি সে হয়তো বেজন্মা বলানি। কিন্তু গালি দিয়েছে কবুল করেছে নিজে। সবদিক বিবেচনা করে তাকে একহপ্তার কারাদন্ড দেওয়া হল ।
জেলখানায়
জেলখানায় ফেরিওয়ালা মস্তিতে কাটাল। সাতদিন বাদে মুক্তি পেল। ফেরত পেল তার ভ্যানগাড়ী আর হাতখরচের কিছু টাকা। সে এখন কিনা না খেটে খেতে পাওয়ার, আরামের হদিশ জানে। বাইরে এসে ভ্যানগাড়িটাও বেচে দিল। মদ খেল দেদার। তারপর?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল এক ট্রাফিক পুলিশ। তার কানের কাছে গিয়ে সজোরে বলল–এই, বেজন্মার বাচ্চা।
পুলিশটি, কি আশ্চর্য, মনে হলো শুনল না কিছুই, মানে পাত্তাই দিলনা তাকে।
অতএব আর একবার কানের কাছে সরবে চেঁচিয়ে বলল—শুনতে পাচ্ছ না? আমি তোমায় বেজন্মার বাচ্চা বলছি ।
তাকে এককথায় স্তম্ভিত করে , থামিয়ে দিয়ে, পুলিশ বলল—ছি ! কর্তব্যরত পুলিশকে কি গালি দিতে আছে? ছি !
পুনকথন: পার্থ বসু
Rohit, Please send your write up to indicpub@gmail.com.