আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়

সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেছেন। বিগত ছয়মাস ধরে মানসিক অবসাদের চিকিৎসাধীন ছিলেন, তার মধ্যে কোভিড ১৯ জন্য তিনমাস গৃহবন্দী। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৪ বছর। প্রেম, খ্যাতি, অর্থ, শিক্ষা কিছুর অভাব ছিলনা৷ আড্ডাবাজ, অসাধারণ ফিট, বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ে টপার থেকে মুম্বাইয়ের তারকা। দেশের কোটী কোটী মেয়ের নয়নের মনি। এ কেমন হল? কেন নিজের জীবন শেষ করে দিল। কেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা হল?

ছেলেটার মুখে সব সময় এত হাসি। হাশির পেছনে এত দুঃখ ছিল ? সবাই কারণ খুঁজতে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। কেউ বাঙ্গালী প্রেমিকাকে দায়ী করছেন, কেউবা বলিউড ফিল্ম জগতের দ্বিকে আঙ্গুল তুলছেন। তবু কোনটাই এর ঠিক কারণ হতে পারে না। সুশান্ত সিং রাজপুত নিজে ‘ছিছোড়ে’র মত ছবিতে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে এক অসাধারণ কাহিনী শুনিয়েছিলেন। আত্মহত্যার কারণ সবসময় খুব ব্যাক্তিগত।এ যেন – 

নারীর হৃদয় – প্রেম -শিশূ – গৃহ- নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় –

আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে;

ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;

সুশান্ত সিং রাজপুত

{নিচের অংশটি আমাদের পুরানো একটি লেখার থেকে সংগৃহীত।}  

ডিপ্রেশন, বা মানসিক অবসাদ তাহলে কী?  – একজন মানুষ যিনি দুঃখিত হয়ে আছেন ধারাবাহিকভাবে। অন্তত দুহপ্তা ধরে এই অবসাদ থাকলেই তাকে ডিপ্রেশন বলা চলে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে গেলেও যার দুঃখের দিন আর পাল্টায় না। যেখানে কালো মেঘের পর আরও কালো মেঘ ঘনিয়ে আছে মনে। এমনটা হলে যে কেউ হারিয়ে ফেলবেন তাঁর কাজের ক্ষমতা। তিনি যদি আগে চনমনে আর সজীব একজন মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে এখন তাঁকে দেখাবে প্রায় জড় পদার্থের মতোই। কারণ কোনওকিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। তিনি হয়তো অনেক ঘুমোচ্ছেন কিংবা ঘুমোচ্ছেন কম। মনোযোগ নেই। অপরাধবোধে ভুগছেন। আর মনে হচ্ছে সামনে পথ নেই। আশা নেই। এককথায় তাঁর সবকিছুই বিচ্ছিরি লাগছে। এই মানুষটি কিন্তু এখন ভাবছেন কীভাবে মরে যাওয়া যায়, আত্মহত্যার কথা।

কিন্তু কেনই বা এমন হবে। এই পৃথিবীতে যে-কটা দিন বাঁচা যায়, সবকটা দিনই উৎসব। সবদিনই রোদ এসে জানলায় বসে। সামান্য মাটি থেকে পাখি উড়ে যায় আকাশে। এইসবের ভেতর কেন মৃত্যু ডেকে আনা? তার চেয়ে ডাক্তার দেখান। মনোবিদের সাহায্য নিন। শরীরের অসুখ হলে শরীরের ডাক্তার, আর মনের হলে মনের ডাক্তার কেন দেখাবেন না? আমার তরফ থেকে কয়েকটি তথ্য রইল, যা হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারে:

১. অবসাদ সব মানুষেরই হতে পারে। যে-কোনও দেশের মানুষের, যে-কোনও বয়সের মানুষের। সুতরাং ভেঙে পড়ার কিছু নেই।

২. অবসাদ বাড়তে পারে টাকাপয়সার অভাবে। চাকরি না পেলে। প্রিয় কেউ হয়তো মারা গেলেন, হঠাৎ। প্রেম ভেঙে গেল। শারীরিক অসুস্থতা কিংবা যে কোনওরকম নেশা থেকেও অবসাদ আসতে পারে।

৩. প্রতিদিনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে ডিপ্রেশন। খুব সাধারণ ছোটোখাটো কাজই আর করতে পারে না অবসাদ আক্রান্ত মানুষ।

৪. অবসাদের চিকিৎসা না করালে মুশকিল, কারণ সাংসারিক ও সামাজিক জীবন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এতে। কাজের জায়গায় হোক, কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবসাদ মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলে।

৫. অবস্থা যখন সঙ্গিন, অবসাদ মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ করে আনে।

৬. অবসাদ অবশ্যই ঝেড়ে ফেলা যায়। মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে সেইজন্য। ওষুধ খেয়ে কিংবা কথা বলেই চিকিৎসা হতে পারে। এই দুই পদ্ধতি মিলেও হতে পারে চিকিৎসা।

৭. একবার এই অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারলে পথ অনেক সহজ হয়ে যায়। তখন অবসাদ কাটিয়ে ওঠা মানুষ অন্য একজন অবসাদগ্রস্ত মানুষকেও সাহায্য করতে পারবেন।

৮. অবসাদ কাটাতে সবার আগে কথা বলুন খুব কাছের কোনও মানুষের সঙ্গে। তাঁকে খুলে বলুন আপনার মনের কথা। দেখবেন হালকা লাগবে আপনার। এটা কিন্তু অবসাদ কাটানোর প্রাথমিক উপায়।   

সম্প্রতি ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স সম্মিলিতভাবে একটি সমীক্ষায় দেখেছেন ভারতের বহু মানুষই ভুগছেন অবসাদে। প্রতি ২০ জন ভারতীয়র মধ্যে ১ জন সারাজীবন অনুভব করেন এই বিষণ্ণতা। এই মুহূর্তে প্রতি ৪০ জনের মধ্যে ১ জন ভারতীয় আক্রান্ত হচ্ছেন ডিপ্রেশনে। আর একটি দুঃখজনক তথ্য, ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ডিপ্রেশন।     

আশার কথা, আগের বছর ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস থেকেই একটি ক্যাম্পেন-এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুলে, কলেজে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, প্রিন্ট মিডিয়ায় ডিপ্রেশন নিয়ে বহু চর্চা চলবে আগামী এক বছরে। এছাড়া নানা সেমিনারের কথাও ভাবা হবে। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা অফিস কলিগদের সঙ্গে কথা বলে যদি কোনও উপায় বার করা যায় সে চেষ্টাও করা হবে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য তাঁরা স্লোগান বানিয়েছেন। তা হল, ‘ডিপ্রেশন: লেটস টক্‌’। ডিপ্রেশন যেহেতু সবারই হতে পারে, তা কাটানোর জন্য কথা বলা হবে মেয়ে কিংবা ছেলে, তরুণ কিংবা অশীতিপর—সবার সঙ্গেই। বয়ঃসন্ধি এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কে বিশেষভাবে নজরে রাখছে এই ক্যাম্পেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে গর্ভধারণের সময়কাল। এছাড়া ষাটোর্ধ্বদের কথা ভেবেও বিশেষ প্রচার করা হবে।

সুতরাং, চুপ করে থাকবেন না মনখারাপে। মনখারাপকে ধারাবাহিক করে ফেলবার আগেই কথা বলুন। কথা বলুন এমন কারও সঙ্গে যে আপনার খুব কাছের। খুশি থাকুন। আপনার বন্ধুটির মধ্যে অবসাদ জমছে এমন আন্দাজ করতে পারলে তাঁকে ঝাঁকিয়ে দিন। কথা বলতে বলুন। হ্যাঁ, কথা বলাই ওষুধ। নিজের দুঃখকে কথায় অনুবাদ করতে পারলেই কেটে যাবে অবসাদ। তারপরে তো মনোবিদরা আছেনই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *