কালো জীবন মূল্যবান, আমাদের কাছেও

তিন সপ্তাহ হয়ে গেল এই আন্দোলনের। থামার এখনো কোন নাম গন্ধ নেই। জর্জ ফ্লয়েড মারা গেছে পুলিশের হাতে মে মাসের ২৫ তারিখ। আজ ১২ ই জুন। আমেরিকার ৫০ টা স্টেট একসাথে বিক্ষোভে সামিল। দাবী তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে – আমাদের চাই ন্যায়বিচার – “We Want Justice”। এই আন্দোলেন সাথে আমাদের – ভারতীয় বা বাংলাদেশীদের সম্পর্ক অনেকদিনের। বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ থেকে যখন আমাদের আমেরিকায় আশা শুরু হয় তখন থেকে। জিম ক্রো’র আমেরিকায় আমরা কৃষ্ণাঙ্গ। স্বাধীনতা সংগ্রামী রামমনোহর লোহিয়া কে পুলিশ গ্রেফতার করে ১৯৬৪ সালে শ্বেতাঙ্গদের হোটেলে ঢোকার জন্য। তিনি তখন ভারতের পার্লামেন্টের সদস্য। তাতেও অ্যামেরিকার পুলিশের কোন দ্বিধা হয়নি তাঁকে গ্রেফতার করতে। স্বাধীনতা সংগ্রামী কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় কে লাঞ্ছিত হতে হয় আমেরিকায় বর্নবাদীদের হাতে। তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন NAACP (National Association for the Advancement of Colored People) র আমন্ত্রণে। 

আজকের আন্দোলনে তাই যখন রুহেল ইসলাম ( মিনিয়াপলিস শহরে গান্ধী মহল নামক রেস্টুরেন্টের মালিক) বলে ওঠেন ‘আমার রেস্টুরেন্ট পুড়ুক – আমাদের চাই ন্যায়বিচার’ তখন আমরা বুকে আশা বাঁধি যে সুদিন আসছে। আপনারা অনেকেই হয়ত গান্ধী মহল রেস্টুরেন্টটির গল্প শুনেছেন। ডেরেক শোভিন যে পুলিশ ফাঁড়ীতে কর্মরত ছিলেন তার থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এই রেস্টুরেন্টটি। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে গান্ধী মহল আন্দোলনকারীদের টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচার নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। সেফ রুহেলভাই আন্দোলনকারীদের ডাল ভাত খাবার ব্যাবস্থা করেন নিজের রেস্টুরেন্টে। ২৮ শে মে রাতে যখন বাড়ীটিতে আগুন লেগে যায় তিনি তখনও একমুহুর্ত দ্বিধা করেননি আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াতে।


রুহেল ইসলাম, হাফসা ইসলাম এবং গাই ফিয়েরি – মিনিয়াপলিস শহরে গান্ধী মহল রেস্টুরেন্ট – Source Facebook

একইরকম ভাবে বুক ফুলে ওঠে যখন রাহুল দুবে নিজের বাড়ি খুলে দেন ৭০ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাই আমাদের স্বপ্ন বেড়ে যায়। মাথার মধ্যে অঞ্জন দত্তের গান ঘুরতে থাকে —

সুদিন আসবে বলে তাই
আমরা স্বপ্ন দেখে যাই…

এদেশের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের টার্গেট করে পুলিশি বর্বরতার চারপাশে বড় গল্পের মধ্যে এইগুলি অনেক ছোট ঘটনা , তবু দক্ষিণ এশীয়দের কাছে এই ঘটনাগুলি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এই গল্পগুলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা সবাই একই পৃথিবীর, একই দেশের মানুষ।  আমাদের বুঝতে শেখায় পুলিশিংয়ের পদ্ধতিগত ব্যর্থতাগুলি। শেখায় আমাদের একজোট হয়ে লড়াই করা সম্ভব – কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের। 

শুধু কৃষ্ণাঙ্গ কেন, আমাদের ন্যায়বিচার চাই সুরেশভাই প্যাটেলের ওপর হওয়া পুলিশি অত্যাচারের। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন সুরেশভাই। ছেলের বাড়ির সামনে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি ম্যাডিসন নামক একটি শহরে। বর্নবিদ্বেষী এক প্রতিবেশী পুলিশে ফোন করেন এক কালো মানুষকে নিজের বাড়ির সামনে দেখে। অফিসার এরিক পার্কার ঘটনাস্থলে পৌঁছে সুরেশভাইকে গ্রেফতার ও আত্যাচার করে কৃষ্ণাঙ্গ বলে। সুরেশভাই সেই আত্যাচারের ফলে প্যারালাইসড হয়ে যান। কিন্তু পুলিশ অফিসারটি যথারীতি ছাড়া পেয়ে যান। এরিক পার্কার এখনো পুলিশে কর্মরত। পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই বিষয়ে আনা ৩ টি কোর্ট কেস খারিজ হয়ে গেছে। তবু সুরেশভাই এর ছেলে আশা ছাড়েননি। ২৭ শে মে ২০২০, ১১ তম আপিল কোর্ট রায় দিয়েছে – মেডিসন পুলিশ অফিসার এরিক পার্কার এবং ম্যাডিসন সিটির বিরুদ্ধে দায়ের করা নাগরিক অধিকারহানীর মামলা এগিয়ে যেতে পারে। 

তবু এই সব আভিজ্ঞতার সাথে সবাই একমত হননা। অনেক দক্ষীণ এশীয় আছেন যারা বর্ণ বৈষম্যের সিঁড়িটি ধরে নিজেদের সাদা রঙের মর্যাদায় পৌঁছানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। আন্দোলনকারীদের এরা লুটেরা বলে চিহ্নিত করেন আর নিজেদের মডেল সংখ্যালঘু হিসাবে ভাবতে পছন্দ করেন। অনেক দক্ষীণ এশীয় আছেন যারা অভিবাসনবিরোধী নীতি সত্ত্বেও বর্তমান প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। তাঁদের জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম আজ এইরকম একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছে। শুধু তাঁদের জন্য কেন এই চিঠি আমাদের সবার জন্য। সময় নিয়ে একটু পড়ে দেখুন। নিচের লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন –

প্রিয় মা, বাবা, আংকেল, আন্টি: কালো জীবন মূল্যবান, আমাদের কাছেও।

One comment on “কালো জীবন মূল্যবান, আমাদের কাছেও
  1. আশিস says:

    অনেক অজানা কথা জানলাম। জরুরী কথাগুলো সহজে লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ!
    আজ যখন মানুষ একদিকে মঙ্গলগ্রহে বাস করার কথা ভাবছে তখন আরেকদল মানুষ গায়ের চামড়ার রং দেখছে! লজ্জার!
    তবুও আশা বাঁধে বাসা – সুদিন আসার অপেক্ষায়, একদিন নয় একদিন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *