বুলবুল না বুলব্বুল (Bulbbul) একটু খটকা রয়ে গেল। হিন্দি ভাষার ছায়াছবি – নেটফ্লিক্স-এ নতুন এসেছে ও সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়েছে। ১৯ শতকের বাংলার পটভুমিতে গড়ে উঠেছে গল্পের শিকড়। গল্পটাকে ভুতুড়ে গল্প বলা ঠিক হবেনা। গল্পটির ধরন অনেকটা Supernatural Thriller। চোখের বালি, সাহেব বিবি গোলাম, চারুলতা আর তার সাথে তারীনীখুরোর রোমাঞ্চকর গল্প সব মিলে ব্যাপারটা বেশ জমে গেছে। অন্তর্নিহিত মূলভাব নারীবাদী (ফেমিনিস্ট)।
নিন্দুকের কমতি নেই। একদল বলছেন এই ছবির গল্প বলাতে বাণিজ্যিক ভাব বা কমার্শিয়ালাইজেশন বেশীমাত্রায়। বাণিজ্যিক ভাবে কোনও দোষ দেখতে পাচ্ছিনা। বাংলার থিম, গল্প, গান চিরকাল ধরেই অনন্যসাধারণ। কিন্তু তার সাথেই আমাদের চাই এর বাণিজ্যিক ব্যবহার। আমাদের বাণিজ্যিক অনিহা আর অবহেলার সুযোগ নিয়ে বাকিরা কোটী কোটি টাকার ব্যবসা করছে বাংলার থিম বেচে। খুব সাম্প্রতিক উদাহারন হল “লাল গেঁদা ফুল”। বাদশা আর জাকুলিন ভাইরাল হয়ে গেল আর বাঙ্গালী শিল্পী দু টাকার অনুদান পেল। অন্বীতা দত্ত সাফল্যের সঙ্গে যদি বাংলার থিম নিয়ে এইভাবে বাণিজ্যিক কাজ করে যান, বাংলার শিল্পীরাই উপকৃত হবেন। তাঁহাদের প্রতিভা বিশ্বের সামনে আদৃত হবে, আরো ভালো কাজের সুযোগ বাড়বে।
বাস্তববাদীদের অভিযোগ, দৃশ গুলি খুব কৃত্রিম লাগছে। কস্মিনকালেও কেউ বাঙ্গালী বাড়িতে বেগুনি রঙের ওআল পেপার দেখেনি। অথবা জমিদার বাড়িতে এত কম চাকরবাকর। সঞ্জয়লীলা বনশালি যখন পার্বতী ও চন্দ্রমুখীকে একসাথে নাচিয়ে ছিল তখন কিন্তু এনারা এত খুঁত দেখতে পাননি। বুলবুল ছবিটিরা দৃশ্যায়ন এককথায় অসাধারন, রঙের প্রতীকী ব্যবহার ( গোলাপি লাল রংটি ছবিটির থিম কালার) প্রশংসাযোগ্য। অসাধারন সিনেমাটোগ্রাফির জন্যই ছবিটি অনুপম হয়ে উঠেছে। ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে-ই চোখের খুশি আর মনের অনুরঞ্জন।এখানে গল্পের নায়িকা গাছে উঠলো বলে হাহুতাশ করা বা চাঁদের রং লাল কেন তাই নিয়ে গবেষণা আপ্রোয়োজনীয়।
হিন্দুবাদী প্রগতিশীলরাও ক্ষেপে গেছেন। কাহিনীটির থিম সংগ (মুল সংগীত) হল “কলঙ্কিনী রাধা”। রাধার কলঙ্কের বর্ননা দিতে গিয়ে কানু-কে হারামজাদা বলা হয়েছে। পূজিত ভগবানকে নিয়ে এমন অসভ্য গানের কথা মেনে নেওয়া যায়? এখানেই বাংলার সংস্কৃতির অনন্যতা। বাংলার সহজিয়া ও বাউলারা চিরকাল কানু কে নিজেদের মতো ভাবেন। রাখালিয়া মতি কানু-কে যদি আদর করে একটু গালাগালিই দিলো তাতে কি এমন ক্ষতি? নারীবাদের পক্ষে সওয়াল করলে কানু-র কাজ গুলো একটু গোলমেলে ধূসর গণ্ডির মধ্যেই পড়ে। পরস্ত্রীর সাথে প্রেম, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ – কোনটাই ঠিক সভ্য আচরণের উদাহরণ নয়। সহজিয়াদের যুক্তি একটু অন্যরকম। ভগবানকে একটু ত্রুটিপুর্ন না করলে নিজেদের সমকক্ষ হিসাবে ভালবাসবো কি করে? তাই কানু যাই করুক আমাদের ভালোবাসার মানুষ। তাঁর জন্য কলঙ্কিত হতে বাঙ্গালী রাধারা আজও দ্বিধা করবেন না। ছবিটিতেও নায়িকা কলঙ্কিত হয়েছেন পুরুষদের হাতে, কিন্তু ভালবাসার পুরুষদের ছাড়তে পারেননি।
এরপর আসি কলাকুশলীদের কথায়। তৃপ্তি দিমরি এক কথায় অনবদ্য। সারা ছবি ওনার দিকে তাকিয়েয় কেটে যাবে। এমন নূতন মুখ অনেকদিন দেখিনি। সৌন্দর্যর সাথে অভিনয়ও অসাধারন। কিন্তু ছবিটির সবচেয়ে জটিল চরিত্রটি অবশ্য যথার্থ ফুটিয়ে তুলেছেন পাওলি দাম। ছোটো বউ হিসাবে তাঁর ব্যাথা, ছোটবেলায় পাগলের সাথে বিয়ে হওয়ার দুঃখ, সারাজীবন ধরে বেইমানির শিকার এই অসঙ্গতিতে ভরা চরিত্রটি তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা খুবই প্রশংসনীয়। পরমব্রত-ও ভালো অভিনয় করেছেন। শুধু সত্য-র চরিত্রটিতে অন্য কোন বাঙ্গালী অভিনেতাকে বেশী মানাত।
অন্বীতা দত্তের গল্প বলার ধরন সাবলীল। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যের ছোট ছোট দৃশ্যবাহী ঘটনাগুলি তাদের অন্তর্নিহিত চিন্তা উদ্দীপক বার্তা গুলি খুব সহজে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তাহলে আর অপেক্ষা করছেন কিসের? আজকেই নেটফ্লিক্স-এ লগইন করে ছবিটি দেখে নিন। ভাল লাগবে।