ভুলের মাহাত্ম্য / পার্থ বসু

ভুল নিয়ে লেখার প্রস্তাব পেতেই এক কথায় লুফে নিয়েছি। কারন ভুল করার সহজাত প্রবণতা আছে আমার। আমি যা বলি ভুল। যা করি ভুল। বলে সব্বাই। বলে নরলোক। বাড়িয়ে বলছি না। বাড়িতেও এ অভিযোগ শুনতে শুনতে আমিও এখন বিশ্বাস করি কথাটা। সেই বিশ্বাস সেই প্রত্যয় থেকেই কলম ধরলাম।

আজীবন ভুল জমতে জমতে পাহাড় বানিয়েছি। যদি লিখে রাখতাম! আগাপাশতলা মনে করে তবে না লিখব? ভুলে বসে আছি অনেক কিছুই। ক্রম। এটাও ভুল।

10 Common Mobile Advertising Mistakes You Should Avoid

ইংরেজি করে বললে আজকের বাঙ্গালীরা সহজে বোঝেন। তাই বলি। একটা ভুল হল mistake (noun or verb), আরেকটা ভুল forget (verb).

এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা তা ভুল। ছোটবেলায় শোনা একটা জনপ্রিয় গানের লাইন। সবটা মনে নেই। মানে ভুলে গেছি। কবি নজরুলের একটি লাইনও মনে পড়ছে– সবাই যখন বুদ্ধি যোগায় আমরা করি ভুল। মানে? একা না করে অনেকে মিলে ভুল করলে তা মান্যতা পায়? বৈধ ?

ভুল বকছি? তা হলে একটা গল্প শুনুন। গল্পটা মহর্ষি ব্যাসদেবের। মহাভারতে আছে। সেই যে বনবাস পর্বে পাণ্ডবেরা তৃষ্ণাকাতর। সেই যে জলের খোঁজে একা একা একে একে চার ভাই গেল তো গেল। ফেরার নাম নেই। এবার অকুস্থলে যুধিষ্ঠির। দীঘির ধার। চার ভাই মড়ার মত পড়ে আছে। কেউ মারল? কে? দেহে আঘাতের চিহ্ন নেই। জলে বিষ? জল পান করতে গিয়ে মরল? এও কি দুর্যোধন শকুনির আর এক চাল? তেষ্টায় বুক ফাটছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে— যুধিষ্ঠিরও – জলে নামবেন–

দৈববাণী!

বক্তা দীঘির মালিক বক , যক্ষ। – আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এ জল নিতে গেলে তুমিও মরবে যুধিষ্ঠির। তোমার ভায়েদের মত। এই নিয়ম না মানার ভুলে ওদের কি হাল তা তো দেখছই। আগে আমি কিছু সওয়াল করব। তুমি জবাব দাও।

যুধিষ্ঠির ভুল করেন নি। বকবক করে বককেও সন্তুষ্ট করে নিজে বাঁচলেন , ভায়েদের বাঁচালেন। বক আর যুধিষ্ঠিরের আলাপপর্ব ব্যাসদেব পুরোটাই শুনিয়েছেন। মহাভারতে। আমি ভুল অংশটুকু শোনাই।

বক প্রশ্ন করলেন –মানব জীবনের প্রধান সত্য কি?

যুধিষ্ঠির বললেন– মানুষ ভুল করে। বারবার ভুল করে। শেখে না। শিখতে চায় না।

বাকি কথাবার্তা আগ্রহীরা আবার পড়ে নেবেন। এই ভুল অংশে আমরা ভুলের দর্শনটিকে পেয়ে গেলাম।

ভুল করা স্বাভাবিক। মানুষের স্বভাব। ইংরেজিতেও কথা আছে== to err is human. তর্ক উঠতে পারে

মানুষ তা হলে ভুল থেকে শেখে না? শেখে। আরও ভুল করতে শেখে। এই ভুলটা শোধরায়। করে বসে আর একটা ভুল। নতুন ভুল।

একটু নিজের কথা বলি। নিজের ঢাক পিটানো নয়। ভুল কিন্তু সতর্ক থাকলে এড়ানো যায়। আমি অন্তত একবার দুর্বার চেষ্টা করেছিলাম। সেই গল্প। কোন এক রামবাবুর নামে বলা যেত। পাঠক ভাবতেন ভুল  তাপ্পি দিচ্ছি। সত্য ঘটনাটি তরল হয়ে যেত।

ডাক্তার দেখাতে মফঃস্বল থেকে শহরে গেছি। বউকে নিয়ে। ওনাকে ডাক্তার দেখাব। ভুল করব না বলে

১) আগে থেকে নাম লিখিয়েছি

২)আগেভাগে পৌঁছে গেছি

৩)আগেই ফী জমা করেছি

ভাগ্যিস! এত করেও লাইনে আমার নাম মানে বউএর নাম বারোয়। নাম ডাকতেই দ্রুত চেম্বারে ঢুকলাম। ডাক্তার প্রথমেই বললেন কতগুলো প্যাথোলজিকাল টেস্ট করে আসতে হত!

আতঙ্কে বললাম – অনেক দূর থেকে আসছি। আজকেই পরীক্ষাগুলো করা যায়?

ডাক্তার আশ্বাস দিলেন– ব্লাড দিন। এক্স রে রিপোর্ট , মানে রিপোর্ট না, ফিল্মটা এখুনি নিয়ে আসুন। ভাবুন আমার অবস্থা।একবার বার হলে আবার পিছনে পড়ব।ও ভুল করব না হারগিস। ন্যাড়া বেলতলায় যাবে না এবার। ডাক্তারকে বললাম আপনি রোগিণীকে দেখুন। আমি আসছি। বউকে বললাম তুমি কথা বল ডাক্তারবাবুর সাথে। আমি গিয়ে তোমার এক্স রে করিয়ে আনছি। 

পছন্দ হল না? শেখা গেল না কিছু? ধর্মপুত্র কি সাধে বলেছেন— মানুষ শেখে না। শিখতেও চায় না। 

আরে মশাই। ভুল করা নাজাজ নয়। কিন্তু ভুল করে পস্তাবেন না? অনুশোচনা? এ কেমন কথা! আক্ষেপ  শুধু মানুষ করে তা নয়। মনুষ্যেতর প্রাণীও হা হুতাশ করে। বিশ্বেস হচ্ছে না? ঝিনুক ঘেঁটে মুক্তোর সুলুক দিচ্ছি না। গুগলি , থুড়ি, google ঘাঁটুন। মিননেসোতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় চোখ রাখুন। ভুল করে পস্তায় এমন কি ইঁদুর!  

সুতরাং ভুল করুন। পস্তান। আবার ভুল করুন। সাহস দিতে নীচের চার লাইন—

                        ভূল করেছি বেশ করেছি

                         ভুল কি কারো কেনা?

                        ভূলের আমি ভুলের তুমি

                         ভুল দিয়ে যায় চেনা।

কথক ভুল ভারতবর্ষের ভুল আসামের শিলচরের মানে ঈশান বাংলার প্রয়াত কবি বিমল দেব। সুকুমার রায়ের গন্ধ পেলেন? এটা ভুল না। ঠিক। তো সুকুমার রায়ের ভুল গল্প শিরোনামের গল্পটি আর  একবার পড়ে ফেলুন। রায় মশাই গোড়ায় গেয়েছেন গল্পে ভুল আছে। আছে কিছু যা অসম্ভব। পাঠক পারলে খুঁজুক। না পারলে সমাধান শেষে।

মানুষ তা হলে ভুল করবে এটা নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম থাকতে হবে। exception proves the law. ব্যতিক্রম কে বা কারা? বলে নিই।

আবার ইংরেজি প্রবাদের শরণ নিচ্ছি। রাজা। রাজা নির্ভুল। King cannot commit a mistake. এখন রাজার ভুমিকায় নেতা। নেতার সংজ্ঞাই তো বলছে যিনি প্রতিশ্রুতি দিতে সক্ষম এবং প্রতিশ্রুতি পালনের ভুল না করে বোঝাতে সক্ষম কেন তা পালন করা গেল না তিনিই নেতা। নেতাও কখনও ভুল করেন না। মন্ত্রী যা বলেন তাও নির্ভুল বলে বিশ্বাস করতে হয়। আসলে মুস্কিল বাধাই আমরাই। আমজনতা। আমরা আইন জানি না। সংবিধান জানি না। ফলে অনাহারে মরি। মন্ত্রী জানেন এটা সংবিধান বিরোধী। তিনি দয়ালু। তাঁকে বলতেই হয় –

                          না খেয়ে লোক মরে না

                          কেন না মন্ত্রী বলেন।

                          মরে যে রোজই দেখি

                          মরে যে রাস্তা ঘাটে

                          মরে যে———  —

                          না না না না

                         আরে রে মন্ত্রী বলেন

                         শুনে তোর পেট ভরে না! (বীরেন চট্টোপাধ্যায়)

সুধী পাঠককে আনাতোলা ফ্রাঁ-র প্যারী শহরের ফেরিওয়ালা গল্পটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। ঠেলাওয়ালার কাছে ঘুষ চেয়ে এবং না পেয়ে অপমানিত পুলিশের তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়ার গল্প। নেই কাজ তো খই ভাজ সুধী সমাজের প্রতিনিধি ডাক্তারবাবুর থানায় গিয়ে প্রতিবাদ করার গল্প। দারোগা বাবুর তাঁকে এই বলে সামলানোর গল্প– আদালত বিচার করুক। আদালতের দায় ছিল এটা প্রমান করা  ব্যক্তি পুলিশ ভুল করতে পারে। কিন্তু উর্দি গায়ে সে রাজপ্রতিনিধি। নির্ভুল।

কবিগুরুর কথাও বলে নি। নইলে মহা পাপ হয়ে যাবে। ভুল।

                          যাহা পাই তাহা ভুল করে চাই

                          যাহা চাই তাহা পাই না।

আর একটু বিস্তারে যাই। আমাদের সভ্যতা এই যে এগিয়েছে (?) তাতেও ভুলের অবদান কম নয়। ভুল থেকে হওয়া কয়েকটি আবিস্কারের কথা শোনাই। ইতিহাস ভূগোলে যাচ্ছি না। আমেরিকা খুঁজতে গিয়ে কলম্বাসের ভুলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিস্কারের কথাও না। আমরা দু একটি বিজ্ঞান আর ব্যবহারিক আবিস্কারের কথা শুনব।

স্যাকারিন  – ভেনু জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষক ফলবার্গ। Fahlberg। বিষয় এক খটমট নামের রাসায়নিকের মতিগতি। জারণ প্রক্রিয়া। oxidation. যৌগটি ও-টলুইনসালফোনামাইড । কাজ করতে করতে তুমুল খিদে পেয়েছে ফলবার্গের। পেটে ডন দিচ্ছে ইঁদুর। তর সইছে না। ফলবার্গ বেমালুম হাত না ধুয়েই—- । রুটি হাতে নিয়ে কামড় দিয়েই বুঝলেন রুটি মিষ্টি লাগছে। মনে পড়ল পরীক্ষার সময় হাতে একটি কেমিকাল পড়ে গেছিল।

ফলবার্গ পেটেন্ট নিতে দেরী করেন নি।

পেনিসিলিন — সব্বাই জানি ওষুধটি আবিস্কার করেছিলেন স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।

মজার কথা হল ফ্লেমিং খুঁজছিলেন আশ্চর্য বটিকা। সব রোগের দাওয়াই। হতাশ। যখন কিনা হাল ছাড়ার মুখে—

হঠাৎ ফেলে দেওয়া মিশ্রণের একটি বাতিল পাত্রে মণ্ডটি চারপাশের ব্যাক্টিরিয়া শুষে নিচ্ছে। খোঁজ খোঁজ।

আবার তৈরি করলেন মণ্ডটি। মানে পেনিসিলিন।

মাইক্রোওয়েভ  চুল্লী– Raytheon corporation. রেথিওন না রেথিঁও ? উশ্চারন নিয়ে এই রচনায়  মাথা ঘামাচ্ছি না। ভুল মার্জনীয়। ল্যাবরেটরিতে নতুন ভ্যাকুয়াম টিউব তৈরির কাজে লেগেছেন পার্সি স্পেন্সার। ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর গবেষণা রাডার নিয়ে।

কাজ করতে করতে স্পেন্সার খেয়াল করলেন তাঁর পকেটে রাখা ক্যান্ডি গলে যালেরচ্ছে। আধখাওয়া ক্যান্ডি ভুল করে পকেটে রেখেছিলেন স্পেন্সার।ভাগ্যিস!

কিছু একটা আন্দাজ করলেন তিনি। মেসিনে কিছু পপ কর্ণ রাখলেন। ভুট্টা ভেজে খৈ। বুঝে গেলেন আবিস্কারে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে বসেছেন।

বাজী— সে প্রায় ২০০০ বছর আগের কথা। গল্পটা চীনদেশের। নায়কের নাম জানা যায় নি। লোকশ্রুতি বলছে এক রাঁধুনির ছিল অদ্ভুতুড়ে নেশা।বিদঘুটে আর ভুলভাল। এই নেশায় ভুলভাল মশলা মেশাত। এটার সঙ্গে ওটা। ওটার সঙ্গে এটা। মশলা মানে যা পেত তাই। রান্নাঘরে। টান্নাঘরে।

রাঁধুনি সেদিন কিনা মশলাটিকে পিষছিল। ফাঁপা এক বাঁশের লাঠি। লাঠির পেটে।

লাঠি ফাটিল।

পটাটো  চিপস—- রেস্তোরাঁর নাম কেরি মুন লেক হাউস। সারাটোগা স্প্রিংস। জর্জ ক্রাম তার নামজাদা শেফ। গোদা বাংলায় বামুনঠাকুর। মুখ্য পাচক।

খদ্দের একপ্লেট আলুর চিপস চেয়েছেন। ওয়েটার ফেরত নিয়ে গেল। পছন্দ হয় নি। আর একটু সরু। আর একটু পাতলা চাই। আবার পাতলা করে কেটে আলু ভাজা হল। এবারও ফেরত গেল। আরও পাতলা , আরও। কিছুতেই মন ভরছে না খদ্দেরের। 

রেগে কাঁই ক্রাম সাহেব। মহা খাপ্পা। এবার পাগলের মত নিজেই পাতলা পাতলা মিহি করে টুকরো করলেন পটাটো। কড়া করে ভাজলেন। শ্রীমানকে একটু শিক্ষা দেওিয়ে  দরকার। কোথায় খাপ খুলেইয়ে শিবাজী! ক্রামের কাজে তামাশা!

ওয়েটার প্লেট নিয়ে গেল। ততক্ষনে ক্রাম সাহেবের রাগ জুড়িয়ে জল। কি ভুল করে বসলেন উত্তেজনায়।

খদ্দের লক্ষ্মী। কিন্তু চটিবেক!

ও হরি! খদ্দের চেয়ে বসলেন আরও।

এবার বরং দাঁড়ি টানি। তার আগে আর একটি গল্প। অজিতেশ তখন বেঁচে। নাটকের নাম তিন পয়সার পালা। আছেন রুদ্রপ্রসাদ, কেয়া চক্রবর্তী। মহীন ডাকাত তার দুই রমণীকে নিয়ে স্টেজে। দুই নারী দুপাশে। দুজনেই জানতে চায় কাকে ভালবাসে মহীন। মহীন একবার এর কানে আর একবার ওর কানে এক কথাই আউড়ে গেল– মধু ছেড়ে কেউ গুড় খায়? মহীন ডাকাত মানে অভিনেতা অজিতেশ হঠাৎ মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে তার আচরণের সমর্থনে চাণক্য কি বলেছেন দ্রুত বলে চললেন। বলতে বলতে সহসা থেমে গলা নামিয়ে স্বগতোক্তি করলেন—  চাণক্য বলেছেন তো ! কণ্ঠে সংশয়। তার পরেই গলা চড়িয়ে ঘোষণা করলেন— না বললে বলা উচিৎ ছিল।

অনুসন্ধিৎসু পাঠক ধর্মরাজ বক ও ধর্মপুত্রের ডায়ালগে যদি এই নিবন্ধে উল্লিখিত প্রশ্ন খুঁজে না পান বা অন্য পাঠ পান সে ভু্ল আমার নয়। ভুল বক অথবা ব্যাসদেবের। হয় ভুল করে প্রশ্নটি করা হয় নি। অথবা ব্যাসদেব টুকে রাখতে ভুলে গেছিলেন।

ভুল হয়। করার থেকেও বড় কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *