দড়ি ধরে মারো টান..স্ট্যাচু হবে খানখান..

স্ট্যাচু ভাঙার মরশুম চলছে। ইংল্যান্ডের ছোট্ট একটি ছবির মত শহর ব্রিস্টল। সেখানে এই মরশুমের প্রথম স্ট্যাচুটি স্তম্ভমূল থেকে অ্যাভন নদীর গর্ভে আশ্রয় নেয়। স্ট্যাচুটি ছিল এডয়ার্ড কলস্টনের। মিঃ কলস্টনের ইতিহাসটি খুব সুবিধার নয়। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য ও ব্রিস্টলের অন্যতম ধনী। কিন্তু তার পয়সা এসেছিল ক্রীতদাস ব্যাবসার মাধ্যমে। কথিত আছে যে তিনি মাত্র ১২ বছরে ৮৪ হাজার ক্রীতদাস বেচেছিলেন। 

আজ সকালের খবর – সান ফ্রানসিস্কোতে অ্যামেরিকার ১৮ তম প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্রান্ট-র স্ট্যাচু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এতদিন জানতাম প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস এস গ্রান্ট ইউনিয়ান আর্মির জেনারেল ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বেই জয় এসেছিল কনফেডারেট স্লেভ মালিকদের বিরুদ্ধে। খবরটা পড়ে মনে খটকা লাগলো। এতদিন জানতাম তিনি ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে। ক্রীতদাস প্রথার বিরোধী। তাহলে এমনটা কেন হল? সেমসাইড গোল? ইউকীপিডিয়ায় খুলে পড়তে শুরু করলাম ওনার বিষয়ে। যা জানা গেল, তা শোচনীয়। উনি নিজেও ছিলেন স্লেভ ওনার বা ক্রীতদাসের মালিক। অ্যামেরিকার ইতিহাস এরকম একাধিক অসঙ্গতিতে পরিপুর্ন। অ্যামেরিকা প্রতিষ্ঠার দুই জনক জর্জ ওয়াশিংটন ও থমাস জেফারসন-ও স্লেভ ওনার ছিলেন। অথচ তাঁরাই অ্যামেরিকার সংবিধানে লিখে গেছেন “all men are created equal – সব মানুষের অধিকার সমান”।

Declaration of Independence, 1776

“We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable Rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness.”

Thomas Jefferson
The Declaration of Independence
Second Continental Congress
Philadelphia, Pennsylvania

অ্যামেরিকার অসঙ্গতির কথা আরেকদিন হবে। আজকে ফিরে আসি স্ট্যাচুর কথায় অথবা স্ট্যাচুর ভাঙ্গার কথায়। আজ ব্রিস্টল থেকে বাল্টিমোর, সান ফ্রানসিস্কো থেকে ব্রাসেলস গত এক সপ্তাহে একটির পর একটি স্ট্যাচু খোলা আকাশের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে। সরে যাছে সেইসব ব্যাক্তির স্ট্যাচু যারা ক্রীতদাস প্রথার সাথে যুক্ত ছিলেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্ট্যাচু – সান ফ্রানসিস্কো, ক্যালিফোর্নিয়া জুন ২০২০ – গুগল

এই ঘটমান বিষয়টি নতুন নয়, ইতিহাস খুঁজলেই দেখা যায় আবহমান কাল ধরে মুর্তি স্থাপন হচ্ছে আর মুর্তি ভাঙ্গা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস শুরু মুর্তি ভাঙ্গা দিয়ে। স্বাধীনতা ঘোষনার পাঁচ দিন পড় ১৭৭৬ সালে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের মুর্তি নিউ ইয়র্ক শহরে ভেঙ্গে ফেলা হয়। শুধু ভাঙ্গাই নয়, সেই স্ট্যাচু গলিয়ে আমেরিকান সেনা গোলা তৈরি করে ব্রিটিশ সেনাদের মারার জন্য। 

মুর্তি ভাঙ্গা গড়া নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়। বিজয়ীদল বীজিতদের পরবর্তী প্রজন্মকে এভাবেই নতুন ইতিহাস শেখায়। মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানরা প্রাচীন রোমের ভাস্কর্যগুলিকে ভেঙে দেয় পৌত্তলিকতা শয়তানের আবিষ্কার বলে। ভারতের বহু মুর্তি মধ্যযুগে মুসলিম আক্রমণকারীদের হাথে ধংস হয়েছে। মাহমুদ গজনীরর হাতে গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরের শিব মুর্তি থেকে কালাপাহাড়ের হাতে পুরীর জগন্নাথ মুর্তি অবধি ছাড় পায়নি। স্পেনীয় বিজয়ীরা অ্যাজটেক এবং ইনকাদের মন্দিরগুলি ধ্বংস করে তাঁদের বর্বর নরমাংসভোজী বলে। সাম্প্রতিকালে তালিবানরা বামিয়ান বুদ্ধের মুর্তি ধ্বংস করে বিধর্মী বলে, বা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা একই কারণে ধ্বংস করে সিরিয়ার ঐতিহাসিক নগরী পালমিরায় প্রাচীন স্থাপত্যগুলি। 

এই ধ্বংসাত্মক কাজটি কি ভাল? উপরের উদাহরনগুলি কোনটিই ভাল নয়। তবু সাধারন মানুষ কেন করে আসছে যুগের পর যুগ ধরে এই কাজ? বড় তফাৎ হচ্ছে যে ধ্বংসাত্মক কাজটি করছে কে। সাধারণ মানুষ যখন স্বতঃফুর্ত ভাবে এই কাজটি করে, তখন সাধারণত তা’করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নতুন অন্যায়ের জন্ম দেওয়ার জন্য নয়। কারণ এই প্রতীকী প্রতিবাদ আমাদের সামনে এক নতুন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত নিয়ে আসে।

কমিউনিজিমের শেষ দিনগুলিতে পুর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে স্টালিনের মুর্তির পতন হতে থাকে যা গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন বহন করে নিয়ে আসে। ইরাকে যখন সাদ্দাম হোসেনের মুর্তী ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয় বিশ্বব্যাপী মানুষ অন্যায় ও আপশাসনের অবসান হয়েছে বলে স্বস্তি পায়। 

তাই আজকে মুর্তি ভাঙ্গার এই উৎসব আমাদের কাছে এক নতুন ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল সম্বভবনা নিয়ে এসেছে। বৈষম্যহীন এক পৃথিবীর। তাই সাধারণ মানুষ ক্রীতদাস প্রথার সাথে জড়িত ও বর্নবিদ্বেষী সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের স্ট্যাচু ভাঙতে শুরু করেছে এক নতুন ইতিহাস লেখার জন্য। 

স্টালিন স্ট্যাচু – বুদাপেস্ট হাঙ্গেরি ১৯৫৬ – ছবি গুগল

নিন্দুকেরা বলছে – এভাবে কি ইতিহাস পাল্টানো যায়? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী  বরিস জনসন এই মুর্তি অপসারনের ঘটনাগুলিকে খুবই দুখঃজনক আখ্যা দিয়েছেন। ব্রিটেনে মুর্তি অপসারনের যে কোন প্রয়াসকে তিনি শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিহত করবেন জানিয়েছেন। তার যুক্তিতে মুর্তি অপসারন আমাদের কিছু শেখায়না। বিকল্প হিসাবে স্ট্যাচুগুলি আমাদের সামনে থাকলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল আর মন্দের ফারাক বোঝাতে পারি। তিনি ভুলে গেছেন যে স্ট্যাচুগুলি প্রতিস্থাপন হয়েছিল এইসব তথাকথিত কিংবদন্তী ব্যাক্তিদের আসামান্য আবদান স্মরণে রাখার জন্য। ক্রীতদাস প্রথার আসামান্য আবদান, বর্নবিদ্বেষের আসামান্য আবদান। 

মিঃ জনসনের যুক্তি মেনে নিলে তো বলতে হয় আমারা এতিদিনধরে অনেকগুলি অযৌতিক ও ভুল কাজ করে এসেছি। হিটলারের স্ট্যাচু, বা স্টালিনের স্ট্যাচু ভাঙ্গা খুব গর্হিত কাজ হয়েছে। 

নয়া দিল্লীর করনেশন গ্রাউন্ড, ১৯৯১, ছবি গুগল

ইতিহাসকে পাল্টে ফেলা যায়না। কিন্তু ইতিহাসকে নতুন আলোতে অনুধাবন করা যায়। আজকের এই স্ট্যাচু অপসারনের প্রচেষ্টা ইতিহাসের গর্হিত অপরাধগুলোর ওপর সঠিক মূল্যায়নের প্রচেষ্টা। এই স্ট্যাচু অপসারন ইতিহাসিক আত্যাচারের বিরুদ্ধে আধুনিক মূল্যবোধের এক তীব্র প্রতিবাদ। 

তাই স্ট্যাচু অপসারন চলতে থাকবে, কেপ টাউনে উপনিবেশিক সেসিল জন রোডস-এর স্ট্যাচু, ভেনেজুয়েলায় ক্রিস্টোফার কলম্বাসের স্ট্যাচু, হাঙ্গেরিতে স্টালিনের স্ট্যাচু, নয়া দিল্লীর করনেশন গ্রাউন্ডে ব্রিটিশ কলনিয়াল রাজাদের স্ট্যাচু, বা নর্থ ক্যারোলিনায় কনফেডারেট জেনারেলদের স্ট্যাচু। তাঁদেরই স্ট্যাচু অপসারন হবে যাদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ মানবিক মূল্যবোধের সাথে মেলে না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *