নেপোয় মারে দই

সুশান্ত সিং রাজপুত মারা গেছেন বেশ কিছুদিন হল। জনতার আদালতে তাঁর এই অস্যাভাবিক মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে বলিউডের স্বজনপোষণ বা নেপোটিজম। করন জোহরকে টুইটারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিতর্ক ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর। সইফ আলি খান গতকাল বলেছেন অতীতে তিনিও নেপোটিজমের শিকার হয়েছেন। নেটিজেনরা তাঁর কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পাড়ছে না। নেপোটিজমের প্রতীক সইফ আলি। আমরা ৯০-র দশকে তাঁকে লম্বা চুলের শেফালি খান বলে জানতাম (হাসাহাসি করতাম!!), আজ তিনি সইফ আলি খান হয়ে উঠেছেন বলিউডের মার্কেটিং গিমিকে। এখন তিনিই নিজেকে নেপোটিজমের শিকার বলছেন!! কয়েক বছর আগে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনিই করন জোহরের সাথে গলা মিলিয়েছিলেন নেপোটিজম খুব ভালো বলে।  

নেপোটিজম আজকের নতুন জিনিস নয়, আদি আনন্তকাল থেকে চলে আসছে। সেই একটা কথা আছে না – “যা আছে ভারতে তাই আছে মহাভারতে” (অথবা উল্টোটা?)। নেপোটিজমের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে একলব্যের কথা। প্রান্তিকবাসী একলব্য – রাজার ছেলে অর্জুনের থেকে ভালো তীরন্দাজ। নিজেই নিজেকে শিখিয়েছে। গুরু দ্রোনাচার্জের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। গুরু দ্রোনাচার্জ কিন্তু আমাদের নেপোটিজমের প্রথম পাঠ এখানেই শেখালেন।তিনি নিজের গুরুগিরির ব্যার্থতা ঢাকতে এবং প্রিয় ছাত্র অর্জুনকে শ্রেষ্ঠত্যের আসনে বসাতে একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল চেয়ে বসলেন। যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় এভাবেই আমরা নেপোটিজমের উদাহরণ পড়ে ও শিখে আসছি। 

স্বজনপোষণ বা নেপোটিজম আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত। ছোটবেলা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবন অবধি এখনো বাবা, মায়েরা সন্তানের গতিবিধি ঠিক করে দেন। সন্তান কি খাবে, কি পরবে, কাকে বিয়ে করবে যদি বাবা মা ঠিক করেন, তবে কর্মক্ষেত্রেও সন্তান কি করবে তাতে বাবা মার (বা পরিবারের) ভূমিকা অনস্বীকার্জ। বিশ্ববিজয়ী আন্তর্জাতিক দাবাড়ু বিশ্বনাথান আনন্দ যখন বাবার পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করেন তখন তিনি অজ্ঞাতভাবে এই পারিবারিক মূল্যবোধেরই জয়জয়কার ঘোষণা করেন। এখানেই শেষ নয়। আর আছে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ও পারিবারিক বাণিজ্যের ঐতিহ্য। তাই পারিবারিক নির্নয় অনুযায়ী ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার বা উকিলের ছেলে উকিল হয়, ব্যবসায়ীর ছেলে ব্যবসায়ী হয়। এরপর আসি সামাজিক মূল্যবোধের কথায়। সরকারী বা বেসরকারী সংস্থায় কোন কাজের জন্য গেলে আমরা প্রথমেই খুঁজি শেখানে চেনা কে আছে। চেনা থাকলে কাজ সুবিধা মত বেরোবে, নইলে ঝামেলা অনেক। 

নিন্দুকেরা বলবেন এগুলো নিতান্ত তুচ্ছ বৈশিষ্ট্য – বলিউডের স্বজনপোষণের সাথে কোন যোগ নেই। বলি কি নিজের বুকে একটু হাত দিয়ে ভাবুন আপনি নিজে বলিউডের পরিস্থিতিতে কি করতেন। ছেলে রনবীর কাজ পাচ্ছে না বলে বাবা ঋষি কাপুর যখন নিজের বন্ধু প্রযোজকদের ফোন করে ছেলের জন্য সুপারিশ করতেন – ওনার জায়গায় আপনি হলে কি নিজের ছেলের জন্য এইটুকু করতেন না? অবশ্যই করতেন, আমিও একই কাজ করতাম। এ আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই যুক্তিতে তাহলে তো নেপোটিজম খারাপ কিছু নয়, সহজাত প্রবৃত্তি – Basic Instinct। গল্পটা দুর্ভাগ্যবশত এখানেই শেষ নয়।  নেপোটিজম যখন অন্যায়-এর জন্ম দেয় তখনই সমস্যার শুরু। একলব্য-কে যখন নিজের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিতে হয় বা সুশান্ত সিং রাজপুত-কে নিজের জীবন দিয়ে এই অন্যায়ের সাক্ষী থাকতে হয়, সেখানেই সমস্যাটি প্রবল হয়য়ে ওঠে। 

তাহলে এই সমস্যার সমাধান কোথায়? English-এ একটা কথা আছে – “Level Playing Field”। গুগল ট্রান্সলেট -এ টাইপ করে দেখুন, এর বাংলায় তর্জমা হচ্ছে  “সুষম প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র”, সমতরাল খেলার মাঠ নয়। খেলার মাঠে প্রতিযোগীর দক্ষতাই শেষ কথা। ব্রেট লি আপনি কার ছেলে ভেবে বলের জোরটা কমিয়ে দেবে না, বা এবি ডি ভিলিয়ার্স আপনার পরিবারের কথা মাথায় রেখে ছক্কা মারা বন্ধ করবে না। এইজন্যই সুয়ার্ট বিন্নি ব্যর্থ, রোহণ গাভাস্কার ব্যর্থ। তাই এই সমাজের সব ধরেনর উদ্যোগেই যদি সঠিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তাহলে নেপোটিজমের খারাপ দিকটি মাথাতুলে দাঁড়াতে পারে না। ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা এমনই প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় আমাদের জন্য। বলিউডের ছায়াছবির ক্ষেত্রেও এই প্রতিযোগিতা প্রযোজ্য ও আবশ্যজনক। 

শেষ প্রশ্নটি হল বলিউডে (বা টলিউডে?) কিভাবে এই প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যাবে। এই কাজের ভার এই ইকোসিস্টেমের সাথে জড়িত সব কলাকুশলীদের উপর যেমন পড়ে তেমনি পড়ে আপনি, আমি সবার উপর। সঞ্জয়লীলা বনশালি যদি সঠিক প্রতিভাকেই সবসময় তাঁর ছবিতে জায়গা করে দেন তাহলে এই অন্যায়ের অনেক অবসান হয়। তেমন-ই বাণিজ্যিক মার্কেটিং-র বাইরে আমারা যদি আরও বেশী করে সত্যিকারের ভালো কাজের কদর করি আর সোনম কাপুরের বিদেশের দৃশ্যসমৃদ্ধ মুভি দেখা বন্ধ করি। প্রকৃত প্রতিভা ও মেধার সঠিক কদর করেই এই অন্যায়ের জবাব দিতে পারব আমরা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *